কুচিকুচি করেই কেটে ফ্যালো স্মৃতিগুলো
অসুস্থ লাগছে খুব
অসুস্থ লাগছে খুব, হাতে কাজ বহু বাকি
তবু করতে ইচ্ছে করছে না কিছু
মনে হচ্ছে কোনো কিছু করবার কোনো মানে আছে?
দেখা যাচ্ছে ওরা প্রায় তিন দিন না খেয়েই আছে;
পরিবারের প্রধান যিনি, অর্থাৎ বাবা,
সহজ সমাধান দিয়েছেন সবটারই, বলেছেন—
কোনো সমস্যা আছে যদি পুরোটাকে
রোজাই ধরে নিস তোরা, বোকা সন্তানেরা?
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও যে কী যে ফাজলামো পারে!
তারা হড়বড় বলে দিল এইবার নতুন পঞ্চাশ কোটি লোকে
নিঃস্ব হয়ে যাবে—সোজা বাংলায় গরীব যাকে বলে;
উদাহরণ হিসেবে বহু ড্যাটা বহু গ্রাফট্রাফ ইত্যাদি দিয়ে
বাংলাদেশি এক শাহিদা খাতুনের নাম
ছাপিয়েছে তারা, যে তার স্বামীসহ চাকরি হারিয়েছে;
তার ভয় তার ছেলের ভালো স্কুলে পড়া
এইবার বন্ধ হয়ে যাবে এবং সে বাজে কোনো স্কুলে পড়ে
আপনাদের জন্য ভ্যানগাড়ি
ঠেলবে একদিন শরীর যথেষ্ট ঘামে ভরে।
এই ভয় যেইমাত্র উচ্চারিত হলো,
“চুপ করে থাকো”—এরকমই চিৎকার দিল কিছু সাদা পোশাক পরা লোকে;
তাদের দেখতে লাগছে দেখি নভোচারীদের মতো
আর তারা ট্রে ঠেলে দিল সামনে গর্তের দিকে।
আমি বললাম—হেই হেই, এই ট্রে ঠেলে দেবার মতো কাজটাকে
মানুষের দাফন বলে দিচ্ছেন এইরকম গা-ছাড়া এক ভাবে?
এটা বলতেই পাখিগুলো অশান্ত হলো বড়
ঝড় উঠল বেশ গাছে গাছে
কারণ তারা চেঁচামেচি করল খুবই বেশি,
দেখলাম কপারস্মিথ বারবেট বলে ডাকে যে পাখিটাকে,
সে প্লেনের মতো উড়ে এসে ল্যান্ড করল উঁচু আমগাছে;
স্টুপিড পাখি। তার ক্র্যাশ ল্যান্ডিং হলো—
রক্তারক্তি অবস্থা এমনই চতুর্দিকে।
আর আমাদের বিড়াল, মার্সেল প্রুস্ত যার নাম,
সে মৃত বারবেটটাকে ঝট করে এক ঝলক দেখে নিয়ে
নখ বের করে বসল দু পায়ের প্যাডের মাঝ থেকে।
শাহিদা খাতুনের কথা শুনে ওই বিড়ালটাকে আমি
‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলেছিলাম এই কিছু আগে,
বলেছিলাম—
তোকে ধরে দিয়ে দেব ওই নভোচারীদের কাছে,
মনে রাখিস সবকিছু ওরা স্রেফ গর্তে পুঁতে দেয়
ট্রেগুলো ভেতরে তেলের মতো করে ঢেলে দিয়ে।
এসব হুমকিতেও কাজ হলো না কোনো
পৃথিবীর হিসাব পাল্টে যাচ্ছে এত ক্ষিপ্রতার সাথে।
যে কলিগ মারা গেছে তিন দিন আগে
তার স্ত্রী আমাকে বলেছেন নিজে থেকে—
স্রেফ ফুসফুসে একটা সিটি স্ক্যান যদি করা হতো
তাহলে হয়তো গল্প যেত ভালো দিকে।
আমি তাকে বলিনি যে, ওরকম কত স্রেফই তো আছে—
স্রেফ একটা দরজা খুললেই রত্নরাজি পাওয়া যাবে
(এরকমই ধর্মগ্রন্থে বলা কথা),
স্রেফ একটা ভালো ঘরে জন্ম নিলে গরীব থাকা লাগত না কারো
(এরকমই অর্থনীতির তত্ত্ব বলে থাকে),
স্রেফ কাঁটাদের খেলা
ধরে ফেলতে পারলে সবটাই ফুল হয়ে যেত
(এমনই গোলাপচাষীরা বলে থাকে)—ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে আমার মনে-মনের সব কথা
যারা শোনার তারা রিলিফের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শুনল ভালোভাবে,
বলল যে এই রোগটা এসে ধনী-গরীব বৈষম্য যা আছে
তা মুছে দিয়েছে বলা হচ্ছে খুবই,
বলা হচ্ছে তোমার যা হবে তা দ্যাখো প্রিন্স চার্লসেরও হয়েছিল—
এমন যে প্রিন্স চার্লস যে চিকিৎসা পেয়েছিল তা যেন শাহিদা খাতুনেরাও পাবে!
তা বেশ বোঝা যাচ্ছে তুমি যুদ্ধে গিয়েছিলে খোকা!
গালফ-ওয়ার সিনড্রোমে আছ তবে?
শুরুতে বলছিলে অসুস্থ লাগছে খুবই?
শুরুতে বলছিলে হাতে কাজ বহু বাকি আছে?
বমি হচ্ছে কি আজও?
—তোমার শিক্ষা ও বাকরীতি যেটা (অ্যাকসেন্ট সহ),
আমরা তার প্রশংসা করি, আসো,
খালি পেটে।
বুলবুলিগুলো
তাহলে এভাবেই জীবন কি চলে যাবে নাকি?—
মা বললেন, আকাশ এই যে সাফ হয়ে গেল,
ঘোলাটে আর সে দেখো হবে না কোনোদিনও।
ওই আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম খুব, ডাকলাম—‘টমি’,
টমি নামের কোনো কুকুর নিশ্চয়ই আশেপাশে ছিল।
সে সময় চোখে পড়ল বুলবুলিগুলো—
তারা প্রশস্ত জানালার ধারে কত কী প্রকার হাওয়া দ্যাখে চুপচাপ করে,
রাস্তায় দেওয়া হচ্ছে যে চুন, তার থেকে গন্ধ ভেসে আসে,
আর তারা আশা ও ভরসার সাথে ওই ডানা নিয়ে ভাসে।
মা বলেন, এই সরকারে বিশ্বাস নেই
তো পাখিদের ’পরে বিশ্বাস কেমন করে থাকে?
আমি দেখি ভার্সিটিতে পড়ার সময়ের যে মেয়ে
সে এক হাতে জানালা ভয়ে বন্ধ করে দিতে দিতে
বলে ওঠে, হাই, ভালো আছো তুমি?
তখন তার অন্য হাত দেখি ধরা আমার হাতে
আর জানালা, ভস্মীভূত, ছাইমাখা, বন্ধ হবে হবে—
না হয়ে উপায় কী আছে?
বুঝলাম মেয়েটা তো ভালোই তো বড় হয়ে গেছে,
বুলবুলিগুলো আসলে তো তাদের বাগানেরই,
আর টমি তাদেরই এক মারা যাওয়া কুকুরের নাম,
—আহা! তার চুলও তো দৈর্ঘ্যে বেশ বড়!
এরকম কি ছিল আগে, এরকম কি ছিল?
রাস্তায় ক্লোরিন জমে যে রকম সব ঘোলা হয়ে গেছে,
তার চুল, গাদাগাদা, ঝরবে সেইখানে?
তারপরও সেই মেয়ে আমার পেছনেই চলে আসে,
হয়তো ভালোবেসে, হয়তো বলতে যে, এত তেতে উঠছো কেন?
পৃথিবীতে কী হয়েছে সত্যি বলো শুনি?
মা এই কথা শুনে বললেন, ওরা সবকিছুতে শর্ট টার্ম লং টার্ম বলে কেন?
আর ব্লাড টেস্টের নামে রক্ত তো বারবার নিচ্ছে ঝাঁপিয়ে এসে এসে,
তোমার বান্ধবীর বুলবুলিগুলোই ভালো, ওদের রক্তও কম, ওদের জীবনে...
এই অসমাপ্ত বাক্য সমাপ্ত হোক তাই আমি মেয়েটাকে
চিল্লিয়ে বলি—কুচিকুচি করেই কেটে ফ্যালো স্মৃতিগুলো
আর ভালো থেকো, যেরকম ছিলে ভার্সিটির দিনে,
এখন আকাশও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে কী পরিমাণে,
চাইলে এমনকি চিত্রা নক্ষত্র কি উত্তরফাল্গুনী
দেখবার পরিকল্পনা করে ফেলতে পারো।
এইটুকু বলে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধোয়া রাস্তার ’পরে
ঘুমিয়ে পড়েছি আমি বেশ,
মাথা থেকে তাড়াতেই পারছি না যে কী ছিল গতকালের কথা,
আকাশ কবে তবে ঘোলা ছিল কালিমাখানো মতো?
মেয়েটা বলল, কাটলে তরমুজের মতো ফালি ফালি করেই কাটা ভালো,
হাঙরের দাঁতের চেহারা এক কার্ভ কাল টিভিতে দেখিয়েছে,
দেখিয়েছে এই অসুখ আসবে আর যাবে,
ফিরে ফিরে ঘুরে ঘুরে ওই দাঁতের মতো, দেখোনি কি সেটা,
রিলিফ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলে নাকি?
আমি বুঝলাম সবকিছু আগের জীবনে তাহলে
ফিরে আসবে সামনেই তবে,
বাজারের দামবাড়াকমা তেজিমন্দি ইত্যাদির মতো,
শোনা যাবে হকারেরা মাঝেমাঝে চিৎকার দেবে খুব,
তারা বলবে ক্রমান্বয়ে এক রকম জোরে,
বলবে যে বার্মার পাশে এবং বেনাপোলে, হা-হা, নতুন ধরা পড়েছে বারোজন,
বাচ্চা তাই স্কুল থেকে যান যান ফেরত আনুন
এইমাত্র সেইখানে পৌঁছানো বাসে।
মেয়েটা অকাতরে মানুষের ‘লোলুপতা’ ‘লুব্ধদৃষ্টি’
ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে বলে দিল যা বলার ছিল,
টমির জন্য তার সব খুব খারাপ লাগছিল বুঝি,
সে বলল যে, এই ছোঁচা-লোভী এই গজবে-পড়া চোয়াড়ে পৃথিবী
চিরকাল এমন এমনই তাও বলে দিতে...
বাক্যও শেষ করল না সে কিম্বা ধরো অন্য কোনো মেয়ে,
আর যেহেতু আমাদের কমন কিছু স্মৃতি এই পৃথিবীতে আছে,
তাই দেখি বুলবুলিগুলো খুশি মনে চুপচাপ জানালার ধারে—
এমন না যে তারা মরে পড়ে আছে।
ঘোড়াগুলো, রোদ্দুর রায়
অজস্রবার দেখেছি সেলিব্রেশন
অজস্রবার ঘোড়া ছিঁড়ে চলে গেছে বেড়া, ভেঙেছে লাগাম—
হইচই এতটাই বেশি হয়েছিল, নিশ্চিত দেখেছো সেটা যে
কিভাবে বেলুন উড়ছিল,
কিভাবে তোপধ্বনি ও ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শিশু (কান্না অর্থে বলা হলো তার কথা);
কিভাবে মার্চপাস্ট, তালি, “সরে যান, সরে যান”-ও বলা হচ্ছিল, যদিও নম্র ও ভদ্রভাবে তবু;
আর ছিল পুলিশের বাঁশি
ছিল নবীন মহিলা পুলিশেরা, যারা বলছিল:
“সেলিব্রেশন হেতু সরকার এক রাত বসতে দিয়েছিল,
তাতেই তাঁবু গেড়ে বসে গেলে গাড়লেরা, আহা?” হাহা!
বার্তা যা ছিল তাতে আশাবাদই ছিল বেশি;
পুরাতন কথা, যেমন আমাদের পরস্পর আরো কথা বলতে হবে,
তাতেই সমাধান চলে আসতে বাধ্য দেখে নিও,
আর বুঝতে হবে একে অন্যের মানবতা
এবং মনুষ্যবিষয়ক সামাজিক কথা আর যা যা আছে।
এতটাই পুরোনো কথা যে সব কিছুটা ফাঁপাও লাগছিল,
তবু ক্ষতি নেই জরুরি যেহেতু ছিল কথাগুলো,
আর যে বলছিল সে বারবার যেহেতু এটাও বলছিল,
“আমার নিয়ত ভালো, মোটিভ যাকে বলো”—
তাই হাততালি, যেহেতু নিয়তের বিচারে দেশের ভালো চাওয়া হলো,
আর তাই তো হে অদৃষ্টবাদী হে অতীতচারী ভিড়,
তাইতো ভিড়ে হারিয়ে গেল শিশু,
আর ক্রেনের ওপর থেকে রঙ ছড়াতে গিয়ে ভুলে পাথর ছোড়া হলো।
তারপর মাইকে “সরি সরি”,
ইঙ্গিতে বলা হলো স্যাবোটাজ ছিল,
বলা হলো পাথর তো বহু ছুড়েছো শত্রুর দিকে,
আর নয়, এখানে বন্ধুপক্ষ সকলেই, মিত্র বলা ভালো,
অতএব এই যে পাথর, তা যান, স্যাবোটাজ নয়, ভুলে ছোড়া হয়েছিল।
এভাবে আশ্বস্ত হলো সকলেই, যদিও পরশ্রীকাতরতা সংক্রান্ত
কিছু সমস্যা হয়েছিল।
তারপরও ব্যাং-ব্যাং বাড়ি পড়ল দরজাতে
আর দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় মতামত গ্রহণসংক্রান্ত উপদেশ এসে গেল:
“শোনো তো অন্তত, মানো না মানো পরে ভেবে নিয়ো,
অন্তত তো শোনো”—এইসব এরকম ইত্যাদি,
যেন বা মন্ত্রী মহোদয়
যিনি আছেন সেলিব্রেশনের চিফ পজিশনে
যেন বা তিনি আজ সকালেই জীবনে প্রথম বুঝলেন
সকলকে চলতে হবে মিলেমিশে ভেদাভেদ ভুলে—
ভেদাভেদ বলতেই আবার পরশ্রীকাতরতা, ফের হট্টগোল,
“ধর ধর” চিৎকার উঠল কোনোদিকে;
আর মেয়ে পুলিশও বলল কীরকম করে: “ক্ষমা ঘেন্না করে দিয়ো ভাই।”
কেন? কেন করব তা? কেন তাবু তুলে নেব?
কোনো দায়িত্ব নেই কারো?
আর কী করে বলা হচ্ছে হারানো বাচ্চাগুলোই
সুঁই দিয়ে ফুটো করেছে বেলুনগুলো?
কোনো কিছুতেই এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?
তখনই অতি-নাটুকে ভুলভাল ইংরেজিতে
রোদ্দুর রায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে দিল:
“ন্যাকামি করছেন আপনারা
কথা বলছেন মনুষ্যতা নিয়ে [শব্দটা ভুল]
কিন্তু দেখাচ্ছেন যে কথা হচ্ছে মানবতা বিষয়ে,
আর ওইদিকে প্রথম দুই কথা আপনি ক’রে বলে
তারপর তুই তুই তুই তুই তুই?”
এই স্বপ্ন শেষে সেলিব্রেশনের ঘোড়াগুলো
নিতান্তই বোকা, স্বপ্নে তারা কেমন শেয়ালের মতো,
আর রোদ্দুর রায় তুমিও বাস্তবে তুই-তোকারি করেই কথা বলো;
...হাহ্, ঘোড়াগুলো—হ্রেষাধ্বনি নেই, সেলিব্রেশনের হেতু সাজানো যদিও,
তবু অবাস্তব বিজিলিজি ফুলেদের মতো রঙ,
রীতিমতো হুক্কাহুয়া কিম্বা গরু যেভাবে ডাকে—
বেড়ার ভেতরেই, তারা লাগামও টেনে ধরা, সেলিব্রেশনের টাট্টুঘোড়াগুলো।