জাপানে ভালোবাসায় সিক্ত রবীন্দ্রনাথ

  • ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জাপানে রবীন্দ্রনাথ। সংগৃহীত

জাপানে রবীন্দ্রনাথ। সংগৃহীত

বিশ শতকের প্রথমার্ধে  রবীন্দ্র- ওকাকুরা সম্পর্ক  বাংলা, বাঙালি ও জাপানের সাথে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কারণ ওকাকুরা ছিলেন জাপানের জাতীয় জীবনের নবচেতনার ধারক ও বাহক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওকাকুরার কাছেই এশিয়াবাদ বা এশিয়ানিজম অথবা প্যান এশিয়ানিজম যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘প্রাচ্যভাতৃবাদ’ সম্পর্কে   এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওকাকুরার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক তৈরি হবার ফলে আমরা দেখতে পাই ক্রমাম্বয়ে অনেকের সাথেই ওকাকুরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা এবং প্রিয়ম্বদা দেবীর সাথে। তবে প্রিয়ম্বদা দেবীর সাথেই তাঁর সম্পর্ক অনেক বেশী গাঢ় হয়েছিল। বিশ শতকের প্রথমার্ধে মহিলা কবি প্রিয়ম্বদা দেবীর সাথে ওকাকুরার পরিচয় নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করে। একে অপরকে জানার মধ্য দিয়ে বাংলা এবং জাপানের সংস্কৃতির অনেক অজানা রহস্য উভয়ের সৃষ্টিশীল রচনার  মধ্য দিয়ে পাঠকের কাছে প্রকাশ পেয়েছিল।

প্রিয়ম্বদা দেবীর সাথে  ওকাকুরার পরিচয় ও দেখা হয়েছিল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর এক নৈশভোজে। প্রিয়ম্বদাকে  প্রথম দেখাতেই ওকাকুরার মনে হয়েছিল, শান্ত ও বিষন্ন, কোমল ও মৃদুভাষিনী, স্বামীপুত্রহীনা নিসঙ্গ প্রিয়ম্বদাকে একটি সূক্ষ্মরেখ ও বিরলবর্ণ জাপানী ছবির মতোই মনে হয়েছিল। শোনা যায়, শ্বেতকমল নামে তাঁর একটি ছবিও এঁকেছিলেন তিনি। তাঁদের দুইজনের মধ্যে নিয়মিত পত্র যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ওকাকুরার মৃত্যু পযন্ত তা বহাল ছিল। প্রিয়ম্বদা এবং ওকাকুরার লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষা এবং জাপানী ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে যে ভাব বিনিময়ের ইতিহাস শুরু হয় তা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ওকাকুরার সাথে বাংলা ও বাঙালির যে সম্পর্ক তৈরী হয় তা আমাদেও জাতীয় ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

ওকাকুরার সাথে পরিচিত ও সম্পর্ক স্থাপিত হবার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সুযোগ পেয়ে যান। জাপান যাত্রার কালে নানা রকমের ভাবনা কবির মনে বাসা বেঁধেছিল। কবি তাই কল্পনা কাব্যের রাত্রি কবিতায় লিখলেন:

আন্দোলিয়া ঘন তন্দ্রারাশি।

পীড়িত ভুবন লাগি মহাযোগী করুণাকাতর

চকিতে বিদ্যুতরেখাবৎ

তোমার নিখিললুপ্ত অন্ধকারে দাঁড়ায়ে একাকী

দেখেছে বিশ্বের মুক্তিপথ।

জগতের সে-সব যামিনীর জাগরূকদল

সঙ্গীহীন তব সভাসদ

কে কোথা বসিয়া আছে আজি রাত্রে ধরণীর মাঝে,

গনিতেছে গোপন সম্পদ

কেহ কারে নাহি জানে, আপনার স্বতন্ত্র আসনে

আসীন স্বাধীন স্তব্ধচ্ছবি-

হে শবরী, সেই তব বাক্যহীন জাগ্রত সভায়

মোরে করি দাও সভাকবি।

১৯১৬ সালের মার্চ মাসে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবার জাপান যাত্রা করলেন। তোশামারু নামের একটি মালবাহী জাহাজে করে যাত্রা শুরু হলো। কবির সহযাত্রী বলতে জাহাজে ছিলেন মাত্র কয়েকজন- কবি নিজে, এ্যান্ডুজ, পিয়ার্সন এবং মুকুল দে। জাহাজ ছাড়ার প্রাক্কালে কবির বেদনা ফুটে উঠল এভাবে- “বোম্বাই থেকে যতবার যাত্রা করেছি জাহাজ চলতে দেরি করে নি। কলকাতার জাহাজে যাত্রার আগের রাত্রে গিয়ে বসে থাকতে হয়। এটা ভালো লাগে না। কেননা, যাত্রা করবার মানেই মনের মধ্যে চলার বেগ সঞ্চয় করা। মন যখন চলবার মুখে তখন তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা, তার এক শক্তির সঙ্গে তার আর - এক শক্তির লড়াই বাধানো। মানুষ যখন ঘরের মধ্যে জমিয়ে বসে আছে তখন বিদায়ের আয়োজনটা এইজন্যেই কষ্টকর; কেননা, থাকার সঙ্গে যাওয়ার সন্ধিস্থলটা মনের পক্ষে মুশকিলের জায়গা–সেখানে তাকে দুই উলটো দিক সামলাতে হয়, সে একরকমের কঠিন ব্যায়াম। বাড়ির লোকেরা সকলেই জাহাজে চড়িয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল, বন্ধুরা ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে বিদায় দিলে, কিন্তু জাহাজ চলল না। অর্থাৎ, যারা থাকবার তারাই গেল, আর যেটা চলবার সেটাই স্থির হয়ে রইল; বাড়ি গেল সরে, আর তরী রইল দাঁড়িয়ে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযাত্রী মুকুলদের লেখা থেকে জানা যায় জাপান যেতে প্রায় একমাস সময় লেগে যায়। জাপানের কোবে  বন্দরে কবিকে  অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ইয়োকোহামা টাইকান, পেন্টার কাটসুকু, কানো, কাওয়াগুচি প্রমুখ। মুকুলদে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ''১৯১৬ সালের মার্চ মাস। জাপান যাত্রার সূচনা হল ‘তোশামারু’ নামের একটি মালবাহী জাহাজে। সেই জাহাজে মানুষ-যাত্রী বলতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অ্যান্ড্রুজ, পিয়ার্সন ও মুকুল দে  এই চারজন মাত্র। জাহাজে অনবরতই টনটন লোহা-লক্কর, পাটের বস্তা বোঝাই হচ্ছে। অনেক বন্দরেই জাহাজ ভিড়ছে। মালবাহী জাহাজ বলে বন্দরে বন্দরে তার মাল তোলর, মাল খালাস করার আর বিরাম নেই। কাজেই জাপানে পৌঁছাতে সর্বসাকুল্যে একমাস লেগে গেল। রবীন্দ্রনাথের আগমনবার্তায় জাপানে রটে গেছে যে ‘সেকেন্ড বুদ্ধ’ আসছেন তাই বন্দরে বন্দরে সর্বত্র হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। জাপানের ‘কোবে’ বন্দরে রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনার জন্য জাপানের বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্টিস্ট ইয়োকোহামা টাইকান, পেন্টার কাটসুকা এছাড়াও শান্তিনিকেতনের জুজুৎসু শিক্ষক কানো আর জাপানের প্রিন্ট কাওয়াগুচি।''

জাপান যাত্রায় কবিগুরুকে ঝক্কি ঝামেলাও কম পোহাতে হয়নি। সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়লেও  কবি তার নিখুত বিবরণ দিয়েছেন। জাপানি মাল্লারা ছুটোছুটি করছে কিন্তু তাদের মুখে হাসি লেগেই আছে। তাদের ভাব দেখে মনে হয়, সমুদ্র যেন অট্টহাস্যে জাহাজটাকে ঠাট্টা করছে মাত্র; পশ্চিম দিকের ডেকের দরজা প্রভৃতি সমস্ত বন্ধ তবু সে - সব বাধা ভেদ করে এক - একবার জলের ঢেউ হুড়মুড় করে এসে পড়ছে, আর তাই দেখে ওরা হো হো করে উঠছে। কাপ্তেন আমাদের বারবার বললেন, ছোটো ঝড়, সামান্য ঝড়। এক সময় আমাদের স্টুয়ার্ড্ এসে টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে এঁকে ঝড়ের খাতিরে জাহাজের কী রকম পথ বদল হয়েছে, সেইটে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলে। ইতিমধ্যে বৃষ্টির ঝাপটা লেগে শাল কম্বল সমস্ত ভিজে শীতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। আর কোথাও সুবিধা না দেখে কাপ্তেনের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলুম। কাপ্তেনের যে কোনো উৎকণ্ঠা আছে, বাইরে থেকে তার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলুম না।”

জাপান যাবার পথে কবিগুরু সকল নৈর্সগিক চিত্র অকপটে তুলে ধরেছেন। হংকং বন্দরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি গুরু লিখেছেন, “মেঘ বৃষ্টি বাদল কুয়াশায় আকাশ ঝাপসা হয়ে আছে; হংকং বন্দরের পাহাড়গুলো দেখা দিয়েছে, তাদের গায় বেয়ে বেয়ে ঝরনা ঝরে পড়ছে। মনে হচ্ছে, দৈত্যের দল সমুদ্রে ডুব দিয়ে তাদের ভিজে মাথা জলের উপর তুলেছে, তাদের জটা বেয়ে দাড়ি বেয়ে জল ঝরছে। এণ্ড্রুজ সাহেব বলছেন, দৃশ্যটা যেন পাহাড়-ঘেরা স্কট্ল্যাণ্ডের হ্রদের মতো; তেমনিতরো ঘন সবুজ বেঁটে বেঁটে পাহাড়, তেমনিতরো ভিজে কম্বলের মতো আকাশের মেঘ, তেমনিতরো কুয়াশার ন্যাতা বুলিয়ে অল্প অল্প মুছে ফেলা জলস্থলের মূর্তি।”

জাপানে পৌঁছে ওসাকা মহানগরীর টেন্নেজা হলে ১ লা জুন তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অখন্ডনীয় যুক্তি ও জ্ঞানপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। জাপানী দৈনিক ওসাকা আসাই সিম্বুন পত্রিকার  ৩রা জুন সংখ্যায় রবীন্ধনাথ ঠাকুরের বক্তৃতার প্রশংসা করে লিখলেন,  “যে মুহুর্তে স্যার রবীন্দ্রনাথ ভাষণ আরম্ভ করেন, সেই বিপুল জনসভা একেবারে শ্বাসরুদ্ধ নি:স্তব্ধতায় পরিণত হয়। সমগ্র শ্রোতৃমন্ডলী তাঁর সুললিত সুমিষ্ট কোকিলবিনিন্দিত কন্ঠস্বর শ্রবণে মুগ্ধ ও আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। যখনই তিনি বুদ্ধদেবের দেশের সেই ‘মহাভারতের’ কথা উত্থাপন করেন, যখনই তিনি ভারত ও জাপানের মধ্যে ভ্রাতৃভাবের উল্লেখ করিয়া কিছু বলেন, অমনই সভাগৃহ আনন্দ ধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠে।”  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি এমন বলেছিলেন যে তাঁর বক্তৃতায় জাপানীবাসী মুগ্ধ হয়েছিলেন?

বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সভায় জাপানী সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণীয় অংশগুলোকে চিন্তার কারণ বলে উøল্লেখ করেছিলেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, জাপান কি করিয়া নিজস্ব সভ্যতার ধারা ও মূলসূত্র অবিচ্ছিন্ন রাখিয়া পাশ্চাত্য সভ্যতাকে গ্রহণ করিবে?  কবি চেয়েছিলেন ভারত ও জাপানের মধ্যে ভ্রাতৃভাব চিরস্থায়ী হোক। তিনি জাপানী সংস্কৃতিতে ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের উদাহরণ টেনে বলেন, একদিন ভারত হতে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ জ্ঞানের ও সংস্কৃতির বর্ত্তিকা আনিয়া জাপানের চিত্তে যে শান্তি ও আনন্দের স্নিগ্ধালোক প্রজ্বলিত করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তৃতায় এক অপূর্ব্ব অনুপ্রেরণা দিয়াছিলেন। তাঁর আশঙ্কা - কেমন করে আমরা পাশ্চাত্ত্য দেশের আত্মঘাতী সভ্যতার মোহ হতে নিজেদের রক্ষা করব? কেমন করে এই জাপান হাজার বছরের সৌন্দর্য  ও সৌহার্দ্দ্যরে ধারা রক্ষা করে শান্তি ভোগ করতে পারবে? কেমন করে জাপানীরা প্রকৃতির পূর্ণ মহিমা অন্তরে ধারণ করে মানব হিতে আত্মনিয়োগ করবে? কবির এই বক্তৃতায় জাপানী কবি য়িওনে নোগুচী দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।

প্রাণের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন,  “আমিও একজন কবি এবং সাহিত্য-ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সমব্যবসায়ী, আমি তাঁহার রচিত গানগুলি পাঠ করিয়া পরমানন্দ লাভ করি, সেগুলি এমনই শব্দ প্রাচুর্য্যে ভরা, এমনই স্বাভাবিক, এমনই সহজে প্রাণস্পর্শ করে, এমনই মনোভাব উদ্দীপক, এমনই চমকপ্রদ যে, তাহা পাঠে চিত্ত আনন্দে নৃত্য করিয়া উঠে। রবীন্দ্রনাথ আমাদেও আরো শিখাইয়াছেন যে, আমরা কেমন করিয়া সরল মনের কথায় গানের সুর দিয়া আমাদের সাহিত্যকে পুনর্গঠন করিতে পারিব।”

জাপানের কবি য়িওনে নোগুচী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাতে য়িওনে নোগুচী প্রাণের অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন-

Oh! To have thy song without

Arts rebellion.

To see thy life gracing a simple

Force that is itself creation.

Though stooped down from high throne

To sit by people in simple garb and speech.

১৯১৬ সালের নভেম্বর মাসের মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপানের বক্তৃতার প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিত্বের প্রতি জাপানের বিদ্ধজ্জনের শ্রদ্ধা উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথমবার জাপান সফরে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের সম্মুখে মেসেজ অব ইন্ডিয়া টু জাপান এবং স্পিরিট অব জাপান শীর্ষক দুটি বক্তৃতা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতার প্রশংসা করে জাপানী কবি নোগুচী লিখেছিলেন,  “বিদেশীয়ের কন্ঠে এই সুললিত প্রাণস্পর্শী বাক্যাবলী প্রতিটি শ্রোতার চিত্তে এক গভীর ভাবের উদয় করিয়াছিল, তাঁহার সুমিষ্ট ভাষা ও বাক্য প্রতিজনের হ্নদয়ে আনন্দ ও শান্তির প্রবাহ বহাইয়া দিয়াছিল। ক্ষণিকের জন্য যেন মহানগরীর সমস্ত কলরব কর্মতৎপরতা মহামন্ত্রের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া গেল, সেই ইট কাঠের রুক্ষ সভাগৃহ একটি মনোহর শান্তির আশ্রমে পরিণত হইয়া গেল।”

কোবে, ইয়াকোহামা সহ জাপানের মহানগরীতে রবীন্দ্রনাথের বিপুল সম্বর্ধনার আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। কবি যেখানেই যান সেখানেই ভক্তি বিনত চিত্তে কবিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। তবে কবিকে সবচেয়ে বড় সম্বর্ধনা দেয়া হয় টোকিও শহরের উয়েনো উদ্যানে। এই সম্বর্ধনায় জাপানের দুইশত বিশিষ্ট জ্ঞানী ও গুণীজনেরা বাঙালি কবিকে অভিনন্দিত করেন। যাঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা, শিক্ষা মন্ত্রী ডা: টাকাটা, কৃষি বিভাগের মন্ত্রী কোনো, ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ডা: ব্যারণ ইয়মকাউ, টোকিও নগরের প্রধান নাগরিক সহ প্রমুখ বিদগ্ধ গুণীজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অভ্যর্থনার বিবরণ কোবে হ্যারল্ড দৈনিক পত্রিকাতে ছাপা হয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতি কাউন্ট ওকুমা জাপানী ভাষায় অভিনন্দনপত্র পাঠ করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর প্রত্যুত্তর দেন। এভাবেই কবি গত শতকের গোড়ার দিকে বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখেন। কাউন্ট ওকুমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা ভাষায় বক্তৃতা শুনে চমৎকৃত হন এবং কবিকে উচ্ছ্বসিত ভাষায় প্রশংসিত করেন।  জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ তার বিশ্বভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে লিখেছেন,  “কাউন্ট ওকুমা রবীন্দ্রনাথের বাঙ্গলা অভিভাষণের সুললিত ভাষা ও স্বরে মুগ্ধ হইয়া কবির সান্নিধ্যে গমনপূর্ব্বক সমাদর করেন। কাউন্ট ওকুমা ইংরাজি ভাষা জানিতেন না। তিনি রবীন্দ্রনাথের বাঙ্গলা অভিভাষণ শুনিয়া উহা ইংরাজি ভাষায় কথিত হইয়াছিল বলিয়া প্রথমে প্রশংসা করেন। ইহাতে সভায় এক হাস্যরসের অবতারণা হইয়াছিল। পরে তিনি যখন বুঝিলেন যে, কবি বাঙ্গলাতেই এই সুমিষ্ট ভাষণ দিয়াছেন তখন ওকুমা কবিকে আলিঙ্গন করিয়া বলেন আমার বুদ্ধের দেশের ভাষা এত মিষ্ট, এত মধুর!”  এভাবেই রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাংলা ভাষা জাপানীদের নিকট গ্রহণযোগ্য মর্যাদার আসনে স্থান লাভ করে।

প্রথমবার জাপানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকনের জন্য এবং জাপানের জনজীবন স্বচক্ষে দর্শন করার জন্য তিনি নিভৃত পল্লীতে বাস করার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে কবিকে সহযোগিতা করেন জাপানী চিত্রকর হারারে। কবি জাপানী চিত্রকর হারারের অতিথি হয়ে তাঁর বাসভবন জাপানের পল্লী শহর হকুনে অবস্থান করেন। এজন্য আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান যাত্রীতে জাপানের জনজীবনের নৈসর্গিক দৃশ্য প্রতিফলিত হতে দেখি। শিল্পী হারারের সাথে তাঁর গভীরতর বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রীতি বন্ধনেরস্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ তাঁর ‘স্ট্রে বার্ডস’ বইটি জাপানী চিত্রশিল্পী হারারকে উৎসর্গ করেন। 

এরপর কবি ১০ মে ইয়াকোহামায় এবং ১১ মে তারিখে তিনি টোকিওতে জাপানের শিল্পকলাবিদ ব্যারন অকুরার অতিথি হন। এ সময় কবি বেশ কয়েকটি বক্তৃতা করেন। ১২ মে তারিখে টোকিওতে জোজোজী মন্দিরে দি ফ্রেন্ডস অব টাগোর সোসাইটীর উদ্যোগে কবির এক বিশাল সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কবি ‘ফিলজফি অব লিজার’ শীর্ষক বিষয়ে এক বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৩ মে তারিখে জাপান উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে তাঁর অভ্যর্থনা অনুষ্ঠিত হয় একইভাবে ১৫ মে তারিখে ইন্দো জাপানীজ এসোসিয়েশন আরো একটি বক্তৃতা করেন।  এরপর কবি ৮ জুন তারিখে ফরাসী জাহাজ অ্যানজার্স এ করে ফরাসী ইন্দোচীন হয়ে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন।

জাপানের প্রতি রবীন্দ্রনাথেরও ভালোবাসা কম ছিল না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে যখন জাপানে গিয়েছিলেন সে সময়ে ওকুরাইয়ামা ইনস্টিটিউটকে কাঠের তৈরী বাংলার নৌকার মডেল উপহার দিয়েছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জাপানীরা শ্রদ্ধা ও সম্মানের উচ্চ আসনে স্থান দিয়েছিলেন। এ কারণে কবির ভাষা বাংলাকেও তারা গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন। কবিগুরুর কাছে অনেকেই তাঁর হাতের লেখা ও স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন। খ্যাতিমান বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল জাপানের অনেক জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বহস্তে লেখা কবিতা দেখেছিলেন। রাধাবিনোদ পালের বন্ধু তাজিমার বাসায় বেড়াতে গেলে তিনি সেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি অংশ জাপানী তুলি দিয়ে লেখা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম সংবলিত একটি স্মারক দেখেছিলেন। স্মারকটিতে ৯ জুন ১৯২৪ তারিখ সংবলিত ছিল।  রবীন্দ্রনাথের কবিতার যে বিষয়টি উদ্ধৃতাংশ ছিল- “ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি, ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি” ।  এ থেকে বোঝা যায় জাপানীরা বাংলা ভাষা, বাঙালি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কত ভালোবেসেছিলেন। অন্য আরেক জাপানী মহিলার অটোগ্রাফে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বহস্তে লিখেছিলেন- “বিরহ আগুনে জ্বলুক দিবস রাতি, মিলনস্মৃতির নির্বাণহীন বাতি।”  

[ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপানে দেয়া বক্তৃতা স্থান পায় Nationalism in the West লেকচার সিরিজ গ্রন্থে। ১৯১৭ সালে ম্যাকমিলান এটি প্রকাশ করে। এর বিষয়সূচী ছিল:  Nationalism in the West; Nationalism in Japan; Nationalism in India; The Sunset of the Century.]