তোমার এসব বুঝতে পারার কথা না, তুমি এসবের সামনে আগে পড়োনি; কী বলব বুঝতে পারি না, এটুকু ছেলে আমার সঙ্গে তর্ক করছে, জানি না, তবে ওর বাপের আস্কারা তো আছেই, ওর বাপ নিজের জীবনে শুরু থেকে একটা পর একটা কাণ্ড করেছে, আমি কিছু বলতে পারিনি, কারণ সংসারে আমার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, সবই ওর মায়ের হাতে ছিল, আর আমি আসলে কোনো ভূমিকা পালনও করতে চাইনি, আমি তো জানি আমার জীবনে কী ঘটেছিল, অথচ আমার ছেলেও গোড়া থেকে যে পথে গিয়েছিল, সেই পথেই যাচ্ছে তার ছেলে, রক্ত! রক্তের গতিপথ আর কে ঠেকাবে? তবুও আমি বলি, বলতে শুরু করি, আর বলতে বলতে ভুলে যাই, আমার সামনে পাভেল আছে কিনা উঠে গেছে, কারণ একটানা বলছিলাম কথাগুলি, ওকে জানানো দরকার, আমি তো জানি নিজের ভালো বোঝাটা ছাড়া আর জগতে কিছু করার থাকে না, আর থাকতে পারে—পরের জন্য কিছু করা, এ-ই; তাই আমি বলছিলাম, বলছিলাম যে, আমার বয়স এখন প্রায় পঁচাত্তর, পঁচিশ বছর বয়সে যখন যুদ্ধ এলো, এম এ পাশ করে বাপের মায়ের ভাষ্যমতে আমি ‘দেশউদ্ধার’ করতে নেমেছি, চাকরিবাকরি করার কোনো লক্ষণই ছিল না, আমার তখন সোজা কথা, আগে দেশের স্বাধীনতা তারপর চাকরি, কিন্তু কী হলো, জানো না তুমি, আমি যুদ্ধ থেকে ফেরার অল্প কদিন পর বলা হয়, আবারও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে, বোঝো তো আন্ডারগ্রাউন্ড কী? পার্টিতে আবার ভাঙন, বোঝো পার্টিতে ভাঙন হলে কেমন লাগে জানবাজ কর্মীদের কলিজায়? সেসময় আমার বন্ধু দিব্য ভট্টাচার্য, তোমার দিব্যদাদু, বলল, আর পারা যাবে না, যাবি আমার সঙ্গে? কোথায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে, লন্ডন, আমি বলি, লন্ডন? কেন তুই কি ভেবেছিলি, আমি তোকে আমার সঙ্গে আবারও কলকাতায় যেতে বলব? শোন, যুদ্ধ করে জিতে এসেও যদি ফের কানে বানের মতো শুনতে হয়, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, তাহলে আর কী করার থাকে, সারা জীবন যুদ্ধ করা যায় না, নাকি করা যায়? দিব্য আমার গুরু ছিল, সেই আমাকে মার্কস-এঙ্গেলস সব পড়িয়েছিল বুঝিয়েছিল, তবে সে আমাকে বলেছিল, সে মার্কসবাদী নয়, মানে, যে অন্ধ মার্কসের অনুসারী নয়, অন্ধ অনুসারীই যদি হবে, তাহলে মার্কস পড়বে কেন, বা পড়ে তাহলে তার কী লাভ হলো? বলেছিল, আমার তো মনে হয় মাও সে তুং-ও মার্কসিস্ট নন, নইলে তিনি বিপ্লবই করতে পারতেন না, সে আরো বলেছিল, আমি তো নিজেকে মার্কসের চেয়ে শক্তিশালী মনে করি; আমি হতবাক! বলে, হাঁ করে রইলি যে! এটা তো হাঁ করার কিছু নয়, দেখ, মার্কসের ভেতরে আমি ছিলাম না, কিন্তু আমার ভেতরে মার্কস আছে আবার আমিও আছি, ফলে আমি ও আমার ভেতরে থাকা মার্কস দুয়ে মিলে আমি যা, সে কি মার্কসের চেয়ে শক্তিশালী নয়? আমি বলি, পার্টির লোকজন জানলে...; জানলে কী করবে, বের করে দেবে? দিক, কেবল বেরই করে দেবে না, তো কী মেরে ফেলবে? মারুক; দিব্য এত স্বাভাবিকভাবে বলছিল, দিব্যির জেঠু এদেশ ছেড়েছিলেন ব্রিটিশ আমলেই, আর ছোটকাকা যুদ্ধের পর আর আসেনি, তিন ভাই ছিলেন, এর ভেতর দিব্যর বাবাই রয়ে গিয়েছিলেন দেশে, যুদ্ধের আগে অবশ্য দিব্য মা-বাবাকে কলকাতা রেখে আসে, মহিম ভট্টচার্য অবশ্য সরকারি চাকরি করতেন, ভালো মাইনা, কলকাতায় সেটা কোথায় পাবেন, পাকিস্তান আমল হলেও তার চাকরির বদৌলতে সম্মানের জীবন ছিল এখানে, তারপর দিব্যর রাজনীতিতে যাওয়াটা গোল বাঁধাল; দিব্য বলছিল, রাজনীতি করেছিলাম বলেই হাওয়াটা বুঝতে পেরেছিলাম, রাজনীতির মূলনীতি হলো: ঝোপবুঝে কোপ, আজ যে বন্ধু, কাল সে শত্রু, আবার শত্রুই হয়ে যায় বন্ধু, যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন—আমি মনে করেছিলাম যে মার্কসবাদ আমাকে মুক্তি দেবে, সেটা দিয়েওছে, কিন্তু ব্যক্তি আমাকে—জগৎ চিনিয়েছে, পার্টি করতে গিয়ে আরো বেশি চিনিয়েছে—রাজনীতি বইয়ে পড়া দিয়ে হয় না, মাথা লাগে, “যাহা মস্তকে নাই, তাহা পুস্তকে খুঁজিয়া কী লাভ”; দিব্যর এই কথাটা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু এও ঠিক রাজনীতি ছাড়া মুক্তি কোথায়, তারপর দ্বিধা কাটে না, আগে ব্যক্তির মুক্তি, না কি আগে সমষ্টির, ব্যক্তি ধরে ধরে মুক্ত হতে হবে সমস্ত বিভেদ থেকে, না উল্টোটা? এই নিয়ে দিব্যর পাগল হওয়ার দশা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পর পর, তারপর হঠাৎ সে বলে, আমি একটা জিনিসে পৌঁছাতে পেরেছি, খুবই সাধারণ তস্য সাধারণ একটি জিনিসে; কিন্তু দিব্যকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমি বলেছিলাম, আমি মনে হয় তোর আগে তাতে পৌঁছে গেছি; দিব্য বলে, ঠিক আছে খেলাটা হোক, তুই আগে লিখে ফেল—এই কাগজে, তারপর আমি মুখে বলি, তারপর মিলে কিনা দেখ; আমি লিখেছিলাম, লিখে কাগজটা ভাঁজ করে ওর হাতে দিয়েছিলাম, আর দিব্য মুখে যখন বলে যাচ্ছিল, আমি দেখলাম দুয়েকটা শব্দ ছাড়া আমি যা লিখেছিলাম তা-ই সে বলছিল, যার সার কথা হলো: মানুষের কল্যাণ ছাড়া আর জগতে আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করার বা রাখার দরকার নেই, কল্যাণ যদি না করতে পারো তো অন্তত তোমার কথা ও কাজে এমন একটা কিছুও যেন না হয় যা থেকে কারো ক্ষতি হতে পারে; আসলেই আমার পরানের বন্ধু বলতে যা বোঝায়, আর দিব্যও বলেছিল, তুই আমাকে ঠিক বুঝতে পারিস, চিন্তা করে দেখ এই অতি সহজ কথাটা বুঝতে আমাদের এত সময় লেগে গেল! এজন্যই দিব্য আর দেরি করেনি, কারণ আসল কথা—মানুষ, জগতের যেখানেই থাকি মানুষের ভালো যাতে হয়, এমন কিছুর জন্যই আমরা কাজ করব, তাই লন্ডন হোক, কি কলকাতা হোক কি ঢাকা; আমি বলেছিলাম, তাহলে আমেরিকা চল, না, না, আমেরিকা এখন না, আগে লন্ডন, তারপর বাকি দেখা যাবে, সেই বাকি দেখতে আমি ও সে, এক সুন্দর সকালে, আমরা প্রায় কাউকে কিছু না বলে লন্ডন চলে যাই, পার্টির লোকজন আমাদের কদিন হন্যে হয়ে খুঁজে হাল ছেড়ে দেয়, তারপর জেনে যায়, কারণ আমরা এমনভাবেই গিয়েছিলাম যে আমাদের দুজন ছাড়া আর কেউ টুঁ শব্দটি টের পায়নি, জানি না, আমাদের এই যাওয়াটুকুকে পালানো তুমি বলতে পারো, কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে তুমি কোথাও পালাতে পারবে না, কিসের জন্য পাগল হচ্ছো গার্মেন্টশ্রমিক ও মালিকদের ইন্দুর-বিলাই খেলার ভেতরে তুমি কী করতে পারো? কদিন আগে পাটুরিয়া ঘাটের অবস্থাটা দেখেছো, সামাজিক দূরত্ব, সোশ্যাল ডিসটেন্স! ফুঃ! অবস্থাটা এমন যে নিজেকে ঠিক রাখার মানেই তুমি অন্যের উপকার করবে, কী আশ্চর্য ভাবা যায়, জগতের সমস্ত ক্ষমতা অকেজো হয়ে গেছে আজ, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা দিয়ে এত অস্ত্র, এত বোমা কোনো কাজে লাগছে না, দিব্য আমাকে কদিন আগে মেইল করল, ইচ্ছা করেই, কারণ ওই কথাগুলি মুখে বলা যায় না, মুখে বললে আসলে কথাই হয়ে ওঠে না, তাতে ও এটাই লিখেছে, জগতের সমস্ত বিশ্বাস মতবাদ আসলে এই পারমাণবিক বোমার মতো, কোনো কাজে লাগে না, স্রেফ পড়ে থাকে, এই মতবাদের জন্য পাগল না হয়ে, যত তাড়াতাড়ি কেউ বুঝতে পারবে যে, মানুষের মঙ্গল করা ছাড়া মানুষের আর কোনো কিছুর দরকার নেই, ততই তাড়াতাড়ি আমাদের মুক্তি মিলবে, আমি ও তুই সেটা আজ থেকে মোটামুটি পঞ্চাশ বছর আগে টের পেয়েছিলাম, একসাথে একযোগে, অবশ্য আমরাই তো জগতে প্রথম নই, সারা দুনিয়ায় এমন কোটি কোটি মানুষ পাওয়া যাবে, তারপরও অনেকেরই মনে এখনো গেঁড়ে আছে—এশীয়রা তাদের নোংরা ধর্মের মতোই নোংরা, যেমনটা ভারতীয়দের সম্পর্কে চার্চিল মনে করত, আর আফ্রিকার কালো মানুষদের নিয়ে ঘৃণা অবজ্ঞার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে বহু সাদারা এত এত জ্ঞানচর্চার পরও শিক্ষাদীক্ষার পরও আজও পারেনি, ফলে তুমি যেখানে থাকো, সাদা বা কালো যাই হও, যেমাত্র তোমার ভেতরে কোনো কিছুর প্রতি অযৌক্তিক ঘৃণা দেখা দেবে, সেই মাত্র তোমার সমস্ত জ্ঞানবিদ্যা ‘হুরুসফাডা’ হয়ে যাবে, বরিশালের এই কথাটা দিব্য দারুণভাবে বলবে, মানে যে নারকেল ভেতরে পুরো পচে বাতিল হয়ে গেছে তাই হলো ‘হুরুসফাডা’, সোজা বাংলায় ‘ফোঁপরা’ হয়ে যাওয়া, ‘ফোঁপরা’ আসলে তো বাংলা না, এসেছে হিন্দি থেকে, হিন্দি ভাষার ‘পাছিনা’ মানে ঘাম শব্দটা আমার খুব পছন্দ;... দিব্য বেঁচে গেছে কারণ এখানে সে এমবিবিএস পাস করে গিয়েছিল, সেখানে কী কীকরে আবার পড়া শুরু করে, আমি কদিন এদিক-ওদিক করে আমেরিকা চলে যাই, কিন্তু আমার কোথাও ভালো লাগেনি, কত কিছু করেছি বিদেশে, থিতু হতে পারিনি, আসলে চাইনি, তাছাড়া আমার তো আস্ত একটা নিজের দেশ রয়েছে, ভাবা যায়—ইহুদিদের জন্য ছোট্ট একটা দেশের জন্য থিওডর হার্জেলের উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল, ‘জ্যুইস কোয়েশ্চেনে’র একটাই জবাব ছিল ‘নিজেদের একটা দেশ’, তো সেই দেশ আমাদের আছে, ছিল, হাজার বছর ধরে ছিল, কেবল সেই দেশটা নিজেদের করে পাওয়ার বাকি ছিল, সেই দেশটা পেয়েও আমরা মূল বিষয়টা বুঝতে পারলাম না, তাই সব কিছু ফোঁপরা হয়ে গেছে, যা-ই করেছি আমরা;—আমি কথাগুলি দিব্যকেও নানান সময়ে বলেছি, কিন্তু দিব্য আর পরে ভরসা পায়নি ফিরে আসার, বলেছিল, আমি একটু হলেও তো জীবনে রাজনীতি করেছি, হাওয়াবদল তো টের পাই, সত্যিই! কে নাকি ইন্দিরাকে বলেছিল, জয় বাংলাদের স্বাধীন করার জন্য যে সাহায্য সহযোগিতা করছেন, কোনো লাভ হবে না! তিনি বললেন, কী বলতে চান? তখন তাকে বলা হলো, আগে ছিল একটা পাকিস্তান, এখন হবে দুটো পাকিস্তান; আমি বলেছিলাম, দিব্য কী বলিস এটা! তুই!—আমি আবেগ থেকে কথা বলি না তুই জানিস, জগতটাকে নির্মমভাবে দেখতে না পারলে মমতা জন্মায় না, সেই মমতার তো সবচেয়ে বেশি আমার নিজের জন্য, তাই না? তোকে হামসফর বা সাথী হতে বলেছিলাম কারণ নিজের পরই আমি তোকেই বুঝতাম, তারপর আমি মার্থাকে বিয়ে করেছি, বাঙালি কাউকে বিয়ে করিনি, কারণ বাঙালি মেয়েরা আমি যে জীবনে যে যাপনে বিশ্বাস করি তা ধরতে পারবে না; আমি বলি, আহা লোকে আর বাঙালিদের বিয়ে করেনি; আমি দেখতাম দিব্যর অনেক কিছু আমার সঙ্গেও আর মিলছে না, একটা দেশ কেবল দেশ না, আরো অনেক কিছু, সবচেয়ে বড় কথা এই ‘বাংলা’ ভাষার জন্য আমার এমন পিপাসা, বাংলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে দেখতে না পারলে আমার দিনটাই শুরু হতো না, এটা কি ম্যাটেরিয়ালিস্টিক? খবরের কাজ নামের বস্তুটা না বাংলা অক্ষর মালা দিয়ে সাজানো, এমন কিছু স্পর্শ করার টান কি অবস্তুগত কিছু? আমি জানি না, রাসেল তার সারা জীবনে দর্শনচর্চা করে একটি জিনিসই নাকি বুঝেছিলেন যে, দর্শনের সার কথা মাত্র দুটো বিষয়ে নিহিত, “হোয়াটই ইজ ম্যাটার নেভার মাইন্ড, হোয়াট মাইন্ড নো ম্যাটার”, আমি সেটাকে নিজের মতো করে বুঝেছিলাম, ‘মন বস্তু নয়, বস্তু মন নয়’, যদিও এই দুটো কথার ভেতরে আমি নিজে সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম অনেক পরে, আসলে তো কিছুই বুঝতে পারি না, এই যে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে জীবন গেল, তার নিজের যে ব্যক্তিগত লড়াই, স্ট্রাগল বলা হয় যা, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামই জীবনের নিয়ম, সে কথা হিটলার বুঝুক কি আমি নিজের মতো বুঝি, আসলে তো বুঝি—একটা কিছু চাই যা নিজের মতো করে পাওয়া যাবে, ভরসা করা যাবে, আসলে কী বলব, ওই ট্রাস্ট-টাই নষ্ট হয়ে গেছে গোঁড়া থেকে, জাতিতে জাতি পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি আর গোটা জগতের মানুষ; দিব্য আরো নির্মমভাবে বলেছিল, এভাবেই দুনিয়া চলবে, যেভাবে চলে আসছে, এর তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, মাঝে মাঝে দুয়েক একজন লেনিন মাও ক্যাস্ট্রো আসবেন, কিন্তু আর কী, ফলে তুমি আমি যে গোঁড়ামিমুক্ত হয়েছি, তাতে কেবল নিজেদের মুক্তি হয়তো হয়েছে, কিন্তু এই জগতের কারোরই কিছছু যায় আসেনি, আসবেও না, আমি মনে করি, কেবল মানুষের জন্য ভালো করা ও নিজে ভালো থাকাটাই সবচেয়ে বড় কাজ, জগতের যেখানে যে লোকটা ভালোমানুষ হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, সে-ই আসলে একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট; আমার একটু হাসিও পেয়েছিল, কারণ দিব্য এত কিছু থেকে সরে গেলেও সবার উপরে কমিউনিস্ট হতে হবে, বিপ্লবী হওয়া নয়, নিজে সৎ ও সাহসী জীবনযাপন করা, বুদ্ধির সঙ্গে জীবনযাপন করা,—এমন লোকমাত্রই আসলে নিজের অজান্তেই কমিউনিস্ট—এ থেকে দিব্য সরে আসতে পারেনি, কিন্তু আমারও সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, আমি নিজেও কি সরে আসতে পেরেছি, আধুনিকতা বলতে কি আধুনিক বলতে যা বুঝি—তা ওই মার্কসবাদই, এর পর আর কিছু আসেনি, ফ্রয়েড নির্জ্ঞানের কথা বলেছেন, রাসেল ক্ষমতার কথা বলেছেন, কিন্তু সবই তো তলিয়ে ভাবলে বলা যায় আছে ওই একটাই শ্রমের ওপরে, শ্রম দেওয়া ও শোষণের ওপরে,—এটাই সব তফাত তৈরি করে দিয়েছে, কারণ শ্রম ছাড়া আর কিছুই বস্তুত সত্য নয়, ফলে রক্ত আর যাবে কোথায়, বিদেশ থেকে ফিরে আসি আশির দশকের ঠিক মাঝখানে, বড় ভাই নিজের ব্যবসায় আমাকে লাগিয়ে দেয়, সেই ব্যবসাটা দূর গ্রামে ছিল বলেই আমি রাজি হই, আমি কেন জানি না, সারা পৃথিবী ঘুরে, এত সব আধুনিক শহরে থেকে আমার শহর জিনিসটা আর সহ্য হচ্ছিল না, একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করি, আসলে করানো হয়, গ্রামের একদম সাধারণ একটি মেয়ে, যদিও সে স্কুলে পড়াত, বছর ঘুরতেই পুত্র সন্তানের পিতা, হ্যাঁ এভাবে ফের আটকা পড়ি জগতের সবচেয়ে মায়াময় কারাগার, যার নাম সংসার, পরিবার, সেই ছেলে বড় হয়েছে, বিপ্লবীর রক্ত, রাজনীতিতে বিপ্লব না করলেও কলেজ পাশ করার আগেই গোপনে বিয়ে করেছে, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, দেখিয়েছে বটে ছেলে আমার, বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি, সেই সংসার যা করার রুবিনাই করেছে, আমি কেবল টাকা জুগিয়ে গেছি, আর বসে বসে খবরের কাগজ পড়েছি, জানি না কেমন নেশার মতো জীবন না কি ঘোরের মতো জীবন, দিব্যর সঙ্গে তারপর যোগাযোগ কখনো কেটে যায়নি, মাসে না হলেও তিন মাসে কি ছয় মাসে দিব্য একটা চিঠি লিখত, এখন তো মেইল করে, ওর মেইলের উত্তর দেওয়ার জন্য, এই বুড়া বয়সে আমাকে কম্পিউটার শিখতে হলো, তারপর তো মেইলও গেল, মোবাইল ফোন এলো, এখন তো কত কিছুতে দিব্যর সঙ্গে কথা, হোয়াটস আপ, ইমো—এখানটাতেই দিব্য ফোন করল, আমার কলেজে পড়া নাতি কদিন আগে ফেসবুক খুলে দিয়েছে, তা দিয়েও যোগাযোগ হয় দিব্যর সঙ্গে, সময়কালে যা যা লাগে; সেই মেসেঞ্জারেই ফোন করেছে সে, দিব্যকে বলি, তোমার কথাই হচ্ছিল নাতির সঙ্গে, বলে, তুইই আছিস ভালো, কারো হুকুমাদরি করতে হলো না, হুকুমহীন একটা জীবন কাটিয়ে গেলি; সত্যি তো এটা কখনো ভাবিনিরে, আসলেই; দিব্য বলে, তুই বলেছিলি, তোর মনে পড়ে কিনা, বলেছিলি, যে তুই এমন একটা জীবন চাস যেখানে তোকেও কেউ হুকুম করবে না, তুইও কাউকে হুকুম করবি না, ভেবে দেখ, তুই কিন্তু সেই জীবনটাই পেলি, সত্যি, কথায় বলে না, মানুষ আসলে যা চাওয়ার মতো করে চায়, ভেতরে ভেতরে গভীরভাবে যা চায়, সেটাই সে পায়, পেয়ে যায়, ইয়ু আর সো লাকি ম্যান, আর আমি তো একটা অন্য মানুষের জীবন কাটিয়ে গেলাম, চেয়েছিলাম বিশ্ববিপ্লব, লেনিনের মতো, আর নিজের জীবনটাতেও বিপ্লব হলো না, আমি টের পাই দিব্যর গলাটা বহু বহু দিন পর একটু ধরে এসেছে, কিন্তু সে চট করে বুঝতে পেরে, একটু কেশে নিয়ে, ফের স্বাভাবিক গলায় বলে, দে তোর নাতিকে ফোনটা দে, একটু কথা বলি, আমি পাভেলকে দিয়ে বলি, তোমার দিব্যদাদু কথা বলবে, পাভেল ফোন নিয়েই বলে, আরে বলো না, দাদু বলে কী জানো, তুমিই নাকি আমাকে কমিউনিস্ট বানিয়ে দিচ্ছো, যার কোনো ভবিষ্যত নেই; ওপার থেকে দিব্য কিছু একটা বললে, পাভেল হো হো করে হেসে ওঠে, ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস থেকে আমার ছেলে ফরহাদ তার ছেলের নাম রেখেছে পাভেল, আমি পাভেলকে দেখতে দেখতে বুঝতে পারি না, আমার মধ্যে আসলে কী কাজ করছে বা করছে না।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সম্মানজনক এ পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করেছে। তার দারুণ কাব্যময় গদ্যের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যা ঐতিহাসিক ক্ষতগুলোকে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে প্রকাশ করে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক সাহিত্যিক হান কাং।
হান কাংয়ের প্রথম ইংরেজি উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' সম্পর্কে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচক ড্যানিয়েল হ্যান মন্তব্য করেছেন, বইটির তিন খণ্ড জুড়ে সমাজের সবচেয়ে অপরিবর্তনশীল কয়েকটি কাঠামোর অসহনীয় চাপ পাঠকমনকে বিচলিত করে তোলে। এই উপাদানগুলো হল চাহিদা ও আচরণ এবং প্রতিষ্ঠানগত কর্মপদ্ধতি, যা একে একে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়।
২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার প্রাইজ পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার এই লেখক । উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান'র জন্য তাকে এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়।
হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার শহর গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে সিউলে চলে আসেন। হ্যান ক্যাং একটি সাহিত্যিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার বাবা একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। তিনি লেখার পাশাপাশি শিল্প ও সঙ্গীতেও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
বোধহয় বৈরি সময়ে উর্বর মস্তিষ্কে চিন্তারা বেশি করে ভিড় করে। মৌলিক প্রতিভা সে চিন্তাকে ঘনীভূত করে জমাট বাধায়, উপহার দেয় চিন্তা বা কল্পনা করতে না পারা মানুষদের জন্য অভিনব কিছু। সাহিত্যে কবিতার যে শক্তি তা কম কবির লেখনিতেই মূর্ত হয়েছে কালেভদ্রে। কিন্তু মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে ধারণ করে যে শব্দের সমষ্টি অজস্র পীড়িতের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই তো সার্থক কবিতা। আর তার নির্মাতাই হয়ে উঠেন সার্থক কবি।
কবিতার এই যে মানদণ্ড তাতে একজন হেলাল হাফিজ অনেক আগেই উত্তীর্ণ। ৭ অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবির জন্মদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য! দুঃখকে নিত্যসহচর করে বেঁচে থাকা অধিকাংশ কবিদের অমোঘ নিয়তি হেলাল হাফিজকেও ছাড়েনি। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোণায় জন্ম নেওয়া কবিতার এই বরপুত্র নব্যঔপনিবেশিক শাসকদের রোষানল দেখেছেন। দেখেছেন মুক্তির আকাঙ্খায় উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির ব্যগ্রতা।
যৌবনের উদ্দাম দিনে দ্রোহ ও প্রেম-দুই-ই পেয়ে বসেছিল হেলাল হাফিজকে। তাকে অবলম্বন করতেও ছাড়েননি তিনি! সহজ কথায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সবার কথাকে, তাইতো তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁর সমকালীনতাকে। অন্তত ৫ দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে কবিতার এই বরপুত্র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছেন। এই সময়েও তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য ম্লান হয়নি এতটুকুও! এখানেই তাঁর সার্থকতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলা সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত এক বন্ধ্যা সময়েও মুগ্ধ পাঠকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে হেলাল হাফিজের শব্দগাঁথা, যা তিনি জীবন অভিজ্ঞতা ও সঞ্চিত বিশ্বাসে ভর করে লিখেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের তপ্ত আবহের মাঝে। ‘এখন যৌবন যার জুদ্ধে যখন তার শ্রেষ্ঠ সময়’-কবি হেলাল হাফিজের শক্তিশালী শব্দমালা এখনও পথে-প্রান্তরে দেয়ালে উৎকীর্ণ, হয়তবা এই পঙতির চিরকালীন আবেদনময়তার জন্যই।
‘যে জলে আগুন জলে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে দ্রোহ ও প্রেমের যে আখ্যান কবি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক দশক পরে এখনও পাঠককে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে বললেও অত্যুক্তি হবে-বলা প্রয়োজন আন্দোলিত করে।
২০১৩ সালে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবিকে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১৯ সালে কবি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘বেদনাকে বলেছি কোঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ। সঙ্গীহীন ব্যক্তিগত জীবনে কল্পনালোকে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন কবি।
তবে ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে যে প্রবল শক্তি নিয়ে একজন হেলাল হাফিজ আবির্ভূত হয়েছিলেন তার সামান্যই হয়ত নিতে পেরেছি আমরা। কবিতার শক্তি যে সত্যসুন্দরের আহ্বান নিয়তই জানিয়ে যায় এই সমাজ হয়ত তাকে সর্বাঙ্গীন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়।
তা সত্ত্বেও সত্যসুন্দরের দীপশিখা জ্বেলে যান কবি হেলাল হাফিজ। শুভ জন্মদিন কবি।
বীর সাঈদ
মোঃ আলাউদ্দীন ভুইয়া
সাঈদ ছিল গুণী, এই পুলিশ যেন খুনি,
টের পাইনি সাঈদ বাবা।
সরলতার সুজোগে, দানবের মত হুজুগে,
তাঁজা বুকে মারলি থাবা।
হে ঘাতক চিনলে না-সাইদ কে,
অন্যরা কারা।
আকাশ ছুঁয়ে গুলি মেরে দিতে
করে কারা!
প্রশ্ন; বল, বল, বল ওরে ঘাতকের দল,
শত শত সংসার করে দিলে-অচল।
বুঝে, না বুঝে চালিয়েছ-বন্ধুকের নল।
আমাদের দেশ, করে দিলে শেষ,
অন্ধকারে তল।
এখন বুঝি, হত্যা ছিল তোমাদের পুঁজি,
তোমরা তো হার মানিয়েছ ব্রিটিশের যোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ ক্যান্সার রোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ পাকের ডান্ডা।
সব শেষে পেলে শুধু ঘোড়ার আন্ডা।
হে; প্রভু তোমার কাছে ফরিয়াদ,
না, ছিল ছাত্র জনতার অপরাধ,
শুধু হকের উপর ছিল প্রতিবাদ,
ওরে তার পাপের ছিল এত ভার।
হেলমেট খুলে গেল ইশারায় বিধাতার,
মুহুর্তে ভেসে গেল দানবের ছায়া,
ছেলের মত দেখেও, ঘাতকের হল না যে মায়া,
ঘাতক তোমার নামের মাঝে করি শুধু-বমি,
দোয়া, সাঈদ না ফেরার দেশে সুখে থাক তুমি।
কিছু না বোঝার আগে বুকে নিলে-তীর।
আজ তুমি হয়ে উঠেছ বাংলার বীর।
আজিম রাস্তায় হাঁটছে। কিন্তু চমকে যাচ্ছে বারবার। এ কোথায় এলো সে! আজিম ছাড়া সবার মাথায় হেলমেট। অথচ রাস্তার কোথাও কোনো মোটর সাইকেল নেই। হেলমেট পড়ে যে মারামারি করছে তাও না। প্রতিটা মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। অথচ মাথায় হেলমেট! কেবল আজিমের মাথায় কিছু নেই। হেলমেটের কারণে মুখের কিছুই দেখা যায় না। হেলমেটের সামনে অংশ কালো গ্লাস দিয়ে ঢাকা। হেলমেটের মানুষ হাঁটছে। ওই অবস্থাতেই কথা বলছে একে অপরের সাথে। কী অদ্ভুত। একটা বাস গেলো। বাসের যাত্রীদের সবার মাথায় হেলমেট। একেবারে মুখ ঢাকা।
আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কোথায় এলো সে!
‘আজিম সাহেব?’
কে যেন ডাক দিলো।
‘কে, কে?’
চমকে উঠলো আজিম।
‘এই যে আপনার পেছনে।’
আজিম হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। একটা লাল হেলমেট পরা মানুষ।
‘কে আপনি? আপনাকে চিনছি না তো। হেলমেট পরে আছেন কেন?’
হেলমেটের মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটা হাসছে।
‘আপনিও পরবেন। সমস্যা নাই।’
‘দেখুন, হেলমেট না খুললে আমি কথা শুনব না। আপনাকে না দেখে তো আমি কথা বলছি না।’ আজিম রেগেই গেলো এবার।
লোকটা হেলমেট খুললো। আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কি দেখছে সে!
লোকটার মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। চোখ নেই, নাক নেই। শুধু ঠোঁট, দাঁত আর জিহবা আছে। দাঁত দেখিয়ে হাসছে লোকটা।
লোকটার হাসি দেখে আশেপাশে আরো কয়েকজন হেলমেট মানব এলো। ওরাও দাঁড়ালো। আজিম খেয়াল করলো, সবাই গোল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট খুলে ওরাও হাসছে জোরে জোরে।
ওদেরও সবার মাথা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। এদেরও চোখ নেই, নাক নেই। দাঁত বের করে হাসছে আজিমের দিকে তাকিয়ে। যেন আজিম একটা কৌতুক।
একটা ঝাঁকুনি দিলো শরীরটা। মনে হলো হোঁচট খেলো। এতেই ঘুমটা ভাঙলো আজিমের। বিরক্ত মুখে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটায় সময় দেখলো। রাত ৪টা ২৯ মিনিট। কোনো মানে হয়? প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এই গভীর রাতে। স্বপ্নটা আবারো হানা দিয়েছে আজিমের চোখে। সেই একই স্বপ্ন। গরমে ঘেমে গেঞ্জি আর বিছানার চাদর এক হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মগবাজারে আজিম যে বিল্ডিংটায় থাকে সেটা আটতলা। আজিম থাকে টপ ফ্লোরে। মাথার ওপরে ছাদ। আর ছাদ দিনভর সূর্যে তেতে থাকে। ফ্যানে আপাতত ঠাণ্ডা মেলে কিন্তু শরীরতো বিদ্রোহ করে।
তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট বাসাটায় আজিম একটা রুমে থাকে। অন্য দুই রুমে থাকে সাদেক ও আফজাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হলে দুইজনই ছিল আজিমের রুমমেট। সাদেক এখন ব্যাংকার আর আফজাল কাজ করে ওষুধ কোম্পানিতে। পাস করে বের হওয়ার পর বাসাও একটা নেয়া একসাথে। সেই সাথে ডাইনিং রুমের জন্য একটা ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ আর কম দামের একটা সোফা সেট। ব্যাচেলর হলেও বাসাটাকে একটা পরিবারের স্পর্শে রাখা।
আজিম সাংবাদিক। সবচেয়ে দেরি করে বাসায় ফেরা লোক। রাত ১২টায় অফিস থেকেই বের হয়। বাসায় ফিরে বিছানায় যেতে যেতে রাত ১টার মত বেজে যায়। এরপরও যদি রাত ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তাহলে মন ও মেজাজ কিছুই ভালো থাকার কথা না। এর ওপর বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে এসেছে এক স্বপ্ন। সেটা দু:স্বপ্ন না ভালো কিছু সেটাই বুঝতে পারছে না আজিম। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বিছানার পাশে রাখা স্টিলের গ্লাসটা শেষ করেও কাজ হলো না। ডাইনিং এ যেতেই হবে। এক বিন্দুও ইচ্ছা করছে না আজিমের। বাড়ি গেলে বিছানার পাশে বিশাল পানির বোতলটা রেখে দিয়ে যেতেন আজিমের বাবা, সিদ্দিকুর রহমান। সাথে একটা গ্লাস। রাতে যেনো রুম থেকে বের হওয়া না লাগে। রুমের দরজা লক করে না আজিম। ভোরের দিকে টের পেতো আজিমের গায়ে চাদর। কখন সিদ্দিকুর রহমান এসে চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দিয়ে গেছে টেরেই পায়নি সে।
রুমের দরজা খুলেই দেখে ডাইনিং রুমের বাতি জ্বালানো। ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছেন সিদ্দিকুর রহমান!
আজিম অবাক হলো।
‘বাবা, আপনি কখন এলেন?’
পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া সিদ্দিকুর রহমানের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমাটা হাতে নিয়ে ফ্রেমের কাঁচটা পাঞ্জাবির কাপড়ে পরিস্কার করলেন। এটা সিদ্দিকুর রহমানের অনেক পুরানো অভ্যাস।
‘তোমার এখানে আসতে আসতে রাত ৯টা বেজে গেলো। তুমি অফিসের কাজে এই সময় ব্যস্ত থাকো, সেটা আমি জানি। তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি।’
‘কী বলেন? আপনি এসেছেন, আমাকে বলবেন না? এতক্ষণ ধরে এখানে? খেয়েছেন? বাসায় আসার পরও ডাকেননি কেন?’
আজিম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সিদ্দিকুর রহমান রুটিন মেনে চলা লোক। খেয়েছেন কিনা ঠিক মত, না ঘুমিয়ে এখানে বসে থাকা?
‘আরে তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না। এখানে বসো। আমি ঠিক আছি?’ সিদ্দিকুর রহমান হেসে বললেন।
‘আচ্ছা তোমার লেখা মনে হচ্ছে কম আসছে। কারণ কী?’
আজিম হাসলো।
‘বাবা, ইদানিং ডেস্ক সামলাতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার সময় কম পাচ্ছি। তাই রিপোর্ট লেখার সময় কম মিলছে।’
‘এটা কী করে হয়। তুমি এত ভালো রিপোর্ট করো আর তোমাকে ডেস্কে বসিয়ে দিলো! এডিটর জানে না তোমার রিপোর্ট ভালো হয়?’
‘জানেন বাবা। তারপরও উনার মনে হয়েছে ডেস্কেও যদি সময় দেই তাহলে ভালো হয়। আর ইচ্ছে করলেই বাইরে গিয়ে স্পেশাল রিপোর্ট করতে পারি। তাতে এডিটরের কোনো না নেই।’
‘হুম। আর তুমি বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছো!’
আজিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নেয় তখন সিদ্দিকুর রহমান বেশ খুশি হয়েছিলেন। আজিমের মনে আছে ছোট বেলায় ওদের বাসায় দুটো পত্রিকা দিয়ে যেতো হকার। ইত্তেফাক আর অবজারভার। বইয়ের চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল আজিমের ওই দুই পত্রিকা। খেলার খবর, কত ছবি, কত শব্দ, কত কত বাক্য। পাস করে বের হওয়ার পরই একটা পত্রিকায় চাকরি হয়ে যায় আজিমের। সিদ্দিকুর রহমানের খুশি ধরে রাখে কে! ছেলের নামে যেদিন রিপোর্ট ছাপা হয় নিজে সেদিন বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের বাসায় পত্রিকা নিয়ে দিয়ে আসেন। ছোট্ট শহরে ছেলেকে বিখ্যাত বানিয়ে তুলতে সিদ্দিকুর রহমানের উৎসাহের কমতি নেই।
‘আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?’ আজিম পানি দিল তাঁর বাবাকে।
‘হ্যাঁ, তোমার বন্ধুরা বেশ খাইয়েছে। খেয়েই তো ড্রইংরুমে হেলান দিয়েছিলাম। তাতেই ঘুম।’
‘ঘুম ভাঙার পর আমার রুমে যেতেন। এখানে বসে ছিলেন কষ্ট করে।’
‘তুমি খুব ক্লান্ত থাকো। বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই চলে এলাম।’
‘ভালো করেছেন। কখন রওনা দিলেন?’
‘রওনা দেয়ার কথা সকালেই। কিন্তু দেরি হয়ে গেলো। প্রচণ্ড রোদ আর গরম মাথায় নিয়ে বের হলাম। বাসে উঠার পর বৃষ্টি। বাস থেকে নামার পর আবার গরম।’
বাইরে তাকালো আজিম। বিজলির চমক দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে দ্রুত।
‘এক কাজ করো। চা বানাও। তোমার জন্যও বানিও। চা খেতে খেতে গল্প করি।’
রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নিজের রুমের আর ড্রইংরুমের জানালার গ্লাস টেনে দিলো আজিম। বৃষ্টিতে ঘর ভিজে যায়। ওদিকে ডাইনিংয়ে জানালার পাশেই বসেছেন সিদ্দিকুর। বাতাসে তাঁর পাতলা চুল উড়ছে। ৭০ এর বেশি বয়স হলেও চুলে কালো রং দেন তিনি। আজিম ভাবে, বাবাকে সাদা চুলে কখনোই ভালো লাগবে না।
‘জানালাটা লাগিয়ে দিব?’
‘না, থাক। তুমি চায়ের ব্যবস্থা করো।’
আজিম রান্নাঘরে যায়। বাবার জন্য চা বানানোটা সহজ। পানি গরম করলেই হয়। কাপে একটা টি প্যাক। আর কিছু না। আজিমও এভাবেই চা খায়। তবে চায়ে তার নেশা নেই।
চায়ে চুমুক দিলেন সিদ্দিকুর রহমান।
‘চায়ের সাথে কিছু খাবেন? মুড়ি আছে।’
‘না, তুমি বসো। দেশের কী অবস্থা?’
পত্রিকা সরিয়ে এক পাশে ভাঁজ করে রাখলেন সিদ্দিকুর।
‘আমি সাংবাদিক বলে আমার কাছে দেশের খবর সব থাকবে?’
আজিম ইচ্ছে করেই ওভাবে বললো।
‘অবশ্যই। তুমি দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছো। কাজ করছ খবর নিয়ে। মানুষ তোমার কাছেই তো খবর জানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।’
আজিম ভাবতে থাকে। এর কী উত্তর হতে পারে? আসলেই কি আজিম খবরের সাগরে ভেসে বেড়ায়? মানুষ চাইলেই কলসিতে করে বা বোতলে করে চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়? কাগজের দাম বাড়ছে। মানুষ বাসায় পত্রিকা রাখা কমিয়ে দিচ্ছে। এখন অনলাইনের সময়। চাইলেই পকেটে থাকা ফোনেই খবর পড়ে নেওয়া যায়। আগে সারাদিন কাজ করে একটা সংবাদপত্র প্রকাশ হতো। এখন ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চলে এসেছে। যা মিনিটে মিনিটে খবর সাপ্লাই দেয়। তাতে তো কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। খুশি হওয়ার কথা। মুহিত সেদিন লিখেছে, ওজন কমানোর পাঁচ উপায়। সেটা সেদিন সবচেয়ে বেশি পঠিত সংবাদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এডিটর পর্যন্ত বাহবা দিয়েছে ওকে। আমেরিকার নির্বাচন, ইউরোপের বাজারের খবর পর্যন্ত এখন মিনিটে মিনিটে আপডেট করা যায় দেশে বসে। কিন্তু, যমুনায় ভেসে যাওয়া গ্রামের স্কুলটার আপডেট কী? কবে আবার স্কুলটা চালু হবে সেই খবরটা মেলে না এত এত অনলাইনে। কাগজে আরো মেলে না। এখন কাগজের অনেক দাম।
‘থাক, দেশের অবস্থা বলতে হবে না। তোমার অবস্থা বলো। লেখাটা চালু রেখো। ছেড়ে দিও না। রিপোর্ট না লিখতে পারো এখন, কলাম লিখবে। তুমি কলামও ভালো লিখতে পারো।’
‘কলেজে পড়ার সময় ডিরোজিও কে নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। আপনার মনে আছে?’
`হ্যাঁ। ডিরোজিওর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলে। আমাদের শহরের সাপ্তাহিক পত্রিকাটায় ছাপা হয়েছিল সেটা। বেশ মনে আছে।’
‘এসএসসি পরীক্ষার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় বইটি কিনে দিয়েছিলেন আপনি। এক উপন্যাসে কত চরিত্র, কত ইতিহাস। কত কত নায়ক।’
‘তোমার ওই লেখা ছাপানোর কয়েক দিন পর ওই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আমার দেখা। আমাকে বলে, স্যার লেখাটা আপনার ছেলেই লিখেছে নাকি আপনি সাহায্য করেছেন? দিয়েছিলাম ধমক। ও নিজেই লিখেছে।’
‘তাই নাকি। এ কথা তো বলেননি কোনো দিন?’ আজিম অবাক হয়।
‘ওতটুকু বয়সে তোমাকে ওই কথা বললে তোমার কনফিডেন্স কমে যেতো। আমার মনে আছে, উপন্যাসটা পড়ে তুমি ডিরোজিওর ওপর আরো দুইটা বই পড়ে ফেলেছিলে।’
আজিম চায়ে চুমুক দেয়।
আজিম ভাবছে, সে বাসায় এলো। তার বাবাকে চোখে পড়লো না কেন? এসেই অবশ্য নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। গোসল করেই ঘুম দেয়। অফিসেই রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলে আজিম। ছোটবেলায় রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার শুরু করতে হতো। সিদ্দিকুর রহমানের কড়া নির্দেশ। রাত আটটায় বিটিভির বাংলা সংবাদ শুরু। সেটা দেখে তারপর খাওয়া। আর ১০টার দিকে ঘুম। আজিম হলেও রাত আটটার দিকে খেয়ে ফেলতো। অভ্যাসটা এখনো আছে।
বাবা তো ওর ঘরেও শুয়ে থাকতে পারতো। আজিম আসলে কিছু মেলাতে পারছে না।
‘আমি বাসায় আসার পর আমাকে ডাকলেন না কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?’ আজিম এবার প্রশ্নই করে।
‘আরে ওদের সাথে খেয়ে ড্রইংরুমেই সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। কখন যে ঘুম এসে গেলো টের পাইনি। বাতিটাও নেভানো ছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি।’
এটা ঠিক। আজিম নি:শব্দে বাসায় ঢুকে। না পারতে ড্রইং বা ডাইনিংয়ের বাতি জ্বালায় না। এমনিতেই দেরি করে বাসায় আসে। এর ওপরে রাতে শব্দ করাটা আসলেও অন্য দুইজনের ওপর অন্যায়।
‘তুমি কেমন আছো সেটা বললে না কিন্তু।’ সিদ্দিকুর চশমার কাঁচ মুছলেন।
‘এইতো বাবা। চলছে।’
‘না। সামথিং রং। আমাকে বলো।’ সিদ্দিকুর ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘তেমন কোনো সমস্যা না।’
‘তাহলে যে স্বপ্নটা দেখছো, ঘুম ভাঙছে রাতবিরাতে সেটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না?’
‘বলেন কী? আমার এ কথা আপনি জানলেন কী করে?’ আজিম অবাক হয়। সাদেক বা আফজালের কেউ বলবে। এরা যে কী?
‘আমাকে বলো।’
আজিম পানি খেলো। সিদ্দিকুর এমনিতেই তাকে নিয়ে টেনশন করেন। এসব স্বপ্ন টপ্নের কথা বলে তাঁকে চিন্তায় ফেলার ইচ্ছা ছিল না আজিমের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাবাকে বললেই একটা সুরাহা মিলবে।
‘বিষয়টা তোমাকে নিয়ে হেলমেট মানবেরা হাসাহাসি করে ওই পর্যন্তই? নাকি আরো কিছু দেখো?’ সিদ্দিকুর জানতে চাইলেন।
‘মাঝে মাঝে একটু বেশিও দেখি। হঠাৎ এক হেলমেট মানব দৌড়ে আসতে থাকে। হাতে বড় একটা লাঠি। এটা দিয়ে সে আমার মাথায় জোরে আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি মাটিতে বসে পড়ি। লাঠির আঘাতে আমার মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যায়। বেরিয়ে যায় মগজ, রক্তে মুখটা ভরে যায়। আর….’
‘আর কী?’ সিদ্দিকুর মন দিয়ে শুনছেন।
‘মাথাটা ফেটে যাওয়ার সাথে সাথেই মাথাটা থেকেই কতগুলো বর্ণ, শব্দ দৌড়ে বের হয়ে গেলো! ঠিক যেমন কোনো বস্তা বা ব্যাগে আটকা ইঁদুর ছাড়া পেলে যেভাবে দৌড় দেয়, ঠিক সেই রকম।’
‘বর্ণগুলো বা শব্দগুলো কীসের?’
‘জানি না। আমি খেয়াল করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এরপরই ঘটে আরেকটা ঘটনা। একজন হেলমেট মানব একটা সংবাদপত্র নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসতে থাকে। আরেকজন হেলমেট মানব একটা হেলমেট নিয়ে আসতে থাকে। আমার মগজবিহীন রক্তাক্ত মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে দিতে থাকে। এমনকি চোখটাও ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকার হয়ে আসে সবকিছু।’
আজিম ঘামতে থাকে। শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। টেবিলে মাথা ফেলে দুই হাত দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা অসম্ভব যন্ত্রনা করে বাবা।’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছো কী রক্ষা করা দরকার? ওই শব্দগুলো বেঁচে থাকুক, বর্ণগুলোও।’
‘এই আজিম। আজিম। উঠ। কীরে কী হলো তোর?’ সাদেক ডাকছে।
আজিম মাথা তুলে তাকালো, চোখে বিস্তর ঘুম।
‘কীরে, ডাইনিং টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন?’ সাদেক অবাক হলো।
আজিম মাথাটা তুলে এদিক ওদিক তাকালো। সকালের রোদ এসে পড়েছে টেবিলে। গরমে ঘেমে গেছে আজিমের শরীর।
‘উঠে রুমে যা। রুমে গিয়ে ঘুমা। কখন এসেছিস এখানে?’
আজিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো।
‘কীরে কিছু খুঁজছিস?’ সাদেকের প্রশ্ন। আফজালও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
বাসায় আর কেউ নেই। আজিম বুঝতে পেরে আর কিছু বললো না।
‘আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই। মুখ ধুয়ে আসছি। নাস্তা করব তোদের সাথে।’
‘আজিম, তুই বাড়ি যাবি কবে? ভাবছি ছুটি পেলে তোর সাথে যাব। কাকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তোর সাথে না হয় থাকলাম দিনটা।’ আফজাল বলে।
‘তাই তো। কবে যেন আজিম?’ সাদেক বলে।
‘আগামী সপ্তাহে। ১৭ তারিখ। বাবার মৃত্যুর এক বছর হবে।’ আজিম খেয়াল করলো টেবিলে দুই কাপ চা। একটা শেষ হয়েছে। আরেকটাতে কেউ চুমুক দেয়নি।
পরিশিষ্ট
দুপুরে অফিসে যাচ্ছে আজিম। মেট্রোরেলের গেটের নিচে এক ভবঘুরে লোক বসা। এই গরমে তার গায়ে চাদর। দুই পাশে পুরানো ছেঁড়া কম্বল। এ ধরণের ভবঘুরে ঢাকা শহরে অনেক। তারপরও আজিম দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মাথায় হেলমেট। এমন হতদরিদ্র, ভবঘুরে লোকটার মাথায় লাল একটা হেলমেট। যার সামনের দিকটা কালো গ্লাসে ঢাকা!
‘ভাই, ওরে কী দেখেন। পাগল। ওভারব্রিজ নাইলে মেট্রোরেলের গেটের কাছে বইসা থাকে হেলমেট পইরা, চাদর গা দিয়া। এখন দেখি এখানে বইসা পড়সে। কবে উঠব কে জানে।’
সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার বলছিল আজিমকে এসব কথা।
হঠাৎ করে ভবঘুরেটা হেলমেটের গ্লাসটা উপরের দিকে তুললো। আজিমের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।
আজিমের দিকেই তাকিয়ে বললো, ‘কীরে, হেলমেট পড়বি?’