পংক্তির আলোয় পিতার জ্যোতির্ময় মুখ

  • ফকির ইলিয়াস
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী চলছে। কথা ছিল বাঙালি জাতি এই উৎসব উদযাপন করবে আলোয় আলোয়। তা পুরোপুরি হয়নি, হচ্ছে না কোভিড-১৯ এর কারণে। মহামারি করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে গোটা বিশ্বের দৃশ্যপট। তারপরেও তো জীবন থেমে থাকে না। চলে ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে। মুজিব জন্মশতবর্ষের অনেক আয়োজনই এখন স্থির হয়েছে ভার্চুয়াল ইথারে। আর এভাবেই প্রজন্মের প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর আদর্শ—তাঁর চেতনা।

মনে হয় না, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত কবিতা লেখা হয়েছে; বিশ্বের অন্য কোনো মহামানবকে নিয়ে এত কবিতা লেখা হয়েছে! তাঁর প্রতি কী এক ভালোবাসা এই বাংলা ভাষাভাষি মানুষের। কী এক রক্তিম আভায় কবিরা পংক্তিতে পংক্তিতে সাজিয়েছেন জনকের মুখ!

বিজ্ঞাপন

জাতির পিতাকে হত্যার পর গর্জে উঠেছিল বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। উপমহাদেশের বিশিষ্ট চিন্তক-লেখক অন্নদা শঙ্কর রায় লিখেছিলেন—

নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো
করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন
জাতির জনক যিনি অতর্কিত তাঁরেই নিধন।
নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর,

সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের
যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা।
কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা
একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের।

আমি বেড়ে উঠেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আর ছাত্রদের এগারো দফার আওয়াজ শুনতে শুনতে। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ১৯৭০ এর নির্বাচন আর ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমার শৈশবকে শাণিত করেছে। আমি মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

বেতারে শুনেছি জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণ। দেখেছি নৃশংস গণহত্যা। দেখেছি হায়েনা পাক হানাদার বাহিনী কিভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে আমার প্রতিবেশির ঘরবাড়ি। আমি দেখেছি মহান বিজয়ের দিন। শুনেছি গ্রামে গ্রামান্তরে মাইকে বাজছে ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠধ্বনি, প্রতিধ্বনি...’

জাতির পিতা একটি সোনার বাংলা চেয়েছিলেন। সেই পিতাকেই নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালোরাতে। এটি ছিল বিশ্ব ইতিহাসের একটি বর্বরতম ঘটনা। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেদিন এই বাংলার মাটি-বৃক্ষ-তরু-পাখি-নদী!

না—মুজিবকে বাংলার মাটি থেকে, বাঙালির মনন থেকে মুছে ফেলা যায়নি। সেই প্রমাণ আমরা প্রতিদিনই পাচ্ছি। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে বলতে পারি, তা অত্যন্তই সৌভাগ্যের বিষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নায়ক বানিয়ে একটি রাজনৈতিক চিত্র ১৯৬৮ সালেই তুলে ধরেছিলেন আমাদের একজন বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর ‘হুলিয়া’ শীর্ষক সেই দীর্ঘ রাজনৈতিক কবিতায় আমরা এই সাক্ষ্য পাই। এই কবিতায় তিনি লেখেন—

খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
— আমাদের ভবিষ্যত কী?
— আইয়ুব খান এখন কোথায়?
— শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?

এই কবিতাটি বেশ রিস্ক নিয়েই ছাপেন দৈনিক আজাদ-এর তখনকার সাহিত্য সম্পাদক কবি আ. ন. ম. গোলাম মোস্তফা। যাকে চৌদ্দই ডিসেম্বরে শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় নাম লেখাতে হয় মর্মান্তিকভাবে।

আমাদের সাহিত্য আর্কাইভ জানাচ্ছে—‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনাম দিয়ে করে আরেকটি কবিতা লিখেন কবি হাবীবুর রহমান। শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু তুমি আছো বলে’। এটি তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় আট মাস আগে। এর রচনাকালের তারিখসহ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক আজাদ-এর ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সংখ্যায়। যাতে তিনি বলেন—

বঙ্গবন্ধু, তুমি আছো বলে বিভীষিকাময় অন্ধকারের শব ঠেলে ঠেলে
প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে
আমরা এগিয়ে যাই উদয়াচলের পথে...।

প্রতিটি জাতি ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন হয় যোগ্য নেতৃত্বের। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি একটি অবিস্মরণীয় নাম। যে নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্তার শৌর্যবীর্যের আত্মগরিমা। কী চেয়েছিলেন তিনি? এই প্রশ্নটি যদি আবারও করি, তবে এটাই খুব স্পষ্ট জবাব পাব, একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আর কোনো লক্ষ্যই ছিল না তাঁর। যে কোনোভাবেই একটি রাষ্ট্রের জন্ম হোক, একটি জাতি মাথা উঁচু করে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াক—সেটাই ছিল তার প্রত্যয়। সেই জাতির নাম বাঙালি, সেই রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।

পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের কালরাতে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কেন এই নির্মম হত্যাযজ্ঞটি ঘটানো হয়েছিল তা গেল প্রায় পাঁচ দশকে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জাতির সামনে। একটি কুচক্রী মহল চেয়েছিল বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিতে। আর তা করতে স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে হনন করাটাকেই তারা বেছে নিয়েছিল সর্বাগ্রে। তার পরের সঙ্কটকালীন দিনগুলোর কথা সবার জানা।

একটি মহল মনে করেছি হত্যার মাধ্যমেই শেখ মুজিব এবং তার আদর্শকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে মুছে ফেলা যাবে। কিন্তু ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা গেছে, জীবিত মুজিবের চেয়ে চিরবিদায় গ্রহণকারী শেখ মুজিব ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন বিশ্বলোকে। প্রজন্মের গহিন হৃদয়ে। শুধু রাজনীতিতেই নয়, শিল্পে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতেও শেখ মুজিব হয়ে উঠছেন প্রজন্মের আলোর আইকন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক বিখ্যাত কবিই কবিতা লিখেছেন। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর পর নীরবে নিভৃতে জাতির পিতাকে স্মরণের জন্য কবিতা হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এখানে বিখ্যাত কিছু পংক্তিমালা আমি সহৃদয় পাঠককে আবার পড়তে বিনীত অনুরোধ জানাই।

[ক]

ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;
ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে
প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়;
ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে সে উঠে আসে
রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।
ধন্য সেই পুরুষ, কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে
ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।

[ধন্য সেই পুরুষ / শামসুর রাহমান]

[খ]

এখনো রক্তের রঙ ভোরের আকাশে।
পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে
কবে থেকে ভাসছে বাতাসে।
অপেক্ষায়—শব্দের—শব্দেই হবে সে মুখর—আরো একবার
জয় বাংলা ধ্বনি লয়ে যখন সূর্যের আলো তার
পাখায় পড়বে এসে
ইতিহাস থেকে আরো কিছুক্ষণ পরে।
মানুষ তো ভয় পায় বাক্‌হীন মৃত্যুকেই,
তাই ওঠে নড়ে
থেকে থেকে গাছের সবুজ ডাল পাতার ভেতরে।

[পনেরো আগস্ট / সৈয়দ শামসুল হক]

[গ]

এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে—
বত্রিশ নম্বর থেকে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
মাঠময় শস্য তিনি ভালোবাসতেন,
আয়ত দুচোখ ছিল পাখির পিয়াসী
পাখি তার খুব প্রিয় ছিল—
গাছ-গাছালির দিকে প্রিয় তামাকের গন্ধ ভুলে
চোখ তুলে একটুখানি তাকিয়ে নিতেন,
পাখিদের শব্দে তার, খুব ভোরে, ঘুম ভেঙে যেত।

[এই সিঁড়ি/ রফিক আজাদ]

[ঘ]

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বলল দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিল হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বলল দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষ ছিল মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই!

[কফিন কাহিনী / মহাদেব সাহা]

[ঙ]

কবরের নির্জন প্রবাসে
তোমার আত্মার মাগফেরাতের জন্যে
যেসব বৃদ্ধেরা কাঁদে
আমাদের যেসব বোনেরা
পিতা, ভাই, সন্তানের মতো
তোমার পবিত্র নাম
ভালোবেসে হৃদয়ে রেখেছে
যেসব সাহসী লোক
বঙ্গোপসাগরের সব দুরন্ত মাঝির মতো
শোষিতের বৈঠা ধরে আছে
হে আমার স্বাধীনতার মহা স্থপতি
মহান প্রভুর নামে আমার শপথ
সেইসব বৃদ্ধদের প্রতি আমার শপথ
সেইসব ভাই বোন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি আমার শপথ
আমি প্রতিশোধ নেব
আমার রক্ত ও শ্রম দিয়ে
এই বিশ্বের মাটি ও মানুষের দেখা
সবচেয়ে মর্মস্পর্শী জঘন্য হত্যার আমি প্রতিশোধ নেব।

[টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে / কামাল চৌধুরী]

বাংলা কবিতায় ‘ধানমণ্ডি বত্রিশ’, ‘টুঙ্গিপাড়া’, ‘খোকা’, ‘সাতই মার্চের আঙুল’—এমন কিছু শব্দ একাকার হয়ে গিয়েছে বাংলার মৃত্তিকালগ্ন পাঠকের কাছে। আশার কথা হচ্ছে এই ধারা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই চলছে। আগেই বলেছি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর পরোক্ষ তো বটেই—প্রত্যক্ষভাবেই অনেক কবি তাঁদের কলম সচল রেখেছিলেন।

জাতির পিতাকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগস্ট কবি আসাদ মান্নান লেখেন তাঁর দ্বিতীয় কবিতা। ‘সবুজ রমণী এক দুঃখিনী বাংলা’ শিরোনামে এটি প্রকাশিত হয় ‘অন্তরে অনির্বাণ’ স্মারক সংকলনে ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৭ তারিখে। প্রকাশক ছিল, বাংলাদেশ পরিষদ, তথ্য মন্ত্রণালয়। কবিতাটির প্রথম পংক্তিগুলো এখানে দিতে চাই—

একটি দরজা খুলে আমি গান শুনতে পেলে পৃথিবীর বুকে
ধূপের বিমিশ্র হাসি জননীর ঠোঁট ছুঁয়ে রক্তে ভেসে যায়
মাছের চোখের মতো কী নরম শব্দ এক আমার সম্মুখে
কেবল লাফিয়ে ওঠে—আমি তার জন্মদাতা, কেবল পালাই;
রাত্রির গুহায় শুয়ে অন্ধকার চারিদিকে দেখে চোখ মেলে
সবুজ রমণী এক—নামহীন, জেগে আছে মেঠেদীপ জ্বেলে।

আশার কথা হচ্ছে, এই প্রজন্মের অনেক কবি বঙ্গবন্ধুকে নব-নবতর আঙ্গিকে তুলে আনতে সচেষ্ট রয়েছেন তাঁদের কবিতায়। এতে উঠে আসছে জাতির পিতার দ্রোহ, শাসন, আদর্শ, ঐতিহ্য, মানবতাবাদ, সাম্যবাদ এমন অনেক প্রকরণ ও চিত্রকল্প। নব্বই দশকের একজন কবি লেখেন—

এখানে ওখানে সবখানে আছো বঙ্গবন্ধু তুমি,
সঙ্গীতে আছো পতাকায় আছো জুড়িয়া মাতৃভূমি।

কবিতায় আছো ছন্দের মাঝে
তব-নাম নিয়ে নিক্কন বাঁজে
পাখিদের গানে দোলায়িত ধানে
তুমি আছো সব শিশুদের প্রাণে
কিশোর-মনের মোহন বাঁশিতে
আমাদের—সব দুঃখ নাশিতে
তারুণ্যে আছো অরণ্যে আছো
আমাদের তুমি ভালোবাসা যাচো
সবখানে দেখি, তোমাকেই লেখি
স্বপ্নেও তুমি এসে যাও এ-কী!
বাংলাদেশের অলিগলি তুমি আজ;
মুজিব মানেই শিরস্ত্রাণের তাজ।

হৃদয়ে রয়েছো পিতার আসনে বঙ্গবন্ধু তুমি,
আজ—এইদিনে শতোশ্রদ্ধায় তোমারই নামটি চুমি।

[পনেরো আগস্ট / মাশূক ইবনে আনিস]

বাংলা সাহিত্যের অগ্রজ কবিরা জাতির পিতাকে কবিতায় যে অর্ঘ্য-অনল দিয়ে গিয়েছেন, এর আলো দেখেই এগোচ্ছে আজকের প্রজন্ম।

জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের ‘ডাকিছে তোমারে’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘কোন ছবিগুলি’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বীর নেই, আছে শহিদ’, বেলাল চৌধুরীর ‘রক্তমাখা চরমপত্র’, শহীদ কাদরীর ‘হন্তারকের প্রতি’, হেলাল হাফিজের ‘নাম ভূমিকায়’, আসাদ চৌধুরীর ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’, ত্রিদিব দস্তিদারের ‘জনকের ছায়া’, সানাউল হকের ‘লোকান্তরে তুমি আত্মদানে’, আবিদ আনোয়ারের ‘প্রতিরোধ’ কবিতাগুলি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কালের ক্যানভাস হিসেবেই বিবেচিত হবে।

কবিতা হচ্ছে মূলত সাহিত্যের বীজ। এই বীজ থেকে রূপ নেয় মহীরূহ। একটি কবিতার কয়েক পংক্তি দিয়ে লেখা যায় গল্প—লেখা যায় উপন্যাস। এই নিবন্ধের শেষপর্বে এসে আমি এই সময়ের কয়েকজন আলোকিত কবির পংক্তি তুলে ধরতে চাই।

[১]

বাংলার শহর নদী সাগর সবুজ শ্যামল গ্রাম
মাঠ বনানী আলো বাতাসে শেখ মুজিবের নাম।
সোনালী ফসল মাঠে মাঠে কৃষকের মুখে হাসি
সুখে দুখে মুজিব তোমায় আমরা ভালোবাসি।
উৎসবে পার্বণে বাঙালির ঘর স্নিগ্ধ সতেজ সজীব
সবার হৃদয়ে আসন পাতা মুজিব চিরঞ্জীব।

[শেখ মুজিবের নাম / মিলু কাশেম]

[২]

একটি কুসুম ফুটবে বলে
নিঝুম রাতের প্রহর চাঁদের আলোয় ভিজে,
ভোরের আলো জানত
অপেক্ষা মানে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয়,
তারপর অপেক্ষাগুলো গলা ফাটিয়ে
তোমার জন্ম ঘোষণা করল।
টুঙ্গিপাড়ায় আজ জন্ম নিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান,
তখন কালের দুর্যোগ রাত্রি নিজেকে লুকাতে শুরু করল।

[পিতার আঙুলে স্বাধীনতার সূর্যোদয় / ওয়াহিদ জালাল]

[৩]

ছোট কালে বাবা আমাকে বাঘের গল্প শোনাতেন
সুন্দরবনে থাকত বলে বাঘ নাকি ভীষণ সুন্দর।
বাঘের গোঁফের মধ্যে এবং লেজে মানচিত্রময় নদী
আর বড় হা’য়ে ছিল গোটা একটি জনপদের ঘুম—
আমি বাঘের তরুণ গল্প অনেক শুনেছি।

[ছোটকালের বাবা / রিজোয়ান মাহমুদ]

[৪]

আকাশে অযুত তারাদের মাঝে যে তারকা দ্যুতিমান
সে যে বাঙালির অগ্নিপুরুষ মুজিবুর রহমান।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক তিনি
বাঙালির প্রাণে বাজে প্রতিদিন তাঁর বজ্রধ্বনি।
তাঁর বরাভয় মন্ত্রে আমরা করেছি স্বদেশ স্বাধীন
প্রাণে প্রাণে তাই শেখ মুজিবুর রয়েছেন অমলিন।
সুখে-দুঃখে সংকটে তিনি রয়েছেন যেন পাশে
বাংলার প্রাণে সজীবতা আনে মুজিবের সুবাসে।

[জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান / দিলু নাসের]

[৫]

আজ এত এত প্রেমিক, জারজ বৃক্ষ!
পিঠ চাপড়ে মাতম করে
ষাটোর্ধ ভণ্ডের দল ‘হায় মুজিব হায় মুজিব!’
পতঙ্গেরা ডানা মেলে সমুহ সর্বনাশের অভিন্ন উল্লাসে
বাড়ন্ত আগাছা গিলে খায় বৃক্ষের শরীর।

অথচ সেদিন ওরা টু শব্দটিও করেনি পিতা
ভণ্ড শামুকের দল তোমার নামও ভুলে যায়!

[পিতা / শামসুল আলম সেলিম]

মুজিব আছেন এই বাংলায়। তিনি থাকবেন। বিশ্বব্যাপী আজ বাংলা ভাষা ও বাঙালির এই ব্যাপৃতি—তা তো তাঁর জন্যেই। তিনি যে স্বাধীনতার মশাল জ্বেলে গিয়েছেন, তা বুকে ধারণ করতে হবে প্রজন্মকে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সত্যের প্রতিভূ। ছিলেন সৎসাহসের গিরিসম মানুষ। তিনি যতই আলোচিত হবেন—ততই মানুষ অনুপ্রাণিত হবে তাঁর ত্যাগের প্রতি। আজ তাঁকে নিয়ে হাজার হাজার কবিতা ইউটিউবে আবৃত্তি করছেন আবৃত্তিকাররা। এই অর্জন গোটা জাতিসত্তার। মানুষকে তার অর্জনের জন্য কিছু প্রেম বুকে জাগিয়ে রাখতে হয় সবসময়ই।