মাহফুজ পারভেজের গুচ্ছ কবিতা

  • মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪.কম

ছবি: বার্তা ২৪.কম

স্বাধীনতার ইতিহাস

একদিন
কোনো একদিন
যুদ্ধে যাবার স্পন্দিত সাহসে
মানুষ বুকের আকাশে উড়ায় স্বাধীনতা...

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতা বুকের আকাশে
লাল হয় নীল হয়
আনন্দ ও বেদনায় উড়ে যায়
নিজের আকাশ থেকে মহামানবের মহাকাশে...

একদিন স্বাধীনতা বুকের আকাশে দ্রোহের সঙ্গীতে
একদিন স্বাধীনতা মানুষে মানুষে প্রেমের গীতে গীতে
ভালোবাসার একটি মহাকাশ
গেঁথে দেয় মানুষের হৃদয়ের মূলে...

বিজ্ঞাপন

ভালোবাসার সুনীল আকাশে স্বাধীনতা
এক দিগন্ত বিস্তারী পাখির উড়াল-
আমাদের মহাহৃদয়ের মহাজাগতিক ভ্রমণ প্রয়াস:
মুক্তির আলোয় আলোয় উজ্জ্বল ইতিহাস...

গজল

তাঁর কথা কেউ মনে রাখে নি
তাঁর কবরের উপর শেষ গোলাপটা কে, কবে রেখেছিল, কেউ জানে না
গোলাপের পাপড়িগুলো ভেসে ভেসে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে
বাতাসও সে খবর রাখে নি।

তবু তিনি আছেন সৌরভে
সুরের অনিন্দ্য মৌতাতে
মধ্যরাতের নিঃসঙ্গতায়
সঙ্গীতময় নেশার ভেলায়
বেদনার তীর ছুঁয়ে অস্তিত্বের উপকূলে
সঙ্গোপনের অদৃশ্য অদেখায়।

গালিব, মীর তাকি মীর, জোস, দাগ
উপদ্রুত উত্তর ভারতের বিরাণ কবরগাহ থেকে
তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন মুগ্ধতায়:

বেগম আখতার,
জীবন আর গজলের পার্থক্য না-জানা
পাখির মতো কাতর গাইতে থাকেন।

‘মালিকা-ই-গজল’ তিনি, তথাপি কত একাকী!

নন্দনতত্ত্ব

ফরাসি দার্শনিক জিল দ্যল্যোজ নান্দনিক কর্মের স্বরূপ নিয়ে কথা বলতেন:
‘যে কোনও সৃষ্টিকর্ম আসলে এক ধরনের প্রতিরোধ
ক্ষমতার বিরুদ্ধে
কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে
নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে।’
তাঁর ভাষায়: ‘নান্দনিক ক্রিয়া মানেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।’

ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে যেখানেই দমন-পীড়ন,আঘাত-আরোপ,
সেখানেই চিন্তাশীলদের নান্দনিক প্রকাশ
বৌদ্ধিক প্রতিরোধ
সুতীব্র সংক্ষোভ।

নন্দনতত্ত্ব যত না বিমূর্ত ও শৈল্পিক
তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও দ্রোহের:
মানুষের
অধিকারের।

নন্দনতত্ত্ব শূন্যগর্ভ দম্ভের বিরুদ্ধে পবিত্র চপোটাঘাত।

আউটসাইডার

তার তূণীরের অস্ত্রগুলো নিখুঁত ব্যবহারে গীতিকবিতা
শক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধিলাভ শেষে পরিণত প্রেমে
তার পুরোটা জীবনে পারদের আস্তরণ।
জলে যখন কখনও কখনও নিজের মুখ দেখা যায়
তখন জল থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি নিজের শরীরে তাকান
দেখার যা কিছু বাকি, দেখেন:

দুটি চোখ তাকে রক্ষা করে
পঙ্কিল নিউ নর্মালের পাঁক থেকে
পা-চাটা বৈশ্বিক জিহ্বার ছোবল আর
ঝকঝকে জুতোতে চুম্বনরত অনুগত ঠোঁট থেকে।

সবাই বলছে, তিনি খুব ভুল করছেন
অসামাজিক ও বিচ্ছিন্ন হতে হতে
অচল প্রাচীন মুদ্রার মতো মিউজিয়ামে যাচ্ছেন।

নির্বিকার তিনি তখন ক্যামুর ‘আউটসাইডার’ পড়ছিলেন।

অবদমন

ফ্রয়েডের সতর্কবাণী ছিল স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন:
‘অবদমনের ফলেই নানাবিধ উপসর্গের প্রাদুভাব’:
মনে
শরীরে
সংঘে
সমাজে।

প্রান্তিক জীবনে অবদমনজাত নানা আনুসাঙ্গিক উপসর্গ
অচল সমাজে চালাচ্ছে তাণ্ডব ও দ্বৈরথ
ইতিহাসে যুক্ত হচ্ছে নানা মাত্রা
খুলছে খিড়কি, বন্ধ হচ্ছে প্রধান ফটক।

একাকী কিছু কিছু নিঃসঙ্গ মানুষ
সৃষ্টির অন্তর্নিহিত প্রতিরোধে
পৃথিবীর কেন্দ্র ও প্রান্তে প্রান্তে
নৃশংস আক্রমণ ও হিংস্র রোষ ঠেলে ঠেলে:

রক্ত দিয়ে বানান করছে ‘অবদমন’
ইরেজারে মুছে দিচ্ছে ‘উপসর্গ’।

বেজান মাতর

বেজান মাতর কুর্দ মেয়ে
ভূমধ্যসাগরীয় সম্পন্ন গ্রামের ধনী ঘরে জন্ম নিয়েও
বসবাস করেন যে শরণার্থী শিবিরে
সেখানে তার মাতৃভাষা কুর্দিশ নিষিদ্ধ
তার যাবতীয় অধিকার স্থগিত
দেশ শত্রু কবলিত, পরাধীন
শৈশবে তার খেলা হয়নি, পড়া, গান, কবিতা হয়নি
স্বপ্ন দেখার বয়সে দেখেছেন মূর্তিমান আতঙ্ক
সৈন্যদল, আগুন, লুটপাট, বাস্তুচ্যুতি
শুনেছেন মৃতুধ্বণি, ধর্ষণের দানবীয় উল্লাস
বার বার অনুভব করেছেন জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ
পালিয়ে চলার অলাভজনক পেশা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

বেজান মাতর পালাতে পালাতে স্মৃতি, আত্মপরিচিতি হারিয়ে ফেলেছেন
দেশ নেই, নাগরিকতা নেই, ঠিকানা বিহীন কোটি মানুষদের একজন তিনি
স্বদেশ আর তাকে টানে না, ফিরে যাওয়ার আশা জাগায় না
তিনি শত শত শরণার্থী শিবিরের বিয়ারিং মানুষদের একজন হয়ে
হারিয়ে যেতে চান পৃথিবীর জনারণ্যে
পরিচয়-রহিত অন্ধকার বিবরে।

আমাদের সঙ্গে কখনও বেজান মাতর কিংবা তার মতো কারও দেখা হলে
আমরা তাকে ‘মানুষ’ ভেবে ভুল করবো
অথচ আস্ত একটি জীবন তিনি ‘মানুষ’ ছিলেন না
ছিলেন ‘শরণার্থী’।

পৃথিবী তার কাছে আবাসভূমি নয়, ছিল একখণ্ড নরক
প্রতিটি ক্ষণ তিনি ছিলেন বৈষম্য ও যন্ত্রণায় দগ্ধ।

বেজান মাতর, মানবসত্তা-লুপ্ত এক শরণার্থীর নাম!

আফগানিস্তান ২০২১

প্লেনের গায়ে-চড়া মানুষ পোকার মতো টুপটাপ খসে পড়ছে কাবুলের মাটিতে
ভয়ে, আতঙ্কে, গ্লানিতে ম্লান একবিংশের এই মানবিক পতন।
একটি তরুণী মৃত্যুর আগে জানালো:
‘আমি আমার প্রেমিকের রক্ত দিয়ে ট্যাটু বানিয়েছি
উদ্যানের সেরা গোলাপকে টেক্কা মেরেছে সে রং।’
একটি তরুণ মৃত্যুকে আলিঙ্গনের আগে প্রেমিকাকে বললো:
‘আমার কোমরবন্ধনী জড়িয়ে ধরো
আর জেনো, আমি তোমার চুম্বন ফেরাই নি।’

গোলাপ ও চুম্বন মাড়িয়ে দখলকৃত আফগানিস্তান
নিরবে সব দেখলো
পলাতক প্রেসিডেন্ট, মাকির্ন সৈন্যদল, পরাজয়, অপমান
দেখলো না দগ্ধ-হৃদয়ের নারীদের, শুনলো না তাদের গোপন কান্নাধ্বনি:

‘আমার শরীর সবুজ হেনা পাতার মতো
ভেতরে রক্তক্ষরণ, তরতাজা ও কাঁচা।’