ইরানের সাংস্কৃতিক মাধুর্য

  • আবুল খায়ের মোহাম্মাদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঐতিহ্যময় ইরান। সংগৃহীত

ঐতিহ্যময় ইরান। সংগৃহীত

পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থানে পরিপূর্ণ ইরানকে বলা হয় 'সাংস্কৃতিক মাধুর্য'র দেশ। 'সভ্যতার দোলনা' নামে খ্যাত ইরানে রয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত ২৩টি স্থাপনা। বিশ্বে আর কোনও দেশে এতো ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গৌরব নেই, যা আছে ইরানে।

ইরানের জনজীবনে, এমনকি পথেঘাটে দেখা যাবে উচ্চতর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। ধরা যাক ইরানের কোনও এক রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। হঠাৎই যেতে যেতে এক পথযাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট'র কাছে কীভাবে পৌঁছাব?’ সাগ্রহে লোকটি প্রত্যুত্তর দেবেন, ‘হাড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড' শেষ করে 'দ্য গ্রিন মাইল'। তারপরেই 'দ্য অ্যালকেমিস্ট!’

বিজ্ঞাপন

কী ভাবছেন, নিশ্চয়ই এই কথোপকথন দুই বইপাগলের, নয় তো নিতান্তই হেঁয়ালি? না, আসলে নয়। বরং অতি বাস্তব ঘটনা। ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’, ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’ বা ‘দ্য গ্রিন মাইল’— এসবই বিশ্ববিশ্রুত সাহিত্যের শিরোনামে রাস্তার নাম।

পশ্চিম-মধ্য ইরানের হামাজান প্রদেশের ছোট্ট শহর তাজবাদ সোফলা, যা স্থানীয় মানুষদের কাছে রসুলবাদ বলে এক জনবসতি। ঘটনাটি সেখানকার। সেখানে গোটা অঞ্চলজুড়ে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল মধ্যযুগীয় স্থাপত্য, নির্মাণ। ছোটো ছোটো টিলার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ছবির মতো রাস্তা। দু’ধারে বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি। এমন জায়গা পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ হবে— তাতে আর নতুন কী? কিন্তু এলাকাবাসীদের সাংস্কৃতিক উচ্চতার জন্যেও অঞ্চলটির বেশ আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে।

জনসংখ্যা একেবারে অল্প হলেও, গ্রামের সকলেই আদ্যন্ত বইপাগল। শুধু ইরানি কিংবা আরবি নয়— সমস্ত ভাষার বই-ই সমান প্রধান্য পায় এই ছোট্ট জনবসতিতে। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের জন্য রয়েছে একটা আস্ত লাইব্রেরিও। সেখানে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন ভাষার প্রায় ৬ হাজার বইয়ের সংগ্রহ। ভাঁটা পড়ে না পড়ুয়াদের ভিড়েও। আর পর্যটকরাও আসেন ভিড় করে।

নিজেদের বইপ্রেমী এবং ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যানুযায়ী গড়ে তুলতে অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছিল গ্রামবাসীরা। বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৯ সালে রসুলবাদের বাসিন্দারা ঠিক করেছিল গ্রামের সমস্ত রাস্তার আবার নতুন করে নামকরণ করা হবে। আর সেই নাম হবে বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন বইয়ের নামে।

কিন্তু বিশ্বের সেরা সাহিত্যের তালিকা প্রস্তুত করা তো মুখের কথা নয়। প্রত্যেকের পছন্দ যে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। এতএব উপায়? শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমেই ঠিক করা হয় ৩০টির রাস্তার নাম। এবং আশ্চর্যের বিষয় কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট গল্পের চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবিক মিল রয়েছে শহরের রাস্তাগুলোর।

নামগুলো মধ্যে রয়েছে পার্সি কবি শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বোস্তা’, পাওলো কয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’, স্টিফেন কিং-এর ‘দ্য গ্রিন মাইল’, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’, ফরাসি সাহিত্যিক অ্যান্টোনিও দে সেন্টের ‘দ্য লিটল প্রিন্স’-সহ একাধিক বিশ্বমানের সাহিত্যগ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের নামে একাধিক রাস্তার নামকরণ হয়েছে ফারসিভাষী দেশে ঠিক বাংলায়। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা পৃথিবীর অন্যত্র যে কোনো জায়গায় গেলেই দেখা যাবে এই রীতি। কিন্তু গ্রন্থের নামে রাস্তার নাম? গোটা বিশ্বে এমন দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুর্লভই বলা চলে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র হয়েও বিশ্বসাহিত্যের প্রতি উদার মনোভার ইরানের জ্ঞানস্পৃহা ও সাংস্কৃতিক বহুত্বের পরিচয়বাহী।

আসলেই ইরান একটি বহু-সাংস্কৃতিক দেশ। যেখানে অনেক উপজাতীয় এবং ভাষাগত দল রয়েছে। বৃহত্তম পারস্য (৬১%), আজারবাইজান (১৬%), কুর্দি (১০%) এবং লোরি (৬%)।

ইরান পৃথিবীর প্রাচীনতম কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বৃহৎ সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইরানের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের, যার সূচনা হিসেবে বলা যায় ইরানি প্লেট-এ অবস্থিত আজারবাইজানের মানইয়ান সভ্যতা। এর পর আসে জাবোলের শহর-ই-সোখতা এবং প্রাচীন জিরপ্ট সাম্রাজ্য, যা আকামেনিদ সাম্রাজ্য দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। পরবর্তীতে আসে পার্সিয়ান এবং সাসানীয় সাম্রাজ্য, যার পতনের মাধ্যমেই আধুনিক ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ইরানের অভ্যুদয় ঘটে।

পৃথিবীর উত্তরাংশ থেকে আর্যদের আগমনের পূর্বেই ইরানি প্লেটে অনেক প্রাচীন এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অগ্রগামী সভ্যতার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়, যদিও আর্য জাতির অনেক ইতিহাসই এখনও পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিকের কাছে অজানা রয়ে গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফল অনুসারে পারস্যের ইতিহাসের সূচনা ধরা হয়েছে প্যালিওলিথিক যুগের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১০০,০০০ বছর আগে।

৭ম শতাব্দীরে আরব মুসলিমেরা (৬৩৬ সালে) পারস্য সাসানীয় সাম্রাজ্যে আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে তারা এলবুর্জ পর্বত ও কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী সমভূমি ব্যতীত সমগ্র ইরান করায়ত্ত করে। ৬৫১ সালে তারা সাসানীয় সাম্রাজ্যের পূর্ণ পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। এর পর প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ইরান আরব ইসলামিক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে। এসময় মূল ইরানের বাইরে বর্তমান পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাতেও এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। ইসলামের খলিফারা প্রথমে মদীনা, ও পরবর্তীকালে সিরিয়ার দামেস্ক ও শেষ পর্যন্ত ইরাকের বাগদাদ থেকে ইরান শাসন করতেন।

৯ম শতাব্দীর শেষে এসে পূর্ব ইরানে স্বাধীন রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে এবং ১১শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাগদাদের আরব খলিফা ইরানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ইসলামের ইরান বিজয়ের পর ইরানীরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করে। এর আগে বেশির ভাগ ইরানী সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম জরথুষ্ট্রবাদে বিশ্বাসী ছিল ও কিছু সংখ্যালঘু ইরানী খ্রিস্ট ও ইহুদী ধর্মাবলম্বী ছিল।

১০ম শতকের মধ্যেই ইরানের অধিকাংশ জনগণ মুসলিমে রূপান্তরিত হয় এবং এদের আধিকাংশই ছিল সুন্নী মুসলিম, তবে কেউ কেউ শিয়া ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন ধারা অনুসরণ করত। এদের মধ্যে ইসমাইলি নামের একটি শিয়া গোত্র এলবুরুজ পর্বত এলাকার রুদাবার অঞ্চলে ১১শ থেকে ১৩শ শতক পর্যন্ত একটি ছোট কিন্তু স্বাধীন রাজ্যে বসবাস করত। ১৬শ শতকের পর ইরানের বর্তমান জাফরি শিয়া ইসলাম-ভিত্তিক পরিচিতি গঠন করে।

গ্রিক পণ্ডিতগণ অঞ্চলটিকে পার্সিস (বর্তমান ইরানের একটি প্রদেশ ফার্স) বলে ডাকত এবং এ থেকে ইউরোপীয় ভাষায় অঞ্চলের নাম হয় পার্সিয়া, যা বাংলায় পারস্য নামে খ্যাত। ১৯৩৫ সালে ইরানের শাসক দেশটিকে কেবল 'ইরান' বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকে এখন এই নামেই সারা বিশ্বে দেশটি পরিচিত। ১৫০১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান শাহ বংশের রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে শাহ রাজবংশকে উৎখাত ইরানে ইসলামী বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে রাজতন্ত্র থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।