পাওলো কোয়েলহোর ‘মাকতুব’
আমরা যাই করি না কেন আমাদের প্রতিটি কাজে যেন ভালো মানুষের প্রতিচ্ছবি থাকে। কারণ উচ্চ শিক্ষিত হলাম কিন্তু ভালো ও সৎ মানুষ হতে পারলাম না তাহলে তো সব শিক্ষা নিমেষেই বৃথা।
তাই একজন পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজন একজন সদগুরুর। গুরুর আধুনিক শব্দ ‘মেন্টর’ও বলা যায়। বিশ্ববিখ্যাত ব্রাজিলিয় লেখক পাওলো কোয়েলহোর ‘মাকতুব’ গ্রন্থটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।
‘মাকতুব’ শব্দটির অর্থ 'যা লেখা হয়েছে'। অর্থাৎ ভাগ্য। এর মাধ্যমে কেউ কেউ এমনও বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ সবকিছু আগে থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন, ফলে বান্দার কিছুই করার নেই। বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে একটি বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন, যা অন্য প্রাণীদের দেন নি। সেটি হলো ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতা। তবে, অজ্ঞতাবশত অধিকাংশ মানুষ কোনো কিছুর জন্য অন্ধভাবে ভাগ্যকে দোষারোপ করে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা উচিত যে, আমরা কতবার হোঁচট খেয়েছি সেটি বড় কথা নয়, আমরা কতবার উঠে দাঁড়িয়েছি এবং তারপর কতবার এগিয়ে চলেছি, সেটাই বড় কথা। আর এই প্রচেষ্টার উপরও আমাদের ভাগ্য বহুলাংশে নির্ধারিত হয়। সৃষ্টিকর্তা ভাগ্য লিখেছেন আমাদের জন্মের সাথে সাথেই। কিন্তু কেউ যদি তার মেধা, শ্রম, সততা দিয়ে ভাগ্য ফেরাতে চান তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাঁকে অবশ্যই সাহায্য করেন।
এইসব বিষয়ে 'মাকতুব’ বইটির গল্পগুলো অত্যন্ত ছোট কিন্তু গোছানো। প্রতিটি গল্পই নিয়ে যাবে একটি ভাবনার জগতে। পড়তে পড়তে চিন্তামগ্ন হতেই হবে। কোনো কোনো গল্প মনে ব্যাকুলতা সৃষ্টি করতে পারে। আবার কোনো গল্প চমকিত করে তুলবে নতুন কিছু ধারণা পাওয়ার আনন্দে। পাওলো কোয়েলহোর বিশ্বখ্যাত ‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটির মতো এই বইটিতেও রয়েছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। বইটির গল্পগুলো মূলত গুরু-শিষ্যের কথোপকথনের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছে। তারমধ্যে কয়েকটি কোয়েলহোর নিজস্ব সৃষ্টি। বাকিগুলো সারা পৃথিবীর গল্প ভান্ডার, লোককাহিনী থেকে সংগ্রহ করা।
গল্পে গুরু যেন তার শিষ্যকে প্রকৃতির মাঝেই শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন অবিরত। যেমন-
শিষ্য তার গুরুকে বলছেন, 'আমি দিনের বেশির ভাগ ব্যয় করি এমন সব চিন্তা করে, যেগুলো করা উচিত নয়, এমন সব করে, এমন সব জিনিস কামনা করি বা পরিকল্পনা করি যেগুলো করা উচিত নয়।'
তারপর গুরু শিষ্যকে তার বাড়ির পেছনে থাকা বনে নিয়ে গেলেন বেড়াতে। চলতে চলতে তিনি একটি গাছ দেখিয়ে শিষ্যকে জিজ্ঞেস করেন, সে গাছটি চেনে কিনা। শিষ্য জবাব দিলেন চেনে। এটি ছিল একটি বিষাক্ত গাছ। তাই শিষ্য গুরুকে বললেন, ‘এর পাতা যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে।’ গুরু তখন বললেন, 'কিন্তু যে এই পাতার দিকে কেবল তাকায়, তাকে সে হত্যা করতে পারে না।'
অর্থাৎ গুরু এখানে শিষ্যকে বোঝাতে চাইলে যে, ‘একইভাবে নেতিবাচক আকাঙ্ক্ষাগুলো কোনোই ক্ষতি করতে পারে না, যদি তুমি তোমাকে বশীভূত করতে না দাও সেগুলোকে।'
এই গল্পের মধ্যে লেখকের বার্তাটি হলো, কোনো মানুষই ষড়রিপুর (কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, হিংসা, মাংস) ঊর্ধ্বে নেই। কিন্তু এখানে একজন সদগুরুর কাজ হলো তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে শিষ্যকে ষড়রিপু থেকে বের করে স্রষ্টামুখী করে তোলা। গুরুর মানে হলো, পিতামাতা, শিক্ষক, বন্ধু, প্রেমিক। তিনি পিতামাতার মতো আদর, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা, শিক্ষকের মতো শিক্ষাদান, বন্ধুর মতো বন্ধুসুলভ আচরণ, প্রেমিকের মতো প্রেম বিলিয়ে অকাতরে জ্ঞান ও করুণার মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবে পরিণত করেন। আর শিষ্যের কাজ হলো ভক্তি, বিশ্বাস, বিনয় ও আদবের সাথে গুরুকে অনুসরণ করা। তাই শুধু একাডেমি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই ভালো মানুষ হওয়া যায় না, ভালো মানুষ হতে হলে সদগুরুর সান্নিধ্য লাগে। বইটিতে তেমনই কিছু শিক্ষণীয় গল্পে এসব আধ্যাত্মের আস্বাদ পাওয়া যায়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, 'সাহসিকতার সাথে তোমার পথে লড়াই করো, অন্যদের সমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে স্থবিরে পরিণত করার সুযোগ দেবে না।' গুরু শিষ্যকে বলছেন। আসলেই গুরু মানে, যিনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। যেমন বলেন, 'ঈশ্বর কখনো তোমার মাথায় প্রবেশ করবেন না। তিনি যে দরজা ব্যবহার করেন, সেটি হলো তোমার হৃদয়।' এভাবে গুরু প্রতিনিয়ত শিখিয়ে যাচ্ছেন শিষ্যকে। কখনো প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে আবার কখনো বিভিন্ন উপমা ব্যবহার করে।
সৃষ্টির মাঝে সেরা হলো মানুষ। তাই মানুষের মনের ভেতর বিরাজ করেন সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাই পবিত্র আল কোরআনুল কারিমায়। আল্লাহ বলেন, 'আমি তোমার শাহারগের (মূল ধমনি) নিকটেই আছি।' আরও বলা হয়েছে, 'আমি তোমার নফসের সঙ্গেই মিশে আছি।' পবিত্র হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া,সাল্লাম বলেছেন, 'মোমিনের হৃদয়ে আল্লাহ আরশ, যে নিজেকে চিনেছে, সে প্রভুকে চিনেছে।'
তাই আমাদের অন্তর বা হৃদয়কে পবিত্র রাখতে হলে সদগুরুবাদী দীক্ষা প্রয়োজন। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তা পবিত্র। আর যে অন্তর বা হৃদয় পবিত্র সেখানেই কেবল মহান পবিত্রসত্তা অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
'লেখো! লেখার মাধ্যমেই তুমি ঈশ্বর ও অন্যদের আরো কাছাকাছি হতে পারবে, তুমি যদি দুনিয়ায় তোমার ভূমিকা আরো ভালোভাবে জানতে চাও, তবে লেখো। তোমার আত্মাকে লেখায় নিয়োজিত করো, এমনকি কেউ যদি তোমার লেখা নাও পড়ে, তবুও লেখো। কাগজ-কলম জাদুর মতো কাজ করে। এগুলো যন্ত্রণা দূর করে, স্বপ্নকে সত্য করে, হারিয়ে যাওয়া আমাকে জাগিয়ে তোলে। কথার আছে শক্তি।' বইটির প্রেরণাদায়ক শক্তি এসব উক্তিতে নিগিত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি উক্ত কথাগুলো যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত তাদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে আসবে। এই বইয়েই গুরু আরে বলেন, 'কথা হল শক্তি। কথাই বিশ্বকে বদলে দেয়। মানুষকেও বদলে দেয়।'
আমি যদি ইতিবাচক কথা প্রকাশ করি, তবে তা আরো বেশি ইতিবাচক শক্তিকে আকৃষ্ট করব। যারা সত্যি আমার কল্যাণ চায়, তারা খুশি হবে। আর যারা কল্যাণ চায় না, তাদের কাছে যদি ইতিবাচক কথা প্রকাশ করি, তারা কেবল হিংসাই প্রকাশ করবে। এজন্য গুরু বলেন, 'তবে ভয় পেয়ো না। যারা শুনতে চায় তাদেরকে তোমার জীবনের ভালো ভালো বিষয় বলো। তোমার সুখের বিরাট প্রয়োজন রয়েছে বিশ্বের আত্মার।'
ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে গুরু বলেন, 'আমাদের সবার প্রয়োজন ভালোবাসার। কারণ এটি মানব প্রকৃতির অংশবিশেষ। খাওয়া, পান করা ও ঘুমানোর মতো এটি।' গুরু বুঝাতে চেয়েছেন, ভালোবাসা ছাড়া একাকী সুন্দর সূর্যাস্ত দেখাও তখন গুরুত্বহীন মনে হয়। কারণ পাশে এমন কেউ নেই যার সাথে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।'
এজন্য গল্পের ছলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, 'একাকিত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকো। এটি সবচেয়ে বিপদজ্জনক মাদকের মতোই আসক্তি সৃষ্টিকারী। সূর্যাস্ত যদি তোমার মধ্যে আর কোনো অনুভূতি সৃষ্টি না করে, তবে বিনীত হও, ভালোবাসার সন্ধান করো। আর জেনে রাখো, অন্যান্য আধ্যাত্মিক আশীর্বাদের মতো একে যত তুমি দিতে আগ্রহী থাকবে, বিনিময়ে তত বেশি পাবে।'
আরও বলা হয়েছে জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে। আপনি যদি জীবিত থাকেন, তবে আপনাকে হাত দোলাতে হবে, চারপাশে ঝাঁপ দিতে হবে, গোলমাল করতে হবে, হাসতে হবে, লোকজনের সাথে কথা বলতে হবে । কারণ, জীবন হলো মৃত্যুর ঠিক বিপরীত। মৃত লোক চিরদিন একই অবস্থায় থাকে। কিন্তু আপনি যদি খুবই শান্ত থাকেন, তবে বুঝতে হবে আপনি জীবিত নন। মানুষ কর্মের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকে, সে কর্ম হয় সৎকর্ম। এ কারণেই গুরুবাদীরা মনে করেন কর্মগুণেই মানুষ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। তাই গুরুবাদী শিক্ষাটাও কর্মভিত্তিক।
পাওলো কোয়েলহোর এই বইটি পড়তে পড়তে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বই ‘আলকেমিস্ট’ কথা মনে করিয়ে দিবে পাঠকে। সাথে সদগুরুর প্রয়োজনটিও অনুভব করবেন পাঠক। গুরুত্বপূর্ণ বইটির অনুবাদক মোহাম্মদ হাসান শরীফ আর প্রকাশক অন্যধারা। তিনি অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন 'মাকতুব'-এর কথাগুলি। যা চমৎকার একটি বিষয়ে পাঠকে পড়ার আগ্রহ জাগাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
শেখ বিবি কাউছার, প্রভাষক, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম।