লেখক যখন শিরোনাম

  • জিয়া হাশান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল কালামের মোবাইল রাতে বালিশের পাশে অঘোরে ঘুমায়। তবে তার কণ্ঠ খোলা থাকে। পেট কিংবা মুণ্ডু টিপে রোধ করে রাখে না। কারণ রাতে অফ আবার সকালে অন—এই ঝুট-ঝামেলা হাত-বাড়িয়েও কখনো কালামরে নাগালে পায়নি। এ সুযোগে আজ সকালে মোবাইল বগল বাজায়। সাতটার আগেই বোল তোলে টুং টুং... টাং টাং.....। চোখ না খুলেই কালাম বালিশের বগলতলা হাতড়ায়।
তার সামাজিক চৌহদ্দি বাঁধা-ছাঁদায় সংকুচিত। কর গোনায় সীমিত তার দৈর্ঘ-প্রস্থ। তাই রাত নটা থেকে পরের নটা পর্যন্ত শোক-তাপের ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু মোবাইলে উঁকি মারে না। আজ না জানি আবার কার শোকের খবর। তার এ-বাসা ও-বাসা, এর কানে ওর কানে দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু রিসিভ করতেই হাবিবের ক্ষুব্ধ স্বর আঘাত হানে—‘তুই কি করছিস, অ্যাঁ? এত বড় নামিদামী প্রাইজ রিজেক্ট করেছিস? এনাউন্স করে, স্টেটমেন্ট দিয়া প্রত্যাখ্যান?’

এবার ঘুম লেঙ্গুর তোলে। তেপান্তরের মাঠে পালায়। কালাম উঠে বিছানায় বসে। তাতে অবশ্য হাবিবের ঝড়ে কোনো ব্যারিকেড পড়ে না। তবে প্রাথমিক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা, আউলা-ঝাউলা ভাবটা কাটে। সমাহিত রূপে বয়—‘তুই জানিস, ওরা এখন দেশের বিগেস্ট মিডিয়া মোঘল। ওদের আঙুলি হেলনে গভমেন্ট উঠবস করে। পাঁচ বছর পর পর একজনরে উঠায় একজনরে নামায়। তুই কিনা তাগো লগে লড়তে গেলি। তাগো মুখের উপর তাগো প্রাইজ না কইরা দিলি, অ্যাঁ?’
হাবিবের দম নেওয়া, তার ঝড়ের বাঁক বদলের ফাঁক গলে কালাম শুধু বলতে পারে—‘আমি তো ওদের প্রাইজের কাঙাল না। ওরা অ্যাড দিয়া বই চাইছিল। তাও জমা দেই নাই।’
‘তুই না দিছিস, তোর পাবলিশার দিচে। তারা তো তোর মতো ব্রাহ্মচারী না। তাগো তো এ জমানায় করে কেটে খেতে হয়।’
‘না না তাগো কাছেও খোঁজ নিচি। তারা এবার গোটা দশেক বই জামা দিচে। তার মইদ্যে আমারটা আছিল না।’
‘তাতে কী? ওরা জোগাড় করে নিচে। জানিস, কত শিল্পী-সাহিত্যিক ওদের ভাড়ায় খাটে। দেশের বড় বড় সব কবি-লেখক ওদের বার্ষিক পূজায় ধুপধুনো জ্বালে। আবার নিত্য-পূজায় মুখ নাড়ায়। তাগো চিনিস না? হাফ কলাম, ফুল কলাম ছবি ছাপে রোজ। ঝাঁক বাঁধলে আবার পাঁচ কলাম, সাত কলাম। আর তুই কিনা তাগো প্রাইজ ফিরাইয়্যা দিলি। এখন তোর কী হইবে? তোর লেখালেখিরে চাঙে তুলবে, দেহিস...।’
হাবিবরে আর থামানো যায় না। একবার ওর মুখ ছুটলে তাতে লাগাম পরানো মুশকিল। তাই কথারে ভিন্ন খাতে নেবার জন্যে তখন কালামের মুখ চালাতে হয়—‘তুই রিজেক্টের খবরটা কই পাইলি। আমি তো কাউরে কিছু কই নাই।’
‘ক্যান, এই তো পেপারে। সকালে মর্নিংওয়াকে গিয়া দ্যাখি ফার্স্ট পেইজে তোর ছবি। সেদিন অ্যানাউন্সমেন্টের লগের ছবিটাই। ভাবলাম আবার কোন প্রাইজ বাগাইলি? কিন্তু নিউজটা পড়ে তাজ্জব। আরে এত দেখি ওদের মুখের উপর পাঁচ কেজি থাপ্পড়। তাও আবার ঘটা করে ছাপছে। ওদের সাহস আছে বলতে হয়। তা-ই নাহ!’
অ্যাঁ, কালকে স্টেটমেন্টেটা দিয়া আইলাম, আজকেই তা ছাইপা দিছে? এমনিতে তো দেখি পাঁচ কলাম নিউজের প্রতিবাদ ছাপে সিঙ্গেলে। ফ্রন্ট পেইজের প্রতিক্রিয়া ব্যাক কিংবা ইনারে, ভেতরের কোনো কোনা-কাঞ্চিতে। কিন্তু ও যে বলছে ফ্রন্ট পেইজে যেখানে ঘোষণা ছাপছিল সেখানেই প্রত্যাখ্যান ছাপছে? এ যে দেখছি, নিজের মাথায় মুগুড়ের বাড়ির খবর ঢাক-ঢোল পেটানোর মতো। দেখা দরকার। কালাম তাই হাবিবরে লাইনে খাড়া রেখে পত্রিকা খোঁজে—‘লোপা! এই লোপা! দ্যাখো তো পত্রিকা দিচে কিনা?’
‘রান্নাঘর থেকে উত্তর আসে—না, দ্যায় নাই। হকারগুলা তো একেক জন নবাবজাদা। ইচ্ছা মতো পেপার দ্যায়। আইজ সাতটায় তো কাইল নয়টায়।’
কালাম তখন আবার হাবিবে ফেরে। ততক্ষণে সে আবার তার লাইনে পা দিচে—তুই রিজেক্ট করতে গেলি ক্যান? আমারেও একবার জিগাইলি না। এত বড় প্রাইজ কাউরে না বলে কয়ে প্রত্যাখ্যান করলি ক্যান, অ্যাঁ?’
‘না করে করব কী। আমি তো পুরস্কারের জন্য লিখি না।’
‘আহ! এটা তো কবি-সাহিত্যিকগো আপ্তবাক্য। শুনতে শুনতে কান পচে গ্যাচে। কিন্তু পুরস্কার পেলে আবার তর সয় না। তখন সুড়সুড় করে মঞ্চে হাজির হয়। কে দিলো, কোন জাতের পুরস্কার তা বিচারেরও ফুরসত মেলে না। তয় তোর দেখি কোনো চেইঞ্জ নাই। তুই দাদাঠাকুরই রয়ে গেলি। থাক তুই, আমি আর তোর সাথে নাই।’

বিজ্ঞাপন

ও তো কখনো সকালের পেপারের খোঁজে যায় না। নাস্তার টেবিলে পেলে চোখ দেয়, না পেলে না। আজ হঠাৎ দরকার পড়ল কেন? নিশ্চয়ই আজকে পেপারে ওর কিছু আছে। প্রাইজের খবর তো আগেই চাউর। তাহলে আর কী? লেখা? ওর কোনো লেখা আজ ছাপবে? দেখতে হবে কী লেখা। লোপা রান্নাঘরে নাস্তা বানানোয় হাত চালাতে চালাতে তাই বারবার দরজার পায়ের কাছে চোখ চালান করে। তার তলাপথেই তো প্রতিদিন পেপার মুখ বাড়ায়।
ওর লেখা এমনিতে কীসব উদ্ভট নামের ম্যাগাজিন-পত্রিকায় ছাপা হয়। বাসায় আনলে অবসরে কখনো-সখনো দেখা হয় ঠিকই কিন্তু পড়ার ফুরসুত কোথায়। তবে কাউরে বললে মুখ হা করে তাকায়। পেপারের নামটাও শোনে নাই কোনো দিন। এখন এত বড় পেপার, যারে নিয়া ঘরে ঘরে কাড়াকড়ি, তাতে ছাপা হলে সবার থোতা-মুখ ভোতায় ন্যাতাবে। ওর দিকে চোখ তুলবে—দ্যাখ, দ্যাখ, ওর বর বড় লেখক। প্রাইজ পাইছে। লাস্ট উইকে ওর বরের লেখা পড়ছি...।
লোপার হাতের রুটি তাই আজ সুডৌল সুগোলে হাসে। খোলায় খুন্তির আগায় মধুছন্দে নাচে। আবার পেট ফুলায়ে ঢোল বানায়। তার সাথে পাল্লা দিয়া আলুভাজিতে তেল-মসল্লা বিপুল বিক্রমে দাপায়।

কালাম যখন নাস্তার টেবিলে তখন সকালের দৈনিক উঁকি মারে। লোপা দরজার কাছে ছোটে। খোঁজে কোথায়, কী লেখা ওর ছাপা হলো? কিন্তু একি? লোপা চোখ রগড়ায়, তারপরও ফার্স্ট পেইজের অবিশ্বাস্য হেডিংটা পিছু হটে না। জ্বলজ্বলা করে তাকায়—‘সেরা বইয়ের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান’।
লোপার ব্রাহ্মতালুতে একঝাঁক অঙ্গার হানা দেয়। তারা ওর কণ্ঠস্বরও দখলে নেয়। ফলে উত্তপ্ত বাক্য ঝরে—‘তুমি এটা কী করছো? প্রাইজ ফিরাই্যয়া দিছো ক্যান?’
রুটির টুকরায় আলুভাজি গেঁথে মুখে পোরার ফাঁকে কালাম শুধু স্বীকারোক্তিতে যায়—‘হ, ওদের বলে দিছি এ প্রাইজ আমি চাই না। তোমাদের প্রাইজ নেব না।’
লোপা কারণ খোঁজার পথে হাঁটবে। জিজ্ঞাস করবে—‘ক্যানো তুমি ফিরাইয়্যা দিলা?’ কিন্তু কালামের এরকম ভাবনার সরল রাস্তায় লোপা আগায় না। বরং কোনো এক রহস্যময় কারণে ধারাবাহিক নাটকের মতো অনিঃশেষ এক পথ ধরে। দম নিয়া নিয়া একটার পর একটা এপিসোড গায়—‘তুমি বাসার কথা একবারও ভাবলা না। একসেট ভালো সোফা নাই। লোকজন এলে বসতে দিতে পারি না। ফ্রিজটা ছোট, পুরান হয়ে গ্যাছে।... বাবুর কথাও ভাবতে পারতে। ওরে একটা ভালো স্কুলে দেওয়া দরকার।... বিয়ার পর হানিমুনে তো গ্যালা না। আজকাল ব্যাংকক, কাঠমান্ডু না হলেও কক্সবাজার, বান্দরবানে যাবার কত সুন্দর সুন্দর প্যাকেজ...।’

নিত্য আলুভাজি চালালে কতক্ষণ আর তার চাকা সচল থাকে। দু’চারবার মুখে তোলার পর তাতে ঝং পাকড়ায়, গলা পথে হাঁটতে চায় না। কালামকে তখন পানিতে তারে সচলতায় আনতে হয়। দ্বিতীয় দফায় তা এনে লোপারে থামানোর চেষ্টায় মুখ খোলে—‘তুমি এক প্রাইজ দিয়া কতকিছু করতে চাইছিলা?’ লোপা তখন প্রমাণ দেয় এখন না হলেও তার বাপ-দাদারা একসময় ধান-পাটের কারবারি আছিল। তাই তার হিসাব পাকা—‘টাকা তো কম আছিল না। হিসাব কইরা খরচ করলে অনেক কিছু করা যাইত। তোমার জন্যেই কিছু হইল না। তোমার জন্যে এখন অফিসে মুখ দ্যাখাইতে পারব না। এ্যাই তো কালকেই, নিপা আপা, ফরিদা আপার কত গল্প। তারা কখনো সোনারগাঁও হোটেলে যায় নাই। বলরুমের চেহারা দেখে নাই। তাগো বলছি, তোমার প্রাইজ দেবার দিন নিয়া যাব। সব কিছু ঘুরাইয়্যা দ্যাখামু। এখন তাগো কী কমু? তাগো সামনে মুখ দ্যাখাই ক্যামনে?’
‘বলতে গ্যাছো ক্যানো? তোমারে বলতে বলছে কেউ?’
‘না বলার কী আছে? তারা দ্যাখে নাই? তারা তোমারে চেনে না? পিকনিকে দ্যাখছে না? সেদিন পেপারে তোমার ছবি দেখে ছুইটা আইছে। এত বড় প্রাইজ, মিষ্টি কই লোপা? মিষ্টি খাওয়াও... তুমি আমারেও জিগাইলা না। না জিগাইয়্যাই ফিরাইয়্যা দিছো। আসলে তুমি এ প্রাইজের যোগ্য না। কুত্তার প্যাটে যেমন ঘি হজম হয় না তোমারও তেমন এত বড় প্রাইজ নেবার মন নাই। তোমার মন এত ছোট, আত্মা এত হীন...।

লোপা আরো কত এপিসোডে গিয়া ইতি টানত বলা যায় না। কিন্তু তার আগেই বাধা পড়ে। বাড়ির দারোয়ান হন্তেদন্তে চড়ে এসে দরজায় হাজিরা দেয়—‘ছার! ছার!! আপনাগো বাসায় কি অইছে? খুন-জখম কিছু নাকি সুইসাইড...।’
কালাম লোপার দিক, লোপা তার স্বামীর মুখে উত্তর খোঁজে। একে অপরে দিক তাকায়। কিন্তু কিছু না পেয়ে প্রায় দ্বৈতকণ্ঠে দারোয়ানের শরণাপন্ন হয়—‘ক্যান, কী অইছে?’
‘ছার! গেটে টিভির লোকেরা আইছে। মৌচাকের নাহান ভিড়। লগে ক্যামেরা, গাড়ি কত কিছু। হগোলে আফনারে চায়। আফনার লগে কতা কইবে। তয় মুই এহনো গেইট খুলি নাই।’

ওহ! দেশে এখন শয়ে শয়ে টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা। তাদের বিশাল বিশাল একেকটা পেট। কোনোটার চব্বিশ ঘণ্ট, কোনোটার চব্বিশ পেইজ। কিন্তু এত খোরাক কই? তাই কুদ-কুড়ার লোভে, একটা কমেন্টের আশায় গেটে ভিড় লাগাইছে। কিন্তু ওদের দেবার মতো কিছু নাই। যা ছিল তা স্টেটমেন্টেই ফতুর। এখন আবার তারে ফুলাইলে-ফাপাইলে শ্রোতা-পাঠকের ভাগ্যে হাওয়া বৈ-তো কিছু জুটব না। কালাম তাই দারোয়ানরে নির্দেশ দেয়—‘যাও মালেক, নিচে গিয়া ওগো বলো, স্যারের কিছু বলার নাই। কোনো কমেন্ট নাই।’

রিপোর্টারদের চলে যাওয়া, গেট পরিষ্কার হওয়া, তারপর বার হওয়া। এত কিছু প্রায় ঘণ্টাখানেক খেয়ে নেয়। অফিসে কালামের লেট হয়ে যায়। টেবিলে বসার আগেই তাই পিয়নের খবর—‘স্যার, ডাকছেন। দুইবার সালাম দিছেন।’
অ্যাঁ! আরিফ সাহেব, ছাদেক সাহেব নিত্য লেটেও কোনো সালাম পায় না। আর তার একদিনেই দুইবার সালাম। না জানি আরো কত কিছু। শোকজও হতে পারে। ডেকে নিয়া হাতে হাতে হস্তান্তর। কালামরে তাই ব্যাগ চেয়ারের কাঁধে রেখেই ছুটতে হয়।

কালাম-দর্শন যেন স্যারের বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটায়। তিনি সশব্দে ফেটে পড়েন—‘আপনি কী করছেন? প্রাইজ রিজেক্ট? এটা তো ডিপার্টমেন্টের মুখে চুনকালি মাখানো, পিঠে ছুরি মারা। জানেন, আপনারে নিয়া বড় স্যারের সঙ্গে ফাইনাল ডিসকাস হয়ে গ্যাছে। স্যার চান আপনার জন্যে গ্র্যান্ড রিসিপশন। বিশাল সংবর্ধনা। তার সব অ্যারেজমেন্ট ফাইনাল। কেবল মিনিস্টারের টাইমটার অপেক্ষা। তারপরই তাক লাগানো আয়োজন।’
কালাম তখন মিনমিনায়—‘স্যার, আমি তো কোনো আয়োজনের কথা বলি নাই।’
‘বলাবলির কী আছে? এটা তো ডিপার্টমেন্টের ইস্যু। আমাদের সাকসেস। তারে সেলিব্রেট করতে হবে না? আগে কেউ এমন প্রাইজ পাইছে, অ্যা? ডিপার্টমেন্টের ভাগ্যে এখন বৃহস্পতির ছোঁয়া। বলতে পারেন তুঙ্গে। দেখেন নাই, কোয়াটারটা পেয়ে গেলাম কী ইজিলি। টুয়ান্টি ফোর আওয়ার ইউজের জন্যে গাড়ি অ্যাপ্রুভ হয়ে গ্যাছে। এখন শুধু প্রমোশনটা বাকি। মিনিস্টাররে আনতে পারলে সেটা নিয়াও ভাবতে হতো না। বাট আপনি তো দিলেন সব ভন্ডুল করে। গুড়ে বালি ছিটায়ে...।’
তখন তার কথায় হঠাৎ বাগড়া সাধে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের বা’পাশের ফোনটা। সে কিরিং কিরিং ডাকাডাকিতে নামে। শশব্যস্তে স্যাররে তাতে মনোযোগ দিতে হয়—...‘হ্যালো, হ্যালো... ইয়েস স্যার... স্যার আমার সামনে বসা স্যার... ডেকে এনে বুঝিয়ে বলছি স্যার...।’
ফোন শেষে স্যার আবার কালামে ফেরেন—‘শুনলেন তো বড় স্যারও আপনার ব্যাপারে কনসার্ন। স্টেটমেন্টটা দেখেই ফোন দিছেন। এটা এখন ডিপার্টমেন্টের প্রেসটিজ ইস্যু। বড় স্যার চান আপনি স্টেটমেন্টটা ফিরায়ে নেন। উইথড্র করেন। বলেন তো আমিই এডিটরের সঙ্গে কথা বলি।’
‘জ্বি না, স্যার। তা হয় না। ওদের আগেই বলছিলাম আমারে বাদ দিতে। আর কাউরে চুজ করতে। ওরা শোনে নাই। তাই স্টেটমেন্ট দিয়া রিজেক্ট করতে হয়েছে।’

দুই ॥
দুদিন পর দৌড়ে আসে শুক্রবার। অফিস নাই, সকালে কালাম তাই বাসার দৈনিকে আত্মনিয়োগে নামে। কিন্তু একি?
সাহিত্যের পাতায় তারে নিয়া নিবন্ধ! এ নিশ্চয়ই তার নামে পুরস্কার ঘোষণার শানেনুজুল, ইতিবৃত্ত আর তার প্রত্যাখ্যানের আগা-গোড়া বিবরণ। এত কিছুর কাঁচামাল সংগ্রহ, দলাইমলাই করা, মণ্ড বানায়ে প্রোডাক্ট বার করা। আবার ফিনিশড প্রোডাক্টটি সাত-সকালে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। সবকিছুই এ ক’দিনের মধ্যে সারা। নাহ! নিজেদের গা বাঁচাতে দৈনিকঅলারা পারেও বটে। কালাম ভাঁজ খুলে পাঠে যায়:

   লেখক যখন শিরোনাম
   সৈয়দ রফিকুল করিম
হৈ হৈ রবে আমাদের আঙিনায় আসে ফেব্রুয়ারি। তার সঙ্গে আঁটালো গাঁটে বাঁধা বইমেলা। একটা এলে পিছু পিছু আরেকটা অনিবার্য। এক সময় আছিলাম নিত্য হাজিরার অভ্যাসের দাস। এখন আর তার উপায় নাই। কারণ এ মাসেই সভা-সমিতি ও মিটিংরা একটার পর একটা দোরগোড়ায় ভিড় জমায়। তাতে সাড়া না দিলে আবার সামাজিক-সাহিত্যিক প্রতিপত্তি মুখ ঝামটায় ‘যাও, তোমার লগে থাকুম না। শুমু না। তুমি কাইলকার কনফারেন্স মিস করলা ক্যান, অ্যাঁ?’ তাই তার মান রক্ষায় কাটে ফেব্রুয়ারির বিকাল, সন্ধ্যা, কোনো কোনো দিন ভারী রাত। ডিনার শেষ করা বলে কথা।
তারপরও এবারের মেলার কোমর অবদি বাড়ার আগে দুবার যাওয়া হয়। আমার পাবলিশার ফোনে, রাস্তার মোড়ে কিংবা মিটিংসিটিংয়ে হাত বাড়ায়—‘স্যার আসুন, আপনার এত স্টুডেন্ট, পরিচিতজন। স্টলে আপনারে দেখলে দুই কপি বই বেশি কাটে...।’ তাই দুবারই তার স্টলের হা-য়ে বসতে হয়েছে। তখন অটোগ্রাফ আর কৃতার্থের শুকনো হাসি বিলিয়েছি মেলার চোখ-কান বন্ধ না হওয়া অবধি।
মেলার যখন যৌবন তুঙ্গে, একুশের দু’একদিন বাকি, তখন একবার যাই স্রেফ বই দেখতে। সেবার আর পাবলিশারের কব্জায় নয় বরং স্টলে স্টলে উঁকি মারামারি চালাই একটার পর একটায়।
মেলা জুড়ে কনুইর ধাক্কা, লোকজনের চাপাচাপি, গা ঘেঁষাঘেঁষির বিপুল দৌরাত্ম্য। তারা কোনো স্টলের সামনে দাঁড়াতে দেয় না। কেবল সরায়ে সরায়ে রাখে। শেষে দেখি মাঠের কোনার দিকের একটা স্টলে ভিড়টার একটু তরল ভাব। ফলে তার সামনে দাঁড়াবার সুযোগ দরাজ হাত বাড়ায়।
স্টলের পাটাতনে শোয়ানো বইয়ের সারি। একটা বুক পেতে আরেকটারে মাথা উঁচুতে তোলার সুযোগ দেওয়া। বাহ! আত্মত্যাগের চমৎকার পরাকাষ্ঠা। এতগুলা আত্মত্যাগীর ভেতর থেকে একটা আমার নজর কাড়ে। তার খাপছাড়া, যুগের সঙ্গে তাল না মেলানো নামের জন্য। সাহিত্য-লেখালেখি জুড়ে এখন পোস্টমর্ডানিজমের রমরমা ভাব। নাম-শিরোনাম, অলিতে-গলিতে, পাতায়-পাতায় তার অবাধ গতি। তখন কিনা বইয়ের নাম ‘কুলসুমনামা’। এ তো একেবারে মোঘল আমলের রাজদরবার থেকে উঠে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে পড়া? কৌতূহল আমার হাত বাড়ায়ে নেয়। বইটা হাতে তুলি।
তখন লেখকের নাম চোখে পড়ে। আজকালকার যুগে এ নাম! এখন তো লেখকদের বাহারি নামের চল। আর কারো সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে, মিশে যেতে না পারে তাই তাদের হাজারও কসরত। তার জন্য কেউ ডগাতে ব্রাত্য লাগায়, কেউ আবার সার্জারিতে লেজ কেটে হাসানরে হাশান বানায়। আর বংশ-লতিকারে ঘাড়ে-পিঠে বওয়ার রেওয়াজ তো বহমান আছেই। তার দৃষ্টান্তের খোঁজে আর কারো দোরে ধর্ণার দরকার কী? আমি নিজেই তো সৈয়দরে বাপ-দাদার কবরে শোয়ায়ে না দিয়া মাথায় নিয়া বেড়াচ্ছি। কিন্তু ‘কুলসুমনামা’র লেখক এ সবকিছুর বালাইয়ের বাইরে। কেবল আদি ও অকৃত্রিম আবুল কালাম। কাদা-মাটি মাখা সরলসোজা নাম। ধুয়ে-মুছে কিংবা ঘষা-মাজায় তারে উজ্জ্বলতর করার বালাইহীন। কিন্তু এ নাম তো না-দেখা না-শোনার দলে। আগে কখনো দেখা বা কারো কাছে শোনা বলে তো মনে পড়ে না।
আমার পঠন-পাঠনের সুখ্যাতি, বইয়ের রাজ্যে বসবাসের ওম, এ-পন্থী সে-পন্থী লেখক-কবিকুলের সঙ্গে ওঠবসের আয়োজন, সব কিছু ফেল। তারা কেউ-ই এ লেখকের হদিস দিতে পারে না। তাহলে আর কোথায় খুঁজি? ফ্ল্যাপে? তাতে নিশ্চয়ই পরিচয়টুকু থাকবে। অনেকে অবশ্য নায়কি-পোজের ছবির তলায় নিজেরে আগাপাশতলা উলঙ্গ করে। জন্ম থেকে চৌদ্দগুষ্ঠির বিবরণ ঝারে। আমার নিজের বইগুলাতেও তার কমতি নাই। আগাগোড়া ভরপুর। আবুল কালামের যদি ছিঁটেফোঁটাটুকু থাকে তাতেই বোঝা যাবে সে কোন জাতের লেখক। আমি তাই বই হাতে তুলে প্রথমেই লাস্ট ফ্ল্যাপের দিকে ছুটি। কেননা সেখানেই হয় সচরাচার এসবের নিবিড় আবাদ। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে হোঁচট খেতে হয়। একি? কিছুই তো নাই। সামনে কেবল সাদা ফকফকা জলা ভুঁই। এতটুকু কালির আঁচড়বিহীন।
অগত্যা বইয়ের অন্দর মহলে আমার পা পড়ে। প্রথম পাতায় আমার চোখ। এক ভাত টিপে পুরা হাঁড়ির খবর নেবার মতো এক পাতাতেই আপপাশতলা বোঝার চেষ্টা আর কি।

প্রথম পাতার প্রথম লাইনই আমারে আটকায়। অভিনব কিন্তু সুগঠিত বাক্য। তা দ্বিতীয় লাইনে পৌঁছে দেয়। তারপর একের পর এক। তখন ‘স্যার আস্সালামু আলাইকুম...’ ‘স্যার আপনার এবারের উপন্যাসটা দারুণ, দুদিনেই পড়া শেষ...’ ‘স্যার লাস্ট উইকের আপনার লেখাটার যুক্তিগুলা খুব ধার স্যার...’ ইত্যাদি প্রথম পাতা পাঠের মনোযোগের ব্যূহ টলাতে পারে না। সে সুদৃঢ়তায় আমারে আটকে রাখে। পাতাটা শেষ হলে তবে তারা কাছে ঘেঁষার চান্স পায়। কিন্তু ততক্ষণে পুরা বইটা পড়ার তৃষ্ণা আমার ঠোঁটের আগায় ডগমগায়। তা নিবারণের উপায়? পয়সা খরচে অজানা অচেনা লেখকের বই কেনা? জানতে পারলে এতদিনের প্রভাব-প্রতিপত্তি মুখ টিপবে। বন্ধু পরিচিতরা হয়তো তাদের পাতের কিনারে নামাবে। কিন্তু বইটার নতুন ধরনের কোয়ারি করা বাক্য, বর্ণনার সূক্ষ্ম কারুকাজ, পদবিন্যাসের কৌশলী আয়োজন ইত্যাদি আমারে ছাড়ে না। আষ্টেপৃষ্ঠে মন্ত্রমুগ্ধে বাঁধে। শেষে তারা জোট বেঁধে বইটা কিনতে আমারে বাধ্য করে।

ফেব্রুয়ারি শেষ। আমার টেবিলে ইটের পাঁজার মতো বইয়ের বহর। তাদের পাঁজাবন্দি হবার পেছনে নানা ইতিহাসের খেল, শানেনুজুলের দৌড়ঝাপ—‘স্যার, এটা পড়ে দেখবেন, আশা করি ভালো লাগবে স্যার... স্যার আমার প্রথম বই। ক্যামন লাগলো জানালে খুশি হব... রফিক! এ্যাই নে, আমার লাস্ট ইয়ারের বইটার রিভিউ করছিলি, এবারেরটাও তোর ঘাড়ে চাপালাম’—ইত্যাদির লম্বা লাইন। শেষে পাই ‘কুলসুমনামা’। তার কোনো ইতিহাস নেই, নেই আনুরোধ-বিনুরোধের লেজ। তার বরং আমার পকেট কেটে আসা।
পাঠ শুরুর সওয়ার তারে দিয়া। ছোট বই। একশো বিশ পাতার মতো। ক্যাম্পাস ছুটির সুযোগে একদিনেই এ-মাথা থেকে ও-মাথায় পাড়ি শেষ। কোন এক নাওখোলা গাঁয়ের কুলসুম নামের এক রমণীর দিন যাপনের কাহিনী। তার সুখ-দুঃখের বয়ান। বর্ণনায় পরিপাঠ্যের রাজত্ব। সংযমের বহর। সর্বোপরি চ্যাপ্টারে চ্যাপ্টারে আন্তরিকতার বিপুল সমারোহ। তবে লেখার আগাপাশতলাজুড়ে তারুণ্যের ছাপ জ্বলজ্বল্যমান। সম্ভবত লেখকের প্রথম বই।
পাঠ শেষে বইটা অনায়াসে তাই আমার বুক সেলফে আসন পায়। অন্য অনেকের মতো সেরদরে বিক্রির তালিকা থেকে তার রেহাই মেলে।

সেদিন ক্লাস শেষে চেম্বারে ফিরি। সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক থেকে ফোন—‘স্যার, এবারের প্রাইজ কমিটিতে আপনারে রাখতে চাই। চিঠি রেডি। আপনার সম্মতি পেলে পাঠাবো, স্যার।’ এসব সম্মতি-টম্মতি কেবল ফরমালিটিস—করপোরেটিও আচার। কেননা পাঁচ বছর ধরে কমিটিতে আছি। মাঝে এক বছর গ্যাপ। তা অবশ্য পুষে যায় সেবার আমার বইটা পুরস্কার জেতায়। তাই না করার, অসম্মতির কিছু নাই। আমার বরং জিজ্ঞাসা পরের ধাপে ধায়—‘মিটিং কবে, কখন?’
‘স্যার, শনিবার সকাল এগারোটায় মিটিং, স্যার।’
‘ওহ! বাঁচোয়া। একদম পারফেক্ট টাইম। নো ক্লাস অন সাটার ডে।’
‘ওকে, চিঠি পাঠাও।’

মিটিংয়ে আমার আগেই কমিটির বাকি সদস্যরা হাজির। এডিটর সাহেব ঢুকলে তবে ফরমাললি শুরু হয়। তিনি আমাদের হাতে একটা তালিকা ধরান। তাতে জমাপড়া শ’খানেক বই থেকে দৈনিকের চালুনিতে টেকা দশটির নাম ধাম। আমি খুঁটায়ে খুঁটায়ে তা পাঠে নামি।
না, এবার কোনো নামের ডগাতে ডাবল টিক নাই। তা থাকলে সুবিধা অনেক। তাকে দু’চার পয়েন্ট বাড়তিতে তুষ্ট করে বাকিদের পাতে গড়পড়তা। ব্যাস খেল খতম। সবগুলো পাঠের দৌড়ে না নামলেও চলে। এখন এ্যাই সবগুলো পড়তে হবে। ওহ! একেকটার যা সাইজ। ভেতরে ভাষা ও বর্ণনার যা কচকচানি। তা পাঠ না যেন চোখের নজরে ইট ভাঙার মতো দুঃসাধ্য কারবার। একটু মুক্তির আশায় ‘কুলসুমনামা’ খুঁজি। না, তার নাম নাই। তার মানে জমা পড়েনি। কিন্তু এদের হাতের মুঠায় এত লেখক-সাহিত্যিক, তাদেরও কারো নজরে পড়ল না বইটা? হায়! বলিহারি তাদের নজর।
আমাকে তখন কমিটির সদস্যদের বই কো-আপ্টের সুযোগে ভর দিতে হয়। বাকি সদস্যরা ঘাড় কাতালে ‘কুলসুমনামা’ও তালিকায় আসন পায়।
কমিটির ফাইনাল মিটিং সংক্ষিপ্ত। স্রেফ পয়েন্ট টালির কাজ। সবাই নিজ নিজ পয়েন্ট জমা দেয়। টালিতে গিয়া অবাকের পালা—‘কুলসুমনামা’র ঘরে সর্বোচ্চ। তার বগলতলায়ও কেউ নাই। বাকি সবার পয়েন্ট হাঁটু সমান।
প্রাইজ কমিটির সভাপতি জাফর স্যার আমার দিক ফেরেন। চোখের নজরে পিঠ চাপড়ান। শেষে মুখেও—‘আমরা এখন আর পারি না। বয়স হয়েছে। রফিক ইয়াং রাইটারদের ভালোই খোঁজ-খবর রাখে। গুড ভেরি গুড রফিক।’ এডিটর সাহেবের মুখও তখন আমার পানে। তার মানে নেক্সট ইয়ারের সদস্যপদ কনফার্ম।
পরের দিনই সেরা বইয়ের অ্যানাউন্সমেন্ট ছাপা হয়। দৈনিকের ফ্রন্ট পেইজে বক্স নিউজ। সঙ্গে আবুল কালামের ছবি। বাহ! এ ক’দিনেই অচেনা-অজানা লেখকের ছবি সংগ্রহ সারা। নাহ! দৈনিকঅলাদের কাজের জুড়ি মেলা ভার। তাই তো এদের সঙ্গ ছাড়া হয় না। এটা সেটায় ডাক পড়লে, মুখ নাড়াতে বললে না-য়ে পা দেবার উপায় থাকে না।
অ্যানাউন্সমেন্ট মানে এক বছরের ঝামেলা থেকে মুক্তি। এখন বাকি শুধু পুরস্কার দানের দিন সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া। কিন্তু দুদিন পরই দৈনিক থেকে আবার ফোন—‘স্যার! প্রাইজ কমিটির আর্জেন্ট মিটিং কাল।’ কী ব্যাপার আবার মিটিং কেন? মারাত্মক কোনো ভুল? দৈনিকের প্রিয় কোন লেখক বাদ?
‘জী না স্যার। লেখক আবুল কালাম একটা চিঠি দিছেন। তা নিয়া ডিসকাস।’
‘কী আছে চিঠিতে, অ্যাঁ?’
‘এডিটর স্যার কিছু বলেননি। শুধু মিটিং কল করছেন।’

মিটিংয়ের শুরুতে চিঠিটা দেখে জাফর স্যাররে অগ্নিশর্মায় পায়। আরো গোটা দুই মিটিং ক্যান্সেল করে তার আসা। বাকি সদস্যদের অবস্থাও তথৈবচ। কোথাকার কোন পুচকে লেখক আবুল কালাম। তার দুলাইনের চিঠি। তা নিয়া তাদের মূল্যবান সময় খরচ?
জাফর স্যার আমার দিক তাকান। এবার আমার পিঠে সাপাং সাপাং চাবুকের ঘাঁ—‘তোমার জন্যেই এ অঘটন। আমাদের এত বড় অপমান?’
নজির স্যারও কম যান না—‘ইয়াং লেখকরা সিনিয়রদের রেসপেক্ট করতে জানে না। আমাদের সিলেকশনরে তুড়িতে উড়াইতে চাইছে! এদের দিয়া কিছু হবে না। রক্ত গরম সব...।’ এডিটর সাহেব ফেরেন সবার শেষে। তার চোখজুড়ে বিরক্তির আভাস। তার ঘাঁয়ে শুধু নেক্সট ইয়ার নয়, ভবিষ্যতেও আমার সদস্যপদ ছিন্নভিন্ন, খারিজ।
আমার তখন চিঠির দিক মনোযোগ। কী আছে চিঠিটায়? দেখি, সম্পাদকের বরাবরে লেখা। লেখকের অনুমতি ছাড়া তা হুবহু উদ্ধৃতিতে যাওয়া অনৈতিক। তবে তার সার কথা—আবুল কালাম এ পুরস্কার গ্রহণে অনিচ্ছুক। আবার সরাসরি প্রত্যাখানের মতো স্ট্যান্ডবাজিও তার না-পছন্দ। তাই এক সপ্তাহের মধ্যে অন্য কাউকে নির্বাচিত করার আহ্বান। তাহলে তাকে আর অপছন্দনীয় কাজে হাত লাগতে হয় না। অন্যথায় সে প্রত্যাখ্যানের চিঠি পাঠাতে বাধ্য হবে।
জাফর স্যার পয়েন্ট টালির কাগজটা হাতে নেন—‘নেক্সট কে আছে অ্যাঁ... একটা পুরস্কার পেতে আমাদের কত সাধ্য-সাধনা করতে হয়। পোহাতে হয় কত ত্যাগ-তিতিক্ষার কাঠখড়। আর এ কিনা হাতে তুলে দেয়া পুরস্কার ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে। নাহ! এ সব ইঁচড়েপাকা ছেলেছোঁকড়াদের দিয়া কিছু হবে না। নেক্সট পয়েন্টধারীর নাম অ্যানাউন্স করে দিন। তখন দেখবেন জীবনে আর পুরস্কারের নামও মুখে আনবে না।’
শেষবারের মতো চিঠিটায় আমার চোখ। এটা কি প্রত্যাখ্যানের গলিতে ঢুকে বইরে হটকেক বানানোর পাঁয়তারা? পাবলিশারের সঙ্গে যোগসাজশে দু’চার কপি বেশি বিক্রির ধান্ধা?
দেখি ফুলস্কেপ কাগজের মাঝ বরাবর মাত্র চারটি লাইন। বাকিটা সাদায় ধবধবা। তাতে জ্বলজ্বলা আঁখর আমার দিকে চোখ রাঙায়—এতখানি জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা আর পঠন-পাঠনের নির্যাস, তার সঙ্গে অযুত সময়ের রক্তক্ষরণে গড়া একেকটি বাক্য। তা একটার পর একটায় গেঁথে তোলা আমার এ অট্টালিকা—একশো বিশ পাতার গ্রন্থ। তারে তোমরা সামান্য কয়টা টাকায়, একটা ক্রেস্টে কিনে নেবে? তা কি করে হয়? অতএব থু তোমাদের পুরস্কারে...।

এতটুকু পাঠে চিঠি ধরা আমার হাত কাঁপন খায়। থরথরায়ে ওঠে। লেখকের এ কথার অর্থ বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। কেননা আমারেও তা এক সময় আড়েদীঘে পোড়াইছে। তখন কত সহস্র পণ, হাজারো অঙ্গীকার—আসুক যত পুরস্কার, লুটাক পায়ের তলায়। গড়াগড়ি খাক ধুলায়। ফিরেও তাকাব না। শুধু লিখে যাব, জগতজোড়া লেখা। কিন্তু হায়! পুরস্কারের উষ্ণ জলে ধুয়ে মুছে গ্যাছে সব। এখন ছোট-বড় ডজনখানেক ক্রেস্ট শোভে আমার ড্রয়িংরুমের শোকেচে।
শেষে জাফর স্যার, প্রাইজ কমিটির সভাপতির দিক ফিরি—‘স্যার! এ তরুণ লেখকদের অমূল্য ঐশ্বর্য—অহংকার। এ না থাকলে তারা শিরদাঁড়াহীন প্রাণীতে পরিণত হয়। সুতরাং এরে পুষতে দিন, স্যার। ও পাঠাক প্রত্যাখ্যানের চিঠি, রিজেক্ট স্টেটমেন্ট। আমরা তারে মাথায় তুলে রাখব। আপনি সম্মতি দিন—যে ট্রিটমেন্টে অ্যানাউন্সমেন্ট ছাপা হয়েছে সে ট্রিটমেন্টে ছাপা হবে ওর প্রত্যাখ্যানের চিঠি, স্যার।’

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ