মনের ঘূর্ণি থেকে
এক অনন্ত ঘোরাঘুরি
কবিতা ও কবি দুজনে জুড়ে থেকেও জুড়ে নেই। এটাই সবচেয়ে বড় বিস্ময় আর এটাই সবচেয়ে বড় সত্য। যে কোনো সৃষ্টি আসলে জীবন্ত কেননা তা প্রাণ থেকেই উৎসারিত। ফলে প্রাণ পাওয়া সবকিছুই তার উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েও স্বাধীন হতে চায়। আমি যদি নিজেকে কবি বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকি সেই আঙ্গিক থেকে বলব কবিতা অনন্ত উৎসের অংশ তাকে প্রতীকে দৈব, অতিপ্রাকৃত বলতেই পারি। এর যুক্তি নিশ্চয় কোথাও নির্ধারিত হচ্ছে কারণ যে অবস্থানে এটি টিকে আছে তাও যুক্তিযুক্তই কারণ উপাদান সমস্ত এখানকার কিন্তু তার সম্যক রূপ অজানা। আমার নিজস্ব কবিতা আগমনের পথ আমার কাছে খুব সুস্পষ্ট নয় তাই আমি এটিকে শক্তিজনিত মানি।
উপলব্ধি এটা বলেছিল শব্দ, উচ্চারিত শব্দ আসলে আমার টুকরো টুকরো অংশ যা মুক্তভাবে প্রকৃতির সঙ্গে নিজস্ব বিনিময় চাইছে, আমি তার মাধ্যম। এবারে কবি মাধ্যমে অভ্যস্ত হতে হতে নিজেকে হোতা ভাবতে শুরু করে সে যতই ভ্রম হোক না কেন! এরকম বহুবার হয়েছে পূর্বে লেখা কবিতা পরবর্তীতে আমার কাছে একেবারে অচেনা, বিসদৃশ হয়েও প্রতিভাত হয়েছে। বুঝেছি ওটা সময় তার প্রেক্ষিতে সচেতন, অচেতন মুহূর্ত ধরে প্রকাশ করেছে। রিলকের কথা ভীষণভাবে নিজস্ব মনে হয় তা হলো—নিঃসঙ্গতার যাপন,যন্ত্রণাকে প্রতিস্থাপিত না করার চেষ্টা, আর যা নিয়তি তা আসলে অন্তর থেকেই উৎসারিত।
একান্ত কবিতার মুহূর্তরা আসলে খুব অধরা। কবিতা নিভৃতের আয়না যাকে সামনে রেখে কৈফিয়তের ভয় ভুলে, দায়ের চিন্তা ভুলে, উত্তরের প্রতিক্রিয়া ভেবে বিচলিত হতে হয় না, যার সামনে প্রতিবিম্ব দাঁড়িয়ে থাকে প্রকৃত গঠন নিয়ে। এই মুহূর্তগুলো বিদ্যুৎচমকের মতো, কখন আসবে, কেন আসবে, কতক্ষণ থাকবে সব অধরা। আসলে মুহূর্ত তো মুহূর্তই, যাকে ধরতে গেলে হারিয়ে যায়। সে শুধু ছাপ রেখে যায়—সে কবিতা। ফলে কবিতার জন্মমুহূর্তরা খুব অতিপ্রাকৃত। ঐ কবিতাটুকুই সব। আমি মনে করি কবিতা নিজে তার জন্মমুহূর্তকে স্বীকার করে না, সে নিজে তার অস্তিত্বে এত অধিক স্বয়ম্ভূ।
কবিতার জন্ম মূহূর্ত গোপন ও অবৈধ, তাই সে বার্থসার্টিফিকেট চায় না। সে শুধু নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে চায়। এভাবেই নিজের কবিতাকে দেখে এসেছি, তাই এখনো পর্যন্ত কবিতা লিখে তার নিচে সময়, তারিখ লিখতে পারিনি। যেহেতু সময় এখনো পর্যন্ত লিখে রাখায় বিশ্বাসী নয় কারণ সময় আমার কাছে স্রোত মনে হয় আর স্রোতের কোনো নির্দিষ্ট স্তর সুষ্পষ্ট নয়! শিশু যেমন অন্ধকারে ঘুমের সময় বাড়ে অবয়বে, কবিতাও তেমনি। ভিড়ে সে প্রকাশিত হতেই পারে, কিন্তু তার বৃদ্ধি গোপনে, অন্ধকারে, সুরক্ষায় হয়। আর যে গোপনকে আশ্রয় করে সে কী করে নিয়মের সময়কে সহ্য করবে?
মনে হয় মুক্ত সময়ের কসমসের মধ্যে অবিরত কবিতা ঘুরতে থাকে। লেখক একটা নির্দিষ্ট সময়ের মাধ্যম এতখানি কবিতার মহাকালকে কে ধরে রাখার! যে পাঠক, সে তাকে যে কোনো সময়ের কিম্বা অনির্ধারিত সময়ের জন্য ভেবে নিতে পারে, স্বাধীনতা তাঁর। যখন থেকে সে কবিতা পড়ে সেই কবিতার জন্ম নির্ধারণ সেই করে, পালক পিতা-মাতার মতো। কারণ কবিতার মুহূর্ত এক মিশ্রিত অনুভূতির যা কোনো এক বেগে ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে চায় কিন্তু সেই মুহূর্ত স্থায়ী না অস্থায়ী সুখের না অসুখের তা সে জানতে পারে না। কবিতাকে যে গর্ভে ধরে সে না পারে ফেলতে না পারে ছাড়তে এই দোটানার কুহকে কবিতা চলে আসে আলোয়। কবিতা অতিজীবনের কোনো এক সূত্র থেকে আসে যাকে বোঝা যায় না। কবিতাকে বোঝার চেষ্টা করা যায় কেবল। কবিতা খুব গোপন, নিভৃতে আগলে রাখা অপার মায়ার সৃষ্টি। কবিতার কোনো আক্ষরিক জন্মমূহূর্তের কথা না ভাবাই ভালো—সে এত ব্যাপক, এত অধরা যে তার দেওয়া ঐ পুলকিত মূহূর্তটুকু ছাড়া বাকি সব কুহক।