স্মৃতিতে গল্পকার আফসার আমেদ
বহরমপুর( মুর্শিদাবাদ, ভারত) থেকে: তখন কলেজে পড়ি, বিশ বছর হয়েই গেল! হঠাৎ একটা কাজে কলকাতা যেতে হচ্ছে, সঙ্গী বলতে কেউ নেই, একাই জিয়াগঞ্জ থেকে ভাগীরথী এক্সপ্রেসে ট্রেনে উঠেছি।
তখন ট্রেনে আজকের দিনের মতো ঠাসাঠাসি ভিড়ও হতো না। খুব কম মানুষই রিজার্ভেশন নিয়ে যাতায়াত করতেন। যা হোক, সহযাত্রীদের অনেকেই বহরমপুর স্টেশনে নেমে গেলে কৌতুহল বসত আমি সামনের সিটে একটা রুমাল রেখে সিটটা ধরে রেখেছি, পাছে যদি কেউ পরিচিত জন ওঠে তো সিটটা দিতে পারব।
ট্রেন বহরমপুর কোর্ট স্টেশন ছাড়লে দেখি আমার সামনে একজন বছর চল্লিশের এক ভদ্রলোক কোন সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ইতস্ততঃ ভাবে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, "ভাই, এখানে বসতে পারি ?"
তড়িঘড়ি আমার কৃতকর্মের জন্য কিছুটা লজ্জিত হয়ে বললাম, "নিশ্চয়, বসুন ...বসুন। আমি এমনই সিটটা রেখেছিলাম যদি কেউ পরিচিত জন ওঠেন তাই। "
ভদ্রলোক মৃদু হেসে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না। অতঃপর আমাদের মধ্যে আলাপ শুরু হলো। কথায় কথায় ভদ্রলোক বললেন, "আমাকে চেনেন? উত্তরে বললাম, " না"।
উনি আমার উত্তর শুনে মোটেও আশ্চর্য হননি। বিনীত ভাবে আবার বললেন, "আমি গল্পকার আফসার আমেদ।"
কথাটা শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠল! কী বলেন আপনি? উনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপর সারা রাস্তা জুড়ে অনেক গল্প, আড্ডা, চা কফি ঝালমুড়ি সবই হল।
তিনি সাহিত্যসভার ডাকে বহরমপুর শহরে এসেছিলেন, এখন ফেরার পালা। খুব অমায়িক প্রানবন্ত মানুষ ছিলেন উনি।
কারুর উপকার করতে খুব আনন্দ পেতেন।
কলকাতার শিয়ালদা স্টেশনে নেমে যেতেই শিশুর মতো জড়িয়ে ধরে বললেন "তোমাকে খুব ভালো লেগেছে, যোগাযোগ রেখো "।
লক্ষ্য মানুষের ভিড়ে আর তাঁকে খুঁজে পাইনি, প্রায় দু'দশক পরে ফেসবুকে আবার আফসারদার সাথে বন্ধুত্ব হলো! সে বড় সুখের কথা। এ বছর (২০১৮) আফসার দার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি, আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন বদরুদ্দোজা হারুন সাহেব একদিন বললেন, "আফসার ভালো নেই, আমি খুব চিন্তিত।"
কিছুদিন পর আবার খবর এলো আফসারদা আরোগ্য লাভের পথে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। কথা ছিল সব কিছু ঠিক থাকলে ১লা সেপ্টম্বর পশ্চিবঙ্গ বাংলা একাডেমি হলের সাহিত্য আসরে উনি আসবেন, দীর্ঘ দু'দশক পরে আবার দেখা হবে প্রিয় মানুষটির সাথে।
কিন্ত দেখা আর হলো না! এটাই নিয়তি!
চলে গেলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আফসার আহমেদ। শনিবার (৫ আগস্ট) বিকেল পাঁচটায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যকৃতের সংক্রমণে ভুগছিলেন তিনি।
১৯৫৯ সালে হাওড়ার বাগনানে জন্মগ্রহণ করেন আফসার। দীর্ঘ সময় ধরে অসংখ্য গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। পেয়েছেন সমালোচকের স্বীকৃতি ও পাঠকের ভালোবাসা। কলম ধরেছেন ছোটদের জন্যও।
২০১৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও অন্যান্য পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি কলকাতার এক নার্সিং হোমে ভর্তি হন। তার পর অবশ্য সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু দিন দশেক আগে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পর তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবশেষে শনিবার (৫ আগস্ট) বিকেলে প্রয়াত হন বর্ষীয়ান সাহিত্যিক।
তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাংলার সাহিত্য জগতে।
হাসিবুর রহমান, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবেত্তা। নেতাজী ওপেন ইউনিভার্সিটির অতিথি অধ্যাপক।