দারাশিকোহ ও মুঘল পরিবারিক বিন্যাস

  • ড. মাহফুজ পারভেজ,অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দারাশিকোহ, যাকে দারাশুকাহ নামেও অভিহিত করা হয়, তিনি সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী, তাজমহলের জন্য খ্যাত মমতাজ মহলের সন্তান। তিনি সম্রাটের প্রথম পুত্র ও তৃতীয় সন্তান, যার জন্ম রাজস্থানের আজমির শহরে ১১ মার্চ ১৬১৫ সালে। ফারসি ভাষায় দারার নামকরণ করেন স্বয়ং পিতা শাহজাহান, যার প্রথম অংশের অর্থ সম্পদশালী আর দ্বিতীয় অংশের অর্থ মালিক। অনেকের মনে প্রাচীন পারস্যের ক্ষমতাবান সম্রাট দারিয়ুসের আলোকে দারাশিকোহ নাম রাখা হয়, যার অর্থ ‘দারিয়ুসের প্রতিফলন’। ১৬২৭ সালের অক্টোবরে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হলে সম্রাট হন শাহজাহান। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই, ১৬৩৩ সালে তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাকে তার উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন এবং জ্যেষ্ঠকন্যা ও  জ্যেষ্ঠসন্তান জাহানারাকে মুঘল মহলের শীর্ষ পদে বসান। মুঘল পারিবারিক বিন্যাসে সম্রাটের এসব মনোনয়নের নানা রকম প্রকাশ্য ও গোপন প্রতিক্রিয়া হয়, যা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পায় ও রাজনৈতিক মেরুকরণের সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন: ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের পটভূমিতে দারাশিকোহ

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, মধ্যযুগের শাসন ঐতিহ্যে জ্যেষ্ঠজনকে উত্তরাধিকার নিযুক্ত করার বিষয়টি যেমন মোটেই অভিনব ছিল না, তেমনি এ সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ আইন বা রীতিও সুস্পষ্ট ছিল না। ফলে জ্যেষ্ঠ পুত্র সম্রাট হতেও পারতেন, না-ও হতে পারতেন। বিষয়টি শুধু নিয়োগের বিষয় ছিল না, ক্ষমতা হস্তগত ও দখল রাখার শক্তি ও সামর্থ্যরে উপরও নির্ভরশীল ছিল। উত্তরাধিকার রূপে দারাশিকোহর মনোনয়নের সময় এসব প্রশ্ন দেখা দেয়। তদুপরি, শাসনের উত্তরাধিকার রূপে বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক দারাকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তার উপযুক্ত রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণের যথেষ্ট কমতি ছিল। সম্রাট শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত দারা ও জাহানারা পরস্পরের মধ্যে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও অপরাপর ভাইবোন, যথা, শাহ শুজা, রওশানারা, আওরঙ্গজেব, মুরাদ বখশ, গওহারা বেগম প্রমুখের সঙ্গে ছিল তাদের দূরত্ব ও পার্থক্য। বরং ঐতিহাসিক বিবরণে দেখা যায়, রওশানারা ছিলেন আওরঙ্গজেবের পক্ষে ও তাকে ক্ষমতাসীন করতে তৎপর। অন্যান্য ভাইবোনগণও নিজ নিজ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ অনুযায়ী কাজ করেন। তবে অধিক সুবিধা ও সুযোগ পাওয়ায় দারার সঙ্গে সকলের বিরোধিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং মুঘল পারিবারিক রাজনীতির মেরুকরণে তিনি বলতে গেলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

উপযুক্ত রাজনৈতিক, সামরিক প্রশিক্ষণ না পাওয়া এবং পারিবারিকভাবে কিছুটা কোণঠাসা হলেও দারা এসব বিষয়ে সতর্ক ছিলেন না। তিনি বেড়ে উঠেন প্রাচ্য দেশের সম্ভ্রান্ত যুবরাজের আয়েশী জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে। গান, বাজনা, দর্শনচর্চা, শিল্প চর্চার মধ্য দিয়ে তার জীবন কাটে। রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতাহীন ছিল তার জীবনকাল। ফলে সকল সুযোগ-সুবিধা ও সমর্থন থাকার পরেও এবং রাজধানী দখলে থাকা সত্ত্বেও তিনি সেটা ধরে রাখতে পারেন নি। ভয়াবহ সঙ্কটকালে তিনি মানুষ চিনতে পারেন নি। যুদ্ধকালে সেনাবাহিনী পরিচালনার ক্ষেত্রে নৈপুন্য দেখাতে পারেন নি। ক্ষমতা ও বিজয়ের শীর্ষে অবস্থান করেও সব কিছু দারার হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনি নিঃস্ব, পলাতক ও বিপন্ন হয়ে প্রাণ হারান।

দারার জীবনের একমাত্র ব্যর্থতা, যা তাকে নিঃশেষ করে দেয়, তা হলো উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে দারা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন নি। আর মুঘল বা মধ্যযুগের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যুদ্ধজয় ও সামরিক ক্ষমতাগত যোগ্যতাই কর্তৃত্ব দখলের ও প্রমাণের একমাত্র মাপকাঠি রূপে বিবেচিত হয়েছে, যা ছিল সিংহাসন লাভ করার ও সুসংহত করার একমাত্র মাধ্যম। দারা এসব ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন নি। নিজের বিরুদ্ধে সামরিক ও রাজনৈতিক আঘাত সামলাতেও পারেন নি। অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণহীনতার জন্য সকল সুযোগ থাকার পরেও এবং পিতার সমর্থন ও বৈধ রাজকীয় নিয়োগ নিজ্ কব্জায় থাকার পরও তার নিদারুণ পরাজয় ও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। তিনি শুধু রাজ্য ও ক্ষমতাই হারান নি, করুণ মৃত্যুর মাধ্যমে প্রাণও হারান, যে কারণে তাকে চিহ্নিত করা হয় মুঘল ইতিহাসর ট্র্যাজিক নায়ক রূপে।

ঐতিহাসিক বিশ্লেষকগণ দারাশিকোহর জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মুঘল সম্রাট ছাড়া কোনো শাহজাদা এতো আলোচনা-সমালোচনার সম্মুখীন হননি, যেমন হয়েছেন দারাশিকোহ। কারণ, সম্রাট রূপে নিযুক্ত হয়ে, রাজধানী দখলে রেখে, বিশাল সৈন্যবাহিনী হাতে পেয়েও পরাজিত হওয়া বিস্ময়কর বটেই। এজন্য ভাগ্য যতটুকু দায়ী, গবেষকরা তারচেয়ে অনেক বেশি দায়ী করেছেন স্বয়ং দারাশিকোহকে। তবে ক্ষমতার প্রশ্নে পরাজয় তাকে ইতিহাস থেকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দেয় নি। তিনি তার দার্শনিকোচিত বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং মুঘল ঐতিহ্যের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক অংশীদার রূপে বিবেচিত হন।

ঐতিহাসিকগণ আরো মূল্যায়ন করেন যে, সম্রাট-পিতার প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণে সমগ্র সাম্রাজ্যে দারাশিকোহর স্তুতিতে ভরপুর হয়ে যায়, যার অধিকাংশই ছিল মিথ্যা ও অসাড়। কিন্তু এসব মিথ্যা প্রশংসা দারা শনাক্ত করতে পারেন নি। বরং এতে তিনি আপ্লূত হয়ে আত্মসুখ অনুভব করেন। পাশাপাশি মোসাহেবদের প্ররোচনায় তার মধ্যে অনেক কুপ্রবৃত্তি ও আত্মম্ভরিতার সৃষ্টি হয়। তিনি নিজের অজান্তেই পরিণত হন একজন গর্বিত, উদ্ধ্যত এবং মেজাজে ও কথাবার্তায় অসংযত মানুষে। যা ছিল তার মতো একজন দার্শনিকের জন্য অনুচিত, একজন প্রকৃত রাজপুত্রের জন্য অশোভন এবং সিংহাসন-প্রত্যাশীর জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অনভিপ্রেত ও অবিবেচনাপ্রসূত।

দারাশিকোহর অদ্বিতীয় ক্ষমতা, প্রচুর ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের হাতছানি তার মধ্যে কৌশল, সংযম, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি ও রাষ্ট্র পরিচালনার গুণাবলী সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। বরং অবাধে প্রাপ্ত তোষামোদ মুঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী রূপে তার স্বাভাবিক গর্ব, অহঙ্কার ও একগুয়েমীকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তারই একজন প্রশংসাকারী কর্তৃক কান্দাহারের ব্যর্থ অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনায় দারাকে অঙ্কিত করা হয়েছে একজন অযোগ্য, দাম্ভিক, আত্মগৌরবে প্রায়-অপ্রকৃতিস্থ এবং কর্মসম্পাদনে স্বৈরাচারী ও বালকসুলভ হিসেবে।    

আরও পড়ুন: দারা ও আওরঙ্গজেব: অভিন্ন শৈশব, বিপরীত চরিত্র

দারাশিকোহ: যিনি হতে পারতেন মুঘল সম্রাট

সম্রাট শাহজাহানের পছন্দের দারাশিকোহ