ছায়া নাকি কায়া

  • ফাহমিদা বারী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে তো হবেই। আমি তখন সদ্য ডাক্তারি পাশ করে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছি। পোস্টিং হয়েছে প্রায় অখ্যাত এক উপজেলায়। এদিকে বোধকরি রোগ-শোক তেমন একটা হয় না। সারাদিন রোগীর অভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকি। বসে বসে মশামাছি তাড়াই। দিনের একটা বড় সময় হেঁটে হেঁটে জায়গাটা দেখি।
উপজেলাটিতে রেল যোগাযোগ আছে। তাই ছোটখাটা একটা স্টেশনও আছে। স্টেশনের উল্টোপাশের পায়েহাঁটা পথটি যে বাঁকের কাছে গিয়ে দু’দিকে ঘুরে গেছে, ঠিক সেই জায়গাটিতে একটি পোস্ট অফিস।
ছোট্ট উপজেলার এই একটি মাত্র পোস্ট অফিস। দিনের বেশিরভাগ সময় ফাঁকাই থাকে জায়গাটা। লোকজনের তেমন একটা আনাগোনা নেই। পোস্ট অফিসের প্রায়ান্ধকার ঘরটিতে প্রৌঢ় পোস্টমাস্টার একটি চেয়ারে বসে আরেকটিতে পা তুলে দিয়ে সারাদিন ঝিমান। পাশে টুলের ওপরে একটা একদিনের বাসি সংবাদপত্র পড়ে থাকে। সেটা দিয়ে মাঝে মাঝে বাতাস করেন আর চাকরির নিকুচি করেন। মাঝে মাঝে দু’একজন এসে তাকে ডেকে তোলে। চিঠিপত্র কিংবা মানি ওর্ডারের খোঁজ খবর করে।
সেই দু’একজনের একজন হলাম আমি। গতমাসেই এখানকার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে বদলি হয়ে এসেছি। নতুন চাকরি, তাই তদবিরে বিশেষ কাজ হয়নি। যে জায়গায় তদবির করেছিলাম, সেখানকার অফিসার আমার আপাদমস্তক ভালোমতো দেখে নিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বললেন,
‘হুম, সবে তো ঢুকলেন চাকরিতে। মানবসেবার মহৎ ধর্ম নিয়ে এই পেশায় এসেছেন। এসেই স্থির করে ফেললেন, শুধু শহরের মানুষেরই সেবা করবেন! গ্রামের লোকজনের কি তবে সেবা পাওয়ার অধিকার নেই?’
আমি মুখে কম্প্রোমাইজিং হাসি ঝুলিয়ে রেখে হাত কচলাতে লাগলাম। এসব কথার কী জবাব হয়? প্রশ্নকর্তাও নিশ্চয়ই উত্তর পাবার আশায় প্রশ্ন করেন না। অফিসার আমাকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে আমার তদবির না কামিয়াব করে দিলেন। পাথর মুখে বললেন,
‘এখন আপাতত সুবিধাজনক পোস্টিং নেই। প্রথম দু’এক বছর একটু প্রত্যন্ত উপজেলায় কাটিয়ে আসুন না! জীবনে সবরকম অভিজ্ঞতার স্বাদই নেওয়া ভালো। আর কে বলতে পারে, ভালো কিছুর সন্ধানও পেয়ে যেতে পারেন।’
সেই থেকেই ভালো কিছুর সন্ধানেই এখানে পড়ে আছি। তদবির অবশ্য এখনো চালু রেখেছি। থেমে যাইনি। কারণ, প্রত্যন্ত বলতে যে দুর্গম বোঝায়, তা জানা ছিল না। সংবাদপত্র আসে পরেরদিন। বাসি সংবাদপত্র পড়ে আরাম পাই না মোটেও। একটু আধটু গল্প করার মতোও কাউকে পাই না। পাণ্ডব বিবর্জিত এলাকা বলে মনে হয়। কেমন যেন খাঁ খাঁ করতে থাকে ভেতরটা। প্রতিদিন একবার করে পোস্ট অফিসে এসে খবর নিয়ে যাই, ঢাকা থেকে কোনো চিঠিপত্র এসেছে কি না। তদবিরের কোনো অগ্রগতি হলো কি না।
এই পোস্ট অফিসে আসা যাওয়া করতে গিয়েই সেই ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা হয়ে গেল।
তিনিও মাঝেমাঝেই পোস্ট অফিসে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ আশেপাশে পায়চারি করেন। তবে কোনো চিঠিপত্রের সন্ধানে আসেন বলে মনে হয় না। যেন পোস্ট অফিসে এসে দাঁড়িয়ে থেকে সময় কাটানোটাই তিনি উপভোগ করেন।
ভদ্রলোককে বেশিরভাগ দিন নিবিষ্টমনে কী যেন ভাবতে দেখতাম। চেহারাতে নিমগ্ন প্রতিচ্ছবি। আমাকে তিনি একদিনও দেখতে পাননি। আমি খুব অবাক হতাম। মনে মনে ভাবতাম, হয়তো আলাপ করতে আগ্রহী নয়। তাই দেখেও না দেখার ভান করছেন।
আমি কিন্তু খুব মন দিয়ে ভদ্রলোককে দেখতাম। পোশাক আশাক দেখে বেশ শিক্ষিত বলেই মনে হতো। বয়স আমার চেয়ে সাত আট বছর বেশি হতে পারে। চেহারাতে বিজ্ঞতার একটা ছাপ আছে।
আমার মন তখন একজন ভালো বন্ধু পাবার আশায় উদ্গ্রীব হয়ে থাকত। চেনা পরিচিতজনদের কাছ থেকে দূরে একা একা এভাবে পড়ে থাকতে থাকতে আমি একেবারেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। দু’দণ্ড কথা না বলতে পারলে বুঝি প্রাণেই মরে যাব, এমন মনে হতো সবসময়।
ভদ্রলোক একদিন আমাকে লক্ষ্য করলেন। বেশ প্রসন্ন মুখে এগিয়ে এসে হাত মেলালেন,
‘আরে, আপনি আমাদের হেলথ কমপ্লেক্সের নতুন ডাক্তারসাহেব না! আমি এখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক, শরিয়ত উল্লাহ। আপনার সাথে এখানে দেখা হয়ে যাবে একদম ভাবিনি। চিঠির খোঁজে এসেছেন বুঝি?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
‘তা প্রায় রোজই আসি ভাই। আর আপনাকেও কমপক্ষে তিন-চারদিন এখানে দেখেছি। কিন্তু আপনি আমাকে খেয়াল করেননি। আর খুব গভীরভাবে কিছু ভাবছিলেন দেখে আমিও আপনাকে বিরক্ত করিনি।’
ভদ্রলোক জিভ কেটে বললেন,
‘এই আমার এক সমস্যা বুঝলেন! যখন ভাবতে থাকি তখন আশেপাশে কিছু খেয়াল করি না। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
আমি মজা করে বললাম,
‘আপনি নিশ্চয়ই বিজ্ঞান কিংবা অংকের শিক্ষক। গবেষণাধর্মী বিষয়ের সাথেই এমন অখণ্ড মনোযোগের যোগসূত্র আছে।’
শরিয়তউল্লাহ সাহেব আমার মজা বেশ ভালোভাবেই নিলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
‘হয়নি ডাক্তার সাহেব। আমি বাংলার শিক্ষক। সাহিত্যের কিছু পোকা আছে মাথায়। একেবারে সেই কলেজ জীবন থেকেই বলতে পারেন। আমার লেখা তিনটি বই আছে। একটি উপন্যাস, আর দুটি গল্পগ্রন্থ। এছাড়া টুকটাক এখানে ওখানে মাঝে মধ্যে লেখা ছাপা হয়।’
‘আরে বাবা! আপনি লেখক!’ আমি নিখাঁদ বিস্ময়েই বললাম। মনে পড়ে গেল, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ও গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তার এক জুনিয়র সহকর্মী তার লেখা চিঠি পড়ে সর্বপ্রথম তার সাহিত্যপ্রতিভা আবিষ্কার করেন। সেই সহকর্মীর অনুরোধেই বিভূতিভূষণ সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করেন। আর পরেরটুকু তো ইতিহাস! কে বলতে পারে, এই অজ উপজেলার অখ্যাত এক হাই স্কুলের শিক্ষকের মাঝেও একই রকম প্রতিভা আছে কি না!
কথায় কথায় ভালোই আলাপ জমে গেল শরিয়ত উল্লাহ’র সাথে। তার বাড়ি এই উপজেলাতেই। পড়াশোনার জন্য মাত্র কয়েকবছর এই অঞ্চলের বাইরে ছিলেন। তা বাদে বাকি সময় এখানেই পড়ে আছেন। বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান তিনি। তারা তাকে চোখের আড়ালে রাখতে চাননি। তিনিও তাদের ইচ্ছেকে সম্মান করে অন্য কোথাও যাননি।
আমি আমার একাকিত্বের কথা ভদ্রলোককে বলতেই আমার কষ্টটা বুঝতে পারলেন। আমার দুঃখ লাঘব করতে বেশ উঠেপড়েই লেগে গেলেন তিনি।
বেশ কয়েকদিন তার বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ালেন। তার স্ত্রীর হাতের রান্নার প্রশংসা করাতে মাঝে মাঝেই দুপুরের দিকে একটা ছোকরাকে দিয়ে আমার বাসায় খাবার পাঠাতে লাগলেন। নিজের স্থানীয় কিছু শিক্ষিত বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। মাঝেমাঝে এখানে ওখানে বেড়াতেও নিয়ে যেতেন। বয়েসের ব্যবধান খুব বেশি না হওয়াতে আমিও তার সাথে মন খুলে গল্প করতে পারতাম। মোদ্দাকথা, এই দুর্গম এলাকায় এতদিনে কথা বলার মতো একজন বন্ধু পেয়ে আমি মোটামোটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
শরিয়তউল্লাহর বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মতো হবে। কিন্তু তার স্ত্রীকে দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম। বাইশ-তেইশের বেশি হবে বলে মনে হয়নি। অবশ্য এটা খুব অস্বাভাবিক কোনো বিষয়ও নয়। একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিকে এমন বেশি ব্যবধানের বিয়ে খুব বড় কোনো ঘটনা নয়। আমি শরিয়তউল্লাহ সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। এত অল্প পরিচয়েই একজনকে তার স্ত্রীর সাথে বয়সের দীর্ঘ ব্যবধানের কারণ জিজ্ঞেস করা যায় না। সেটা দৃষ্টিমধুর দেখায় না।
তবু শরিয়তউল্লাহ নিজেই একদিন আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করলেন। এমন চমকপ্রদ গল্প শোনালেন যা শুনে আমি বিমোহিত হয়ে পড়লাম।

দুই

বিজ্ঞাপন

আমার সাথে আপনার দেখা হয়েছিল পোস্ট অফিসে। আমার এখন আর তেমন কোনো চিঠিপত্র আসে না। তবে একটা সময় ছিল, যখন প্রতি সাতদিন অন্তর অন্তর আমার কাছে অন্তত দুটো করে চিঠি আসত। সেই চিঠি আনার জন্য আমি প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার পোস্ট অফিসে ধর্ণা দিতাম। সেই অভ্যেস বলতে পারেন আজও যায়নি। এখনো অভ্যেসবশতই মাঝে মাঝেই পোস্ট অফিসে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। পোস্ট মাস্টার সাহেব আমাকে দেখেন, কিন্তু কিছুই বলেন না। প্রথমদিকে একটু অবাক হয়ে তাকাতেন অবশ্য। কারণ তিনিও জানেন, আর কখনোই আমার চিঠি আসবে না...সেই ‘বিশেষ’ চিঠি।
আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি। বয়স একেবারেই অল্প, এই পঁচিশ-ছাব্বিশ। লেখালেখির অভ্যাস ছিল। এখানে সেখানে লেখা দিই। মাঝে মাঝে স্থানীয় এমনকি কদাচিৎ জাতীয় দৈনিকেও গল্প-কবিতা ছাপা হয়। তরুণ বয়স। মনে ব্যাপক জোশ। লেখালেখি করে অনেক কিছু পালটে ফেলব, মনের মাঝে এমন বাসনা। কখনো লেখালেখির কেউ প্রশংসা করলে আনন্দে আটখানা হয়ে যাই।
চাকরিতে ঢোকার আগে থেকেই আমি টিউশনি করতাম। স্কুলের বড় ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের পড়াতাম। ছোট ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর মতো ধৈর্য ছিল না আমার। চেঁচামেচি আর দুষ্টামিতে মাথা খারাপ হয়ে যেত।
একদিন আমার কাছে একটি চিঠি আসে। নাম পরিচয় ছবি সবসহ একটি সুন্দরী মেয়ের চিঠি। ছবি দেখে মনে হয় কুড়ি বছরের মতো বয়স হবে মেয়েটির। সে নিজেকে আমার একজন ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখেছে। পুরো চিঠি জুড়ে আমার ভূয়ষী প্রশংসা যাকে বলে! আমার লেখা কোন গল্পের কত নম্বর প্যারায় আমি কী বর্ণণা দিয়েছি, গল্পের নায়িকাকে কিভাবে চিত্রায়িত করেছি, এমনকি গল্পের কোন অংশে অতি চমৎকার ভাষায় আমি বিষাদ কিংবা আনন্দকে ফুটিয়ে তুলেছি...সবকিছুর একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে।
সেই কাঁচা বয়সে সুন্দরী একজন মেয়ের কাছ থেকে এমন একটা ভালোলাগা চিঠি পেয়ে আমার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন!
আমি খুব আবেগতাড়িত ভাষায় চিঠিটির উত্তর দিলাম। লেখক মনের সবটুকু আবেগ উজাড় করে পাঠকের নৈবেদ্যকে গ্রহণ করলাম। মেয়েটিও আপ্লুত হলো বলাই বাহুল্য। এরপর থেকে সে মাঝেমাঝেই আমাকে চিঠি পাঠাতে থাকল। লেখক ও ভক্তের সম্পর্ক ধীরে ধীরে পত্রমিতার সম্পর্কে রূপ লাভ করল।
এমন অবস্থা হলো আমাদের, প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’খানা চিঠি না পেলে আমাদের কারোরই মন ভরত না। চাতক পাখির মতো দুজন যেন দুজনের চিঠির আশায় বসে থাকতাম। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, সম্পর্কটির আবার রূপান্তর ঘটেছে।
মেয়েটির নাম ছিল নিশি। আমি নিশিকে নিয়ে একসময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলাম। আমরা বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
তখন আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। আমি তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম, নিশি ছাড়া অন্য কাউকেই আমি বিয়ে করব না। বাবা-মা অবশ্য আমার সিদ্ধান্ত শুনে গররাজী হলেন না। মেয়ের ছবি দেখে তাদেরও পছন্দ হলো। তারা নিশির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেন।
আমি নিশিকে সবকিছু জানালাম। সেও আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। তবে আমার কাছ থেকে সে আরেকটু সময় চায়। কারণ তখন তার সামনে ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। সে পড়াশোনা করতে চায়।
আমি অপেক্ষা করতে রাজি হলাম। বাবা-মা’র আপত্তিতেও কান দিলাম না। মাত্র তো কয়েকটি বছর!
আমাদের পত্রমিতালি কিন্তু চলতেই থাকল। একইভাবে, একই গতিতে। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে, পছন্দ অপছন্দ সবকিছুর খবর সে রাখে। আমিও একইভাবে তার সকল কিছুর খবর রাখি। আমাদের মধ্যকার দূরত্ব কোনো বাধাই হয়ে দাঁড়ায় না।
নিশির চিঠিতে আমি এতই মজে থাকতাম যে, আশেপাশে কে আছে আমার মাথায় থাকত না। টিউশনিতে গিয়েও আমি তার চিঠি পড়তাম। পড়া চিঠিগুলোই বারবার পড়তাম। তবু খায়েশ মিটত না যেন।
আমার এক ইঁচড়ে পাকা ছাত্রী ছিল, ক্লাস সেভেনে পড়ত। নাম বিথী। আমি যখন একমনে নিশির চিঠিগুলো পড়তাম, আমার সেই ছাত্রী তখন মন দিয়ে আমাকে খেয়াল করত। আমার মুখের পাল্টে যাওয়া রেখাগুলোকে সে গভীর মনোযোগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। একদিন সে বিনা সঙ্কোচে জিজ্ঞেস করে ফেলল,
‘স্যার, প্রতিদিন এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়েন?’
আমি একেবারেই থতমত খেয়ে গেলাম। পুঁচকি মেয়ের মুখেচোখে একেবারেই বেপোরোয়া ভাব। যেন সে দেখেই ছাড়বে আমি এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ি। আমি গাম্ভীর্য বজায় রেখে বেশ শক্ত মুখে বললাম,
‘সেটা তোমার জানার দরকার নেই। পড়ায় মন দাও।’
এরপরে সে যা বলল শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। পুঁচকি মেয়ে বলে কী!
‘স্যার আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ে বলছিল, আপনি নাকি যেসব চিঠি পড়েন, সেগুলো কাউকে দেখানো যায় না!’
আমি একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের আমার সম্পর্কে এত নীচু ধারণা! তখন আমি বয়সে তরুণ। তার ওপরে নতুন চাকরি। আর ছোটবেলা থেকেই আমি বেশি মাত্রায় ছেলেমানুষ। এমন কথা শুনে তাই বেশি কিছু চিন্তা ভাবনা না করে ভীষণ রাগান্বিত হয়ে বিথীকে আমার চিঠি পড়তে দিলাম। বললাম,
‘এই যে, নাও ধরো। পড়ে দেখো। কী আজেবাজে কথা লেখা আছে এতে!’
আমি এগিয়ে দেওয়া মাত্রই সে ছোঁ মেরে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করল। পুরো চিঠি পড়ে সে বলল,
‘ও, এখানে তো কিছুই নেই! তাহলে মনে হয় অন্য কোনো চিঠির কথা বলেছে! স্যার, তাহলে মনে হয় আপনার লেখা চিঠিগুলো কখনো দেখেছে!’
আমি রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলাম। চিঠিগুলো লিখে আমি আমার ডায়েরিতে ভরে রাখতাম। পরে সময় সুযোগমতো সেগুলো পোস্ট করতাম। আমার ডায়েরি থেকে আমার অনুমতি ছাড়া সেই চিঠি বের করে পড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এই সহজ ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম না। বিথীর চালটা মোটেও ধরতে পারলাম না। আমি আমার লেখা কিছু চিঠি বিথীর সামনে খুলে দিয়ে বললাম,
‘বাজে কথা বলো! দেখো আমার চিঠিতে কী আছে!’
বিথী আমাকে নিয়ে খেলতে লাগল। আমিও তার খেলার প্যাঁচে পরে গোহারা হেরে বসলাম। একটিবারের জন্য আমার মনে অন্যরকম কিছু এলো না যে, মেয়েটা আমাকে ইচ্ছে করে রাগিয়ে আমার চিঠিগুলো পড়তে চাইছে। সাতাশ বছরের আমাকে তের চৌদ্দ বছরের পুঁচকে দুইরত্তি একটা মেয়ে একেবারে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়ল।
আমাদের চিঠিগুলো ঠিক যে প্রেমে গদগদ ছিল তা নয়। বরং পরিশীলিত ভাষার প্রগাঢ় আবেগের সব চিঠি, যার বেশিরভাগই আমাদের ইচ্ছে আর ভালো লাগার বিষয়গুলোতে ভরপুর। আমি আমার চিঠিতে লিখতাম, আমি কিভাবে সৌন্দর্যকে কল্পনা করি। কেমন পোশাকে একজন মেয়েকে আমার পরিপূর্ণ মনে হয়। অথবা একটি মেয়ের মধ্যে কেমন গুণ বা আচরণ দেখলে তাকে আমার সম্পূর্ণা নারী বলে মনে হয়।
এরপর থেকে মাঝে মাঝেই এটা ওটা উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে বিথী আমার চিঠিগুলো পড়ত।
এদিকে বছর ঘুরে বছর এলো। নিশির তরফ থেকে বিয়ের ব্যাপারে এখনো কোনো সাড়া পাইনি। সে আমাকে জানিয়েছে, আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে সে বিয়ে করবে না। অন্য কোনো ছেলের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু পড়াশোনা শেষ না করে সে বিয়ে করতে চায় না। সে আমাকে অনুরোধ করে যেতে থাকে, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার।
আমি অপেক্ষা করতে থাকি। আমার বয়স বাড়তে থাকে। এদিকে বিথী আস্তে আস্তে কেমন পালটে যেতে থাকে। সেই চঞ্চলা, দুষ্টপ্রকৃতির মেয়েটার মাঝে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আশ্চর্য নারীকে আবিষ্কার করি। ঠিক আমার মনের মতো। যার কল্পনা আমার মন অহর্ণিশি করে চলে। আমি নারীকে যে রূপে কামনা করি, বিথী হয়ে ওঠে হুবহু তেমনই একজন। আচরণে, নম্রতায়, রূপে...
শত চেষ্টাতেও আমার মনকে ফেরাতে পারি না বিথীর দিক থেকে। আমি তখন ত্রিশ বছরের যুবক, আর বিথী ষোল বছরের এক সদ্য তরুণী।
এর পরেও কেটে গেল আরো দু’বছর। বিথী এখন আর আমার ছাত্রী নয়। কিন্তু তবুও ওর সাথে আমার প্রায় নিয়মিতই দেখা হয়। কোনো একটা উপলক্ষ ধরে হয় সে আমার বাসায় আসে, নয়তো আমি তার বাসার আশেপাশে ঘুরে বেড়াই।
কিন্তু নিশির সাথেও আমার পত্রালাপ বন্ধ থাকে না। তা আগের মতোই চলতে থাকে। অভ্যেসের টানেই আমি প্রতি সপ্তাহে পোস্ট অফিসে যাই। অপেক্ষা করে থাকি নতুন চিঠির। কিন্তু রক্ত মাংসের যে মানবীকে আমি একসময় নিশির মাঝে খুঁজে ফিরতাম, সে তার অবস্থান পাল্টে অন্য কারো মাঝে সমর্পিত হয়। আমি তা জানতেও পারি না!

তিন

এটুকু বলে শরিয়তউল্লাহ সাহেব থেমে হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমি তখন গল্পে নিমগ্ন। ব্যগ্র সুরে বললাম,
‘তারপর? তারপর কী হলো?’
‘এখনো বুঝতে পারছেন না তারপরে কী হলো?’
‘ভাই না বললে বুঝব কিভাবে?’
শরিয়তউল্লাহ সাহেব আবার শুরু করলেন,
‘আমার বাবা-মা আর অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না। তারা তখন নাতির মুখ দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এদিকে আমার মন কী চাইছে, আমি সেই সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। বোকার মতো আমি নিশির কাছে জবাব পাওয়ার আশায় দিন গুনতাম।
অথচ আমার মন উন্মুখ হয়ে বসে থাকত বিথীর অপেক্ষায়। বিথীর উপস্থিতি আমার মনে স্নিগ্ধ এক আবেশ ছড়িয়ে দিতে লাগল। আমার পছন্দের রঙে বিথী সাজত, আমার ভালোলাগা দিয়ে সে তার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ করত।
একসময় আমি বুঝতে পারলাম, নিশি না...আমি মনে মনে বিথীকেই কামনা করতে শুরু করে দিয়েছি। আমার অবচেতন মন জুড়ে এখন শুধুই বিথীর বসবাস।
এই উপলব্ধিতে আমার মনে ঝড় উঠল। নিজেকে খুব জঘন্য একজন মানুষ মনে হতে লাগল।
কিন্তু নিশির কাছে আমি কিছুই গোপন করলাম না। সবকিছু জানিয়ে তাকে চিঠি দিলাম। খুব অকপট ভাষায় আমার মনের উপলব্ধিটুকু ওকে বললাম। সে যেন অন্য কাউকে নিয়ে জীবনে সুখী হয়, এমন শুভকামনা জানালাম।
চিঠিটা পোস্ট করে আসার প্রায় পাঁচদিন পরে আমি নিশির একটি চিঠি পেলাম। চিঠিটা যেদিন পেলাম সেদিন বিথীর সাথে আমার বিয়ে।

‘‘প্রিয় শরীয়ত,
অনেকদিন তোমাকে অপেক্ষায় রাখলাম। আসলে আমিও বেশ বুঝতে পারছিলাম, এতদিন কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করতে রাজি হয় না। তবু আমি আশায় ছিলাম, হয়তো তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমার প্রতীক্ষাতেই দিন গুনবে। সেই আশাময়ীকে তুমি নিরাশ করোনি। সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
আমি তোমার কাছে ছোট্ট একটি মিথ্যে বলেছিলাম। আমি আসলে লেখাপড়ার জন্য তোমার কাছে সময় চাইনি। চেয়েছিলাম অন্য একটি কারণে।
আমার বড় একজন বোন আছে। ছোটবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ও একটি পা হারিয়েছিল। আমার বোনটির বিয়ে হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে যেসব প্রস্তাব আসত, একটি পা নেই শুনেই পাত্রপক্ষ পিছিয়ে পড়ত।
আমাদের সমাজে এখনো ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেলে বড় বোনের বিয়ে হওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আমার ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু বাবা-মা আমার বোনের দিকে তাকিয়ে আমার বিয়ে দেবার চিন্তা সরিয়ে রেখেছিলেন। আমিও স্থির ছিলাম, তোমাকে ছাড়া আর অন্য কাউকেই আমি বিয়ে করব না। যত ভালো প্রস্তাবই আসুক! আমার মনের পবিত্রতাকে অন্য কোথাও সমর্পণ করতে পারব না। আমি আমার মনের মাঝে অন্য কারো অস্তিত্ব কল্পনাও করতে পারি না।
অনেক অপেক্ষার পরে গত সপ্তাহেই আমার বোনটির বিয়ে হয়ে গেল। পাত্র সব জেনে শুনে খুশি মনেই আমার বোনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
আমাদের প্রতীক্ষাও শেষ হয়েছে এবার। আমি আমার বাবা-মা’কে জানিয়েছি তোমার কথা। তারা তাদের সম্মতি জানিয়েছেন।
তুমিও তোমার বাবা-মাকে এবার বলতে পারো...’’
আমি যখন এই চিঠি পড়ছি, ততক্ষণে বিথীর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
আমার সেই চিঠিটিও নিশ্চয়ই ততদিনে নিশির কাছে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সেই চিঠির আর কোনো জবাব আমি পাইনি। এখনো অভ্যেসের টানেই মাঝে মাঝে পোস্ট অফিসে যাই। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ মনে ফিরে আসি।’
গল্পের শেষে প্রশ্ন না করে পারলাম না,
‘এখন তো আপনি বিবাহিত। এভাবে এখনো অন্য একজনের চিঠির জন্য অপেক্ষা করেন, এতে আপনার স্ত্রী রাগ করেন না? কষ্ট পান না?’
শরিয়তউল্লাহ সাহেব হাসলেন। স্মিত মুখেই বললেন,
‘নাঃ! সে রাগ করে না। এই চিঠির সূত্র ধরেই আমাদের বিয়ে হয়েছে...তাই সে চাইলেও রাগ করতে পারে না! তবে আমি নিজের মনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই অপেক্ষার এবার অবসান ঘটাব।’
তারপরে একটু থেমে থেকে স্বগতোক্তির মতো করে বললেন,
‘কায়াকেই সঙ্গী করেছি যখন… ছায়ার অপেক্ষায় থেকে আর কী লাভ!’