বিস্ময়কর নায়াগ্রা ফলস

  • তৌফিক হাসান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নায়াগ্রা ফলসের রাতের সৌন্দর্য, ছবি: তৌফিক হাসান

নায়াগ্রা ফলসের রাতের সৌন্দর্য, ছবি: তৌফিক হাসান

মধ্যদুপুরে ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় আমরা রওনা হলাম আমেরিকা ভ্রমণে বাঙালির অন্যতম অবশ্য গন্তব্য নায়াগ্রা ফলসের পথে। দুই পরিবারের মোট ৮ জন মিলে ফোর্ডের একটা বড় ভ্যানে রওনা হলাম পেনসিলভেনিয়ার লেভিট্টাউন থেকে। নায়াগ্রা যেতে মোটামুটি ৮ ঘণ্টা লাগবে, রাত-দিন দুই সময়েই নায়াগ্রাকে দেখবো বলেই এই বেলায় রওনা হওয়া। দিনে ও রাতে ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্যের পেখম মেলে ধরে সারা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় জলপ্রপাত নায়াগ্রা। পেনসিল্ভেনিয়ায়র যে কান্ট্রিসাইড রাস্তা ধরে যাচ্ছি তা খানিকটা পাহাড়ি, উঁচু-নিচু, সবুজ এবং সৌম্য। চোখে প্রশান্তিদায়ক সবুজের মধ্যে দিয়ে কখনও মিষ্টি আলু ক্ষেত আবার কখনোবা ভুট্টা ক্ষেতের পাশ দিয়ে নির্দেশিত গতি মেনে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। মাঝেমাঝে লোকবসতিরও দেখা পাচ্ছি, সুন্দর ছোটখাট ছিমছাম গোছানো স্বতন্ত্র বাড়ি একেকটা।

ঘণ্টা তিনেক চলার পর আমরা পোকোনো মাউন্টেইন এরিয়ায় এসে ৮১ হাইওয়েতে উঠলাম। বাকি পথটা এই হাইওয়ে ধরেই যেতে হবে। পোকোনো এলাকাটা বেশ জনপ্রিয়, আশেপাশের রাজ্য থেকে অনেকেই পোকোনোতে আসেন পাহাড়ে ক্যাম্পিং কিংবা হাইকিং করার জন্য। অক্টোবরের দিকে পোকোনো যেন একটা স্বর্গে পরিণত হয়, গাছের পাতা এমন সুন্দর লাল-হলুদ-সোনালী রঙ ধারণ করে দেখে মনে হয় যেন পুরো পাহাড়ে আগুন লেগেছে!

বিজ্ঞাপন

পোকোনো পেরিয়ে সামান্য যেতেই রাস্তার সাথে গাড়ির চাকা  ঘর্ষণের শব্দ খানিকটা পরিবর্তন হওয়াতে ভাই মিথুন জানালো আমরা নিউয়র্কে প্রবেশ করেছি কারণ পেনসিলভেনিয়ার রাস্তা এত খারাপ না এবং অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে চোখের সামনে ওয়েলকাম টু নিউইয়র্ক লেখা বোর্ড দেখতে পেলাম! রাত ন'টা নাগাদ আমরা নায়াগ্রা সিটিতে পৌঁছলাম, ডানে-বামে না তাকিয়ে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে গেলাম নায়াগ্রা ফলস দেখতে। রাতের নায়াগ্রা নাকি অন্যরকম সুন্দর, সেটা দেখতেই সরাসরি এখানে আসা। পার্কিংয়ের গাড়ি পার্ক করে বেরোতেই অবিরত ঝমঝম শব্দ আমার স্নায়ু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলো। কেমন যেন মোহাচ্ছন্য হয়ে দ্রুতপায়ে বিশ্বখ্যাত সেই জল্প্রপাতের দিকে এগোতে থাকলাম। মিনিট সাতেক হাঁটার পর পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত জলপ্রপাতের সামনে। কানাডা সাইড থেকে ফলসের এর উপর লাল-নীল-সবুজ বিভিন্ন রঙের জোরালো আলো ফেলা হচ্ছে। কিছুক্ষন পর পর লাইটের তীব্র সেই আলো বদলানোর সাথে সাথে জলপ্রপাতের ধারাগুলোও রঙ পরিবর্তন করছে। ভীষণ দৃষ্টিনন্দন লাগছে।


নায়াগ্রা ফলস, উত্তর আমেরিকার প্রকান্ড এক জলপ্রপাত। আমেরিকার নিউইয়র্ক এবং কানাডার অন্টারিও প্রদেশের মাঝ সীমান্তে পড়েছে নায়াগ্রা ফলস। নায়াগ্রার তিন ভাগের এক ভাগ পড়েছে আমেরিকায়, নাম ‘আমেরিকান ফলস’। বাকি দুই ভাগ কানাডায়। নায়াগ্রা মূলত তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টি। সবচেয়ে বড় জলপ্রপাতটির নাম হলো হর্সশু ফলস বা কানাডিয়ান ফলস। এটি প্রায় ১৬৭ ফুট উঁচু থেকে ২৬০০ ফুট চওড়া পানির স্রোত নিয়ে নিচে আছড়ে পড়ে। বলা হয় নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রায় ৯০ ভাগ পানি এই ফলস দিয়েই পতিত হয়। এর পরের ফলসটির নাম আমেরিকান ফলস। এটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এবং ১৬০০ ফুট চওড়া। অন্যটির নাম ব্রাইডল ভেইল ফলস। প্রকান্ড এই জলপ্রপাত ১৮৪৮ সালে একবার শুকিয়ে গিয়ে ৪০ ঘণ্টার মত পানি প্রবাহ বন্ধ ছিল। তাছাড়া ঠান্ডায় বরফ হয়ে পুরোপুরি জমে গিয়েছে অসংখ্যবার।


বেশ অনেকটা সময় রাতের নায়াগ্রার সৌন্দর্য উপভোগ করে ডিনার সেরে মোটেলে চেক ইন করলাম রাত ১২টা নাগাদ। আমরা দূটো ডাবল বেডেড রুম নিয়েছিলাম প্রতিটার ভাড়া ট্যাক্স সহ ২০০ ডলার। রুমগুলো খারাপ না, বেড গুলোও বেশ বড় এবং আরামদায়ক। হোটেলে পৌঁছার পর বেশি দেরী না করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম কারণ পরদিন সকালে আবার নায়াগ্রা যেতে হবে। মুল এডভেঞ্চারটা হবে আগামীকাল।


সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে মোটেল থেকে চেক আউট করে আমরা আবারও রওনা হলাম নায়াগ্রার পথে। আজকে পুরোটা দিন আমরা সেখানেই কাটিয়ে দিবো। এবারে পার্কিং এর যায়গা জুটলো খানিকটা দূরে, পার্কিং করে রেখেই ভো দৌড় দিলাম জলপ্রপাতের দিকে, খানিক পরেই পৌঁছে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। বেশ খানিকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকালাম অবিরত ধারায় পরতে থাকা পানির দিকে। হুহু করে বাতাস বইছে, সেই বাতাসে তোড়ে মাঝে মাঝে জলপ্রপাতের পানির কণা আমাদের হালকা ভিজিয়ে দিচ্ছিল কিন্তু সেদিকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছিনা। দুচোখ ভরে কেবল জলপ্রপাত দেখছি আর পানির স্রোতের সুতীব্র শব্দ শুনছি। গতরাতের তুলনায় আজ দর্শনার্থী অনেক বেশি, অনেক বাংলাদেশীও দেখলাম এবং বাংলায় আলাপনও শুনতে পেলাম। দর্শনার্থীরা কেউ আমাদের মতো জলপ্রপাতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পানির পতন দেখছে কেউবা ছবি তুলছে আবার অনেকেই খানিকটা দূরে অপেক্ষাকৃত উঁচু যায়গায় বসে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখছে। দুইপরিবারের সবাই মিলে বেশ কিছু ছবি তুলে রওনা হলাম গোট আইল্যান্ডের দিকে উদ্দেশ্য মেইড অব দ্য মিষ্ট জাহাজে করে জলপ্রপাতের একেবারে পাদদেশ থেকে ঘুরে আসা।


৩০ ডলারে টিকিট কেটে উঠে পরলাম মেইড অব দ্য মিষ্ট জাহাজে। উঠেই দৌড় লাগালাম ছাদের একবারে সামনের দিকে যাবার জন্য কারণ খোলা ছাদে সামনের দিকে দাঁড়ালেই সবচেয়ে ভালভাবে উপভোগ করা যায় নায়াগ্রাকে। জাহাজে উঠার সময় আমাদের সবাইকে নীল রঙ এর রেইন কোট দিয়েছে যেটা জাহাজে উঠার আগেই পরে নিয়েছি। জাহাজটা জলপ্রপাতের এত কাছে নিয়ে যায় যে রেইন কোট না পরলে কাক ভেজা হতে হয়। এই জাহাজ প্রায় ৩০ মিনিট সময়ে আমাদের সবগুলো জলপ্রপাতকে কাছ দেখে দেখিয়ে আবার ফেরত নিয়ে আসবো। জাহাজটি ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে কানাডার দিক থেকে আরেকটি জাহাজ রওনা হলো। কানাডা সাইডের দর্শনার্থীদের রেইন কোটের রঙ লাল। আগ-পিছ করে দুটো জাহাজই এগোতে থাকলো একে একে সবগুলো জলপ্রপাতের কাছে নিয়ে গেলো। রেইন কোট তেমন কোন কাজেই লাগলো না, কানাডা ফলসের কাছাকাছি যেতেই মোটামুটি কাক ভেজা হয়ে গেলাম। ছবি-টবি তুললাম, ভিডিও করলাম কিন্তু পানির পতনের ফলে সৃষ্ট বাতাসে ভেসে বেড়ানো জলকণায় সব জল হয়ে গেল। প্রপাতের কাছাকাছি পানি পড়ার শব্দ আর জাহাজের রোলিং মোটামুটি একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করে। যারা বেশি এডভেঞ্চার পছন্দ করেন না তারা জাহাজের একেবারে সামনের দিকে দাঁড়াবেন না। আমাদের অবশ্য ভালই লাগছিল। বাচ্চারা বেশ মজা করলো, ওদের আনন্দের চিৎকারে আমরাও সামিল হলাম। আমাদের চিৎকার শেষ না হতেই জাহাজ পিছনের দিকে ফিরতে লাগলো। এত অল্প সময়ের প্রপাত দর্শনে মন ভরলো না। কিছু করার নেই আমাদের নির্ধারিত সময় শেষ তাই জাহাজ জেটির দিকে ফিরতে লাগলো। মন না ভরলেও এই ভ্রমণ মনে থাকবে যতদিন বেঁচে থাকবো।