মহিলা কবি স্যাফো: বেদনা ও দ্রোহের অশ্রুবিন্দু
খ্রিস্টপূর্বাব্দের মহাকবি হোমারের সাথে পৃথিবীর পরিচয় 'ইলিয়াড' এবং 'ওডিসি' নামের দুটি মহাকাব্যের মাধ্যমে। গ্রীক সাহিত্যজগতে হোমার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে ধরা হয়। তবে এ গ্রীক মহাকবির জন্ম, মৃত্যু, জন্মস্থান, তিনি দেখতে কীরকম ছিলেন ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা তথ্য নিয়ে ইতিহাসবিদগণের কাছে তেমন কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই। তবে, হোমার একজন মহিলা কবির কথা বলেছিলেন। তার নাম স্যাফো। স্যাফো ছিলেন 'বেদনা ও দ্রোহের অশ্রুবিন্দু' সমতুল্য।
হোমার একটি গ্রীক শব্দ, যার অর্থ দুই রকম হতে পারে: অন্ধ ও জিম্মি। এ থেকে ধারণা করা হয় হোমার একজন গ্রীক ক্রীতদাস ছিলেন, যিনি আবার অন্ধও ছিলেন। নামের অর্থ ছাড়াও হোমারের অন্ধত্বের প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় মেলে।
হোমারের সমকালের কবি স্যাফো। জন্মকাল ৬০০ থেকে ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়। হোমার তাঁকে অভিধা দিয়েছিলেন ‘নারী কবি’। তাঁর লেখা আলোকিত বলে বিবেচিত হলেও তীব্র সমালোচিত হয়। হোমার এই নারীকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন, যদিও উভয়েই বিবাহিত ছিলেন।
গ্রীক ধ্রুপদ সাহিত্যের অতি-উজ্জ্বল আলোকছটায় স্যাফোর কৃতিত্ব অনেকটাই আড়ালে চলে যায়। বরং বলা যায়, তাঁর সৃজনশীল কাজ গৌণ হয়ে দিগন্তে মিশে গেছে। কারণ, কৃর্তির চেয়ে চিরকালীন মুখরোচক বিষয় নারী। তাঁর কাজের চেয়ে তাঁকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করেছে সমকাল ও ইতিহাস।
অথচ আদিম জগতের তৎকালীন গ্রীক 'নগররাষ্ট্র' বা 'সিটি স্টেট'-এ নারীদের পক্ষে প্রায়ান্ধকার যুগেও নিসর্গ, কুসুমকোমল প্রেম ইত্যাদি নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক, নান্দনিক কবিতা লেখার বদলে স্যাফো লিখেছেন ব্যক্তিসত্তা উন্মোচনের কথা। নিজেকে বিকশিত করার অতি জরুরি ও ব্যক্তিগত বিষয়ও স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়।
দুঃসাহসে ভর করে হাজার বছর আগে স্যাফো বলেছেন, 'আই ডিজ়ায়ার অ্যান্ড আই ক্রেভ, ইউ সেট মি অন ফায়ার'! নারীলেখনীতে এসব সাহসী উচ্চারণ চিরকালীন গণ্য করা হয় নির্লজ্জতা রূপে। তাঁকেও এসব অপবাদ আর সমালোচনা বইতে হয়েছে।
অথচ শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে স্যাফো স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছেন, 'ভার্জিনিটি, ভার্জিনিটি/ হোয়্যার উইল ইউ গো, হোয়েন ইউ হ্যাভ লেফট মি/ আই শ্যাল নেভার কাম ব্যাক টু ইউ ব্রাইড/ আই শ্যাল নেভার কাম ব্যাক টু ইউ,।' পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে নির্জলা সত্যের এমন সাহসী উচ্চারণ বৈপ্লবিক হলেও তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কবির এই ঔদ্ধত্য মেনে নিতে পারে নি। তাঁকে মুখোমুখি করা হয় সমাজ, আইন ও নৈতিকতার।
নারীর প্রতি যে নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র প্রাচীন আমল থেকে চিত্রিত হয়েছে, তা অধিকাংশ সময়ই গ্রাহ্য করেনি সমাজ কাঠামো। নারীর অভিযোগ তলিয়ে না দেখে বিচার করেছে খোদ অভিযোগকারীর। বক্তা বা কবির বক্তব্য চেপে রেখে তাদেরকে দাঁড় করানো হয়েছে বিচারের কাঠগড়ায়।
স্যাফোর বহু শতাব্দী পরে মার্গারেট তাঁর 'অ্যাটউড দ্য হ্যান্ডমেডস টেল' রচনার জন্য এমন বিরোধিতার মুখে পড়েন সত্যনিষ্ঠ স্বীকারোক্তির কারণে। তাঁর রচনায় তিনি বলেছিলেন, 'কমান্ডারদের সঙ্গে একা-একা সময় কাটানো নিষেধ আমাদের। আমরা নিচু বা অভিজাত কোনো জাতেরই বেশ্যা নই। আমরা শুধুমাত্র দু’পেয়ে এক-একটি গর্ভ। পবিত্র রক্তবাহী শিরা। বীর্যবাহিকা।'
বিপ্লবের নামে কিংবা ফৌজি ছাউনিতে নিগৃহীত নারীদের মর্মন্তুদ কষ্টের সুরাহা না করে খোদ মার্গারেটকে করা হয় বিচারের সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রচলিত হওয়ার আগে সহস্র বর্ষের ইতিহাসে নারীর জন্য, নারীর পক্ষে লড়েছেন বহু নারী। সভ্যতার ইতিবৃত্তে যাদের নাম জ্বলজ্বল করছে 'বেদনা ও দ্রোহের অশ্রুবিন্দু'র মতো