কার্ল মার্ক্স: মৃত্যুর ১৩৭ বছর পর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কার্ল মার্ক্স

কার্ল মার্ক্স

১৪ মার্চ ১৮৮৩ সালে কার্ল মার্ক্স (জন্ম ৫ মে ১৮১৮ সাল) যখন মারা যান, তখন তার বয়স ৬৫ বছর। জীবনের পুরো সময়কে নিয়ে বৈপ্লবিক দর্শনচিন্তায় ব্যয় করেন। পণ্ডিতরা বলছেন, দার্শনিক রুশো, ভলতেয়ার, হলবাখ, লেসিং, হেইন অথবা হেগেলের গুণাবলি একত্রে দেখা গেছে মার্ক্সের মনীষায়।

কার্ল মার্ক্সের ব্যক্তিগত জীবন ও মতাদর্শ বহু উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিয়েছে। বিগত শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য কাল বিশ্বকে আলোড়িত করেছে তার মতবাদ। বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা ও অবলুপ্তির অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছে মার্ক্সের মতাদর্শ।

বিজ্ঞাপন

১৯৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় কমিউনিস্ট দেশগুলোর বিলুপ্তি নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাক্কা হলেও ৩০ বছরের মাথায় মার্ক্সবাদের পুনরাবৃত্তির কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। মার্ক্সের মৃত্যুর ১৩৭ বছরের দৃশ্যপটে নতুন আঙিকে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের অভিলাষে মার্ক্সীয় মতবাদের ধ্বনিও পুনরুচ্চারিত হচ্ছে।

কার্ল মার্ক্স তৎকালীন প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের নিম্ন রাইন প্রদেশের অন্তর্গত ট্রিয়ার নামক স্থানে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা হাইনরিশ মার্ক্স এমন এক বংশের লোক যে বংশের পূর্বপুরুষেরা ইহুদি ধর্মগুরু বা রাব্বি ছিলেন। তাদের পরিবারে ঈশ্বরবাদ এবং ইউরোপীয় আলোকময়তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

ছোটবেলায় কার্ল মার্ক্সের ডাকনাম ছিল 'মুর'। জীবনের জাগতিক ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন চরমভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু তারপরেও নিজের কাজে তিনি নিরলস শ্রম, নিষ্ঠা ও ত্যাগের সাক্ষর রেখেছেন।

জীবনদারিদ্র্যের কঠোর থাবায় মার্ক্সের স্ত্রী জেনি'র স্বপ্ন ও বাস্তবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পেশাগত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি তিন-তিনটি সন্তানের মৃত্যুর অসীম যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হয়েছেন তিনি। তবু সমাজ বদলের রূপকল্প প্রণয়নের চিন্তা ও প্রচেষ্টা থেকে তিনি বিন্দুমাত্র বিচ্যুৎ হননি। বরং দিয়ে গেছেন বহু ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা। বলেছেন, 'দার্শনিকরা কেবল পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করেছেন, প্রয়োজন হচ্ছে তাকে বদলে দেওয়া'।

বিগত বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে মার্ক্সের মতবাদ তাবৎ বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশ্বের দেশে দেশে সম্পন্ন হয়েছিল বিপ্লব। গড়ে উঠেছিল নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র। আবার এটাও ঠিক, সেসব রাষ্ট্র নানা কারণে পতিত ও অবলুপ্ত হয়েছে। তথাপি মার্ক্সের মতবাদ একটি দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচ্য বিষয় হিসেবে মানুষের মনোযোগের মধ্যে রয়ে গেছে।  

৬৫ বছরের জীবনকালে কার্ল মার্ক্স প্রভূত লেখালেখি করেছেন। প্রযুক্তিহীন ঊনবিংশ শতকের কঠিন প্রেক্ষাপটে লাইব্রেরির ঘেরাটোপে বসে বসেই তিনি সৃজন করেছেন সুবিশাল রচনাবলি। একজন দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ইত্যাদি বহুমাত্রিক পরিচয় তিনি একাই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা বিশ্বের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে বিরল ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন কার্ল মার্ক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর মাঝে রয়েছে তিন খণ্ডে রচিত 'পুঁজি' এবং এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে রচিত ও ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত 'কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’।

মার্ক্স আরও যে সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন, তা সুবিশাল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে অসামান্য আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখে তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নিজের অতুলনীয় ও  শিখরস্পর্শী প্রতিভার সাক্ষর রাখেন এবং রাষ্ট্র ও সমাজ বদলের পথ দেখান। সদ্য-অতীতের বিশ্বইতিহাসের পাতায় সেসব সংগ্রামশীলতার বিবরণ রয়েছে।

সুদীর্ঘ শতাব্দী ও অনেক যুগসন্ধিক্ষণ পেরিয়ে মার্ক্সের মতবাদ একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তিত বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে এবং বলা বাহুল্য, প্রযুক্তি ও পালাবদলের ফলে সৃষ্ট নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে । প্রশ্ন ও বিতর্ক চলছে মার্ক্সের মতবাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও।  তথাপি একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য অভিমুখ হিসেবে তত্ত্বীয় আলোচনায় ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কার্ল মার্ক্সের মতাদর্শের প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে যায়নি।