বঙ্গবন্ধু: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

স্বোপার্জিত দক্ষতায়, নেতৃত্বের মোহনীয় কৃতিত্বে, ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে, সাহসে, সংগ্রামে ও ত্যাগে দীপ্তিময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) জন্মদিন আজ ১৭ মার্চ। শতবর্ষ পেরিয়ে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। বাংলাদেশের স্থপতি রূপে এবং জাতির পিতার পরিচয়ে তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার জাগ্রত হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত।

ব্রিটিশ-বাংলার একটি অতি অবহেলিত, অখ্যাত ও প্রান্তিক জনপদ থেকে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের অনন্য রাজনৈতিক নেতার উচ্চতম স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্য নির্ধারক তিনজন নেতার একজন তিনি, যে তালিকায় অন্য দুইজন হলেন ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) এবং পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮)।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাসের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার এই রাজনৈতিক ত্রিরত্নের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিশিষ্টতায় অতুলনীয় এবং শিখরস্পর্শী। কারণ, তিনি প্রবল দ্বিজাতি (হিন্দু-মুসলিম) এবং দ্বিমেরু (ভারতীয়-পাকিস্তানি) ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, রাজনৈতিক অধিকার ও পরিচিতি দিয়েছেন এবং জাতিসত্তাকে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। পক্ষান্তরে গান্ধী অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখলেও তিনি তাঁর স্বপ্ন সফল করতে পারেন নি। খণ্ডিত ভারতের জনক হয়েছেন। আর জিন্নাহর স্বপ্নের পাকিস্তানও রক্ষা পায় নি, দ্বিখণ্ডিত হয়েছে।  


পক্ষান্তরে দক্ষিণ এশিয়া তথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা। পাশাপাশি তিনি ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ অভিধায় ভূষিত। সমগ্র বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে সম্মান ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

বঙ্গবন্ধু একটি দলের নেতা হিসেবে স্বদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা অর্জন করলেও তিনি কেবল একজন দলীয় নেতা নন, দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালি এবং বিশ্ববাঙালির প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব, যা আবেগ, উচ্ছ্বাস ও অতিকথনের বিষয় মাত্র নয়। বরং তিনি ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’-এর শীর্ষসন লাভ করেছেন বিবিসি কর্তৃক বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বৈজ্ঞানিক জরিপের ভিত্তিতে। একজন নেতার, একজন রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যক্তিত্বের জীবনে এমন শিখরস্পর্শী সাফল্য বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

কারণ, বিশ্বের নানা দেশেই আদর্শস্থানীয়, অনুকরণীয় ও সর্বজন্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন, ফ্রান্সের ইতিহাসে দ্য গল, কিউবার ইতিহাসে ফিদেল কাস্ত্রো, ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো, চীনের মাও সে তুং প্রমুখ। কিন্তু কোনও দেশ বা জাতির ইতিহাসে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ উপমায় আলোকস্তম্ভের মতো অবস্থানকারী একক ব্যক্তিত্ব সারা বিশ্বেই আরেকজন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা বৃহত্তর বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বলতম উপস্থিতির মাধ্যমে সুনিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ রূপে স্বীকৃতি লাভের অনন্যতা ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ও সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে প্রতিপন্ন হয়েছে।


ইতিহাসের নানা পর্বের মধ্য দিয়ে একটা ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশে এক একটা জাতি ক্রমশ রূপ পরিগ্রহ করে। কখনো আবার নানা বাধায় তার জাতীয় রূপ, জাতীয় চিত্ত স্থির হওয়ার সুযোগ পায় না। এই বিচিত্র গতিপথেই বিশ্বের নানা জাতি পরিগঠিত হয়েছে। বাঙালি জাতিও গড়ে উঠেছে হাজার বছরব্যাপী নানা জাতি, উপজাতির ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে।

নৃবিজ্ঞানের গবেষণার ফলে আধুনিক বা তার পূর্ববর্তী বাংলার বাঙালি জাতিসত্তার দেহের আকার, গড়ন, জীবনযাত্রা, আচার-বিচার ও মানসিক নানা প্রবণতা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে যে, ‘পূর্ব-এশীয় জাতি-উপজাতির সঙ্গে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর কিছু মিলনে এবং পরবর্তীকালে তিব্বতি-মঙ্গোলীয় জাতিদের সংমিশ্রণে আদি বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে যৎসামান্য ইন্দো-এরিয়ান রক্তের, ভাষার, আচার-আচরণের ছিটে-ফোঁটা নিয়ে বাঙালি জাতি, বাঙালি সমাজ, বাঙালি সংস্কৃতি প্রথম গড়ে উঠে। এর কোনো অংশের নাম গৌড়, কোনো অংশের নাম বঙ্গ, আরও পরে রাঢ়। এসব অঞ্চলের আঞ্চলিক নামই ছিল তাদের প্রথম পরিচয়।’

এই বাংলার ভূগোলে অঙ্কিত মানচিত্রে যে ভূখণ্ড বিরাজমান, তার সঙ্গে বিহার প্রান্তের বেশ কিছু অঞ্চলও ছিল। ফলে ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকের গোড়া থেকে এ অঞ্চল বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা মিলিয়ে বাংলা প্রদেশের সেরেস্তাভুক্ত ছিল। বেশ কিছুদিন আসামও এই প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। উল্লেখ্য, ষোড়শ শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার নাম ছিল ‘সুবাহ বাংলা’। তারও আগে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি শাসনের আরম্ভ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ পর্যন্ত তুর্কি-পাঠান-আফগান শাসনে এই জনপদের নাম ছিল ‘বাঙ্গালাহ’।

বাঙালি জাতি ও বাঙলা নামক জনপদের হাজার বছরের পথ-পরিক্রমায় আধুনিককালের ইতিহাসের সূচনায় তথা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গদেশে যে জাগরণের সূচনা হয়, বাঙালি মুসলমান তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন নি। তখনকার এ জাগরণ বস্তুত উচ্চবর্ণের ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিপর্বই প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মুসলমানের জন্য ‘নবজাগরণের সূচনাকাল’, যদিও বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকেন নি এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশের অবসানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভাজিত হন।

উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিকতার সূচনায় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মতোই বাঙালি জাতি এবং বাংলা জনপদ পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হন, যাকে আশীষ নন্দী ও প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাঈদ এবং আরও অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যাপকতর পরিসরে তুলে ধরেছেন। 

স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, সাম্প্রদায়িকতায় বিভাজিত এবং ঔপনিবেশিক শাসনে নিষ্পেষিত ও বিপন্ন বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব ঘটে আলোকবর্তিকার মতো। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব এই যে, হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির মধ্যে বহু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটলেও তিনিই প্রথম সফলভাবে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানকে অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাষ্ট্রের জন্ম সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি একক ও সম্মিলিত বাঙালি জাতিসত্তার সাথর্ক ও সামগ্রিক রূপান্তরও ঘটিয়েছেন। তদুপরি, স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্বে বাঙালিকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে শোষণের সুদীর্ঘ অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছেন, যা তাঁর ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ পরিচিতির বাস্তব প্রমাণ বহন করছে।

বিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন দেশ স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিংবা বিভিন্ন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব কোনও দেশ ও জাতির শিল্প, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করেছেন বটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সফলতার মাধ্যমে তা অর্জনই শুধু করেন নি, বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কাঠামো দিয়েছেন এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক শোষণের অধীনতা মুক্ত করেছেন, যা কেবল বাংলাদেশের বাঙালিই নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় তিরিশ কোটি বাঙালিকে আত্মপরিচয় দিয়ে সম্মানের সঙ্গে জাগ্রত করেছে। এরই ফলে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ রূপে তাঁর ঐতিহাসিক অবস্থান শুধু যৌক্তিকতাই লাভ করেনি, সমকালীন প্রাসঙ্গিকতায়ও ধন্য হয়েছে।

* নিবন্ধটি একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রকল্পর অধীনে প্রণীত প্রবন্ধের সংক্ষিপ্তসার।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম