স্মৃতি-বিস্মৃতির ক্যানভাসে অধ্যাপক আহমদ কবির

  • তাশরিক-ই-হাবিব, অতিথি লেখক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অধ্যাপক আহমদ কবির

অধ্যাপক আহমদ কবির

গত বছরের (২০২০) মে মাসে আনিসুজ্জামান স্যার চলে গেলেন। বছরের শেষদিকে ফেসবুক মারফত খবর পেলাম, আহমদ কবির স্যার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। মনটা কুঁকড়ে উঠেছে, দুঃসংবাদটি জেনে। কয়েক বছর আগে স্যারের ভাই মৃত্যুবরণ করলে তিনি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে এ ক্যাম্পাসে ১৯৯৯ সালে প্রথম আসি ছাত্র হিসেবে। প্রথমে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হলেও পরের বছর  আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলা বিভাগে  ভর্তি হই। তখন থেকেই স্যারকে চিনতাম, বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। তবে তা একপর্যায়ে আরও প্রগাঢ় হয়। কারণ আমাদের বিএ অনার্সের পরীক্ষা কমিটিতে স্যার সভাপতি হিসেবে ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

ফলে অনার্সের  চার বছর বাধ্যতামূলকভাবে স্যারের মুখোমুখি আমাকে দুরুদুরু বুকে শুকনো গলায় বসতে হয়েছে। মানে, প্রতিবারই সেই বছরের বাৎসরিক চূড়ান্ত পরীক্ষার লিখিত অংশ শেষ হলে আমি উৎকণ্ঠিত থাকতাম। কারণ এবার মৌখিক পরীক্ষার পালা। স্যারের রুমে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত। সেখানে বসার ব্যবস্থা এমনভাবেই করা হত, যে সভাপতির মুখোমুখি পরীক্ষার্থীকে বসতে হত। প্রচণ্ড ভয় পেতাম এ পরীক্ষাকে। ভয়ের জন্য জানা  প্রসঙ্গও ভুলে যেতাম কখনো কখনো। কিন্তু স্যারের দিক থেকে বরাবর আন্তরিক, সহজ ব্যবহার পেয়ে এসেছি।

তিনি মানুষ হিসেবে মিশুক, আন্তরিক ও প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু তা কখনোই রাশভারী বা দাপুটে ধরনের ছিল না। নিজের সম্মান বজায় রেখে চলতেন। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বিভাগের করিডোরে দেখা হলে নিজে থেকে হাসি মুখে কুশল জানতে চাইতেন।

ফলে আমরা যারা  স্যারকে দেখে সমীহবশত সরে দাঁড়াতাম, তারা কিছুটা সহজ হতাম। স্মিত হাসি হেসে স্যার কথা বলতেন। মিশুক স্বভাবের গুণে তিনি ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপারে অনন্য ছিলেন। জোর করে তাদের কাছে দাপট দেখানোর মানসিকতা স্যারের একেবারেই ছিল না। অত্যন্ত রুচিশীল ও সৌখিন মানুষ ছিলেন তিনি। কত  স্মৃতিই যে একসঙ্গে ভিড় করছে, মনে!

স্যারকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম বিএ অনার্সের তৃতীয় বছরে। তিনি ৩০২ নং কোর্স পড়াতেন। সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক কোর্স ছিল এটি। প্রথম অংশে ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যতত্ত্ব। এতে ছিল প্লেটো, এরিস্টটল, হোরেস ও লঙ্গিনুসের সাহিত্য ভাবনা। দ্বিতীয় অংশে ছিল সংস্কৃত সাহিত্যতত্ত্ব। এতে ছিল কবিতা সম্পর্কিত সংস্কৃত মতবাদসমূহ। ধ্বনিবাদ, রসবাদ, গুণবাদ, শব্দার্থবাদ, রীতিবাদ, অলংকার তত্ত্ব, বক্রোক্তিবাদ প্রভৃতি পড়াতেন স্যার।

বলতে দ্বিধা নেই, এ কোর্সটি পুরো অনার্সের চার বছরের সবগুলো কোর্সের মধ্যে কঠিনতম কোর্স ছিল। তবে স্যার বিষয়গুলো যথাসাধ্য সহজভাবে দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতেন। চতুর্থ বর্ষে স্যারকে আবার পেয়েছিলাম কোর্সশিক্ষক হিসেবে। তিনি পড়াতেন ৪০১ সংখ্যক কোর্স - সাহিত্য সমালোচনার ধারা। এর দুটি অংশ ছিল। পাশ্চাত্য অংশ ও বাংলা অংশ।

পাশ্চাত্য অংশে আমাদের পড়তে হয়েছে নিউ-ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম, নেচারালিজম, মার্কসিজম, ফ্রয়েডিজম, ফেমিনিজম, মডার্নইজম, পোস্ট-মডার্নইজম,  ইন্টার-ডিসিপ্লিনারী ক্রিটিসিজম প্রভৃতি।

বাংলা অংশে পড়তে হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব, মুনীর চৌধুরী প্রমুখের প্রবন্ধ। সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের ভাবনা স্যার গুছিয়ে পড়াতেন। এত বড় সিলেবাস পড়তে হিমশিম খেলেও পরীক্ষার ভয়ে বিকল্প ছিল না।

ফল ভালো হয়েছে, স্যারের কোর্সে। এম এ শ্রেণিতে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীম উদদীনের সাহিত্যকর্ম পড়াতেন। নজরুলের কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ পড়াতেন। জসীমউদদীনের কবিতা ছিল এ কোর্সে। নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের পরিচয় তাঁর বক্তৃতায় গল্পের মতো মনোহর মনে হত। ফলে এ কোর্সটিতেই আমরা সবচেয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। আগের দুটি কোর্সের তুলনায় এটি ছিল অমৃত। সাহিত্যের সমালোচনা ও মতবাদ যদি কুইনাইন হয়, তবে এ কোর্সটি নিঃসন্দেহে অমৃত!

আহা! সেসব দিনের কথা মনে আছে, ধবধবে পাঞ্জাবি, পায়জামা ও চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা পরিহিত স্যার কী গভীর মনোযোগেই আমাদের নজরুলের রোম্যান্টিক কবিতাগুলো নিয়ে আলাপ করতে করতে নার্গিস আর আশালতা সেনগুপ্ত বা দুলীর সঙ্গে  সম্পর্কের বয়ান করে চলেছেন! বাস্তবে তিনি আর এ দুনিয়ায় নেই। নিকষ রাতের আঁধারে ঘুমিয়ে পড়লেন কর্কট রোগের কবল থেকে মুক্ত হয়ে, পরিজন-প্রিয়জঙ্কে ছেড়ে! বাংলা বিভাগ ক্রমশ অভিভাবকশূন্য হয়ে যাচ্ছে!

বিভাগের কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতিমান শিক্ষক ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিশেষজ্ঞ আহমদ শরীফ স্যার ছিলেন তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা বিভাগ সম্পর্কেও তিনি লিখেছেন। এটি তাঁর লেখার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি প্রমথ চৌধুরীকে খুব পছন্দ করতেন।  তিনি প্রথম চৌধুরীকে 'কলা কৈবল্যবাদী' (আর্ট ফর আর্টস সেক) হিসেবে মূল্যায়ন করতেন।

এ ব্যাপারে বিভাগের আরেকজন শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর মতভেদ ঘটেছিল। ব্যাপারটি সহজে মেটেনি। বাদ-প্রতিবাদের এ ঘটনা কখনো মৌখিক কোন্দল বা বাগাড়ম্বর ছিল না। বরং দুজন শিক্ষকই তাঁদের অভিমত ও চিন্তাকে বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধের কাঠামোতে মূল্যায়ন করেছিলেন। বিভাগ থেকে প্রকাশিত 'সাহিত্য পত্রিকা'য় তা পরপর তিনটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

ছাত্র হিসেবে এসব ব্যাপারে জানতে, পড়তে হয়েছে। স্যারের ব্যক্তিত্বে একটি ব্যাপার বরাবর খেয়াল করেছি। তিনি যত জানতেন, তা ছেলেমেয়েদের  বক্তৃতায় জানাতেন। কিন্তু লিখতে তেমন পছন্দ করতেন না। একারণে স্যারের লেখা বই ও প্রবন্ধ সংখ্যায় কম। তবে যা লিখতেন, তা ছিল নিখাঁদ, নিরেট। এ ব্যাপারে স্যারের একটি প্রিয় বাক্য ছিল। এটি ছিল প্রমথ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধের বাক্যবিশেষ - "বালা গালা ভরা হলে চলে, কিন্তু আংটি নিরেট হওয়া চাই"। ব্যক্তি স্বভাবেও তিনি এ আদর্শেই স্থিত ছিলেন।

কোনো ধরনের কপটতা, ভড়ং, লোকদেখানো ব্যাপার তিনি মোটেই সহ্য করতেন না। নিজের অভিমত প্রকাশে তিনি অকুণ্ঠ ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। কে কি ভাববে, তা ভেবে বিচলিত হবার মানুষ তিনি ছিলেন না। দশবার ভেবে তবেই তিনি কথা বলতেন। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে তিনি কাউকে আকাশেও তুলতেন না, কাউকে পায়ের নিচেও দলতেন না। নিজের আচরণে এমন পারিপাট্য বজায় রাখতেন যে কেউ তাঁকে দেখলেই বুঝতে পারত, কোন কথা তাঁকে বললে জবাবে তিনি কী বলবেন। এযুগে এমন মানুষ বিরল!

২০১৮ সালের অক্টোবরের এক দুপুরে স্যারের সঙ্গে কলাভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে দেখা হয়েছিল। বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে আসতেন। সেই দুপুরে আমার এমফিল থিসিসের গ্রন্থিত রূপ বইটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। কারণ কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। শিক্ষক হিসেবে তিনি সবসময় একটি কথা বলতেন। যেন পড়ালেখা করি নিয়মিত, লেখি আর ছেলে-মেয়েদের দিকে খেয়াল রাখি। তাহলেই আর কিছুর প্রয়োজন হবে না, শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনে।

আহা, এমন শিক্ষক, এমন অভিভাবককে আর কখনো দেখব না! তিনি অপার্থিবলোকে চির শান্তিতে থাকুন!

তাশরিক--হাবিব, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদালয়, সম্পাদক, 'পরান কথা' সাময়িকী