পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ছিল সম্মৃদ্ধ এক কবি জীবন, যে জীবন তিনি নির্মাণ করেছিলে বাংলার মাটি, লোকজীবন আর কৃষ্টির সাথে সভ্যতার আধুনিক তত্ত্বসারের মিলন ঘটিয়ে। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের কবিতায়, গানে, চিত্রকর্মে যে আধুনিকতার প্রথম স্ফুরণ ঘটেছিল, আর ইউরোপীয় চিন্তার প্রভাবে পঞ্চপাণ্ডবদের মাধ্যমে আধুনিক কবিতার যে অভিনূতন যাত্রাপথ সূচিত হয়েছিল। কবি জসীম উদ্দীন সচেতনভাবেই ছিলেন তার থেকে পৃথক এবং স্বতন্ত্র।
তিনি বাংলার জনপদগুলোকে গভীরতর অনুভবে নীরিক্ষণ করেছিলেন, পৌঁছেছিলেন সেই উচ্চতায় যেখানে কবিতার পঙক্তিতে সাধারণ মানুষও দৈনন্দিনের কঠোর সাধনাকে খুঁজে পায়। বিশ্বের পাঠকেরাও এই কবিকে পেয়েছিলেন আপন অনুভবে, এর প্রমাণ বহু গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় তার কবিতার অনুবাদ। তাঁর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়। তাঁর প্রথম কবিতার বই, রাখালী (১৯২৭)। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে—নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), মাটির কান্না (১৯৫১)।
নিজে গান লেখার পাশাপাশি সংগ্রহও করেছেন অনেক, সেগুলি গ্রাম বাংলার দর্শনতাড়িত গান। কবিতা এবং গান ছাড়াও তিনি সাহিত্যের সব শাখাতেই নিজেকে বিস্তারিত করেছিলেন। গানের বইগুলোর মধ্যে আছে—রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), গাঙের পাড় (১৯৬৪), জারি গান (১৯৬৮), মুর্শিদা গান (১৯৭৭)। তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে—পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে(১৯৫১), ওগো পুষ্পধনু(১৯৬৮)। উপন্যাস, বোবা কাহিনী (১৯৬৪)।
তাঁর রচিত আত্মকথাগুলো সেই ঊনিশ শতকের সময়কেই যেন এই কালে প্রবাহিত করেছে, একজন ভাবুক কিন্তু সমাজ-সংসার-রাজনীতিসচেতন এক মানুষের দেখা পাওয়া যায় সেখানে। জীবন কথা(১৯৬৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বই, ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়(১৩৬৮), বইগুলোতে সেসব ধরা আছে।
এই কবি ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারিতে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন ফরিদপুর শহরের হিতৈষী স্কুলে। পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ইন্টার ও বিএ পাশ করেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যাল থেকে এম.এ করেন। কর্মজীবনে দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার ও পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা, এখান থেকেই তিনি কর্মবহুল চাকরিজীবনের পরিসমাপ্তি টানেন।
পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, এর মধ্যে আছে একুশে পদক(১৯৭৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৭৬), পেয়েছেন সম্মানসূচক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট উপাধি(১৯৬৮)।
তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে তাঁর দাদীর কবরের পাশে শেষ নিদ্রায় শায়িত করা হয়। কলেজে পড়ার সময়ে লিখিত বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতায় তিনি যাদের কথা লিখেছিলেন, তাঁর দাদীও যেন তাদেরই একজন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই জসীম উদ্দীন প্রবাহিত ছিলেন। আধুনিকের সমান্তরালে লিখেছিলেন কৌম সমাজের বেদনানির্জন রক্তস্রোত গাঁথা।