বই বনাম সিগারেট

  • জর্জ অরওয়েল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ | আখতার মাহমুদ


কিছু বছর আগে আমার এক বন্ধু, একটি পত্রিকার সম্পাদক; কিছু কারখানা শ্রমিকের সাথে আকাশে বোমারু বিমান খুঁজছিল। তারা তার পত্রিকাটি নিয়ে আলাপ করতে শুরু করে, যেটা তাদের বেশিরভাগই পড়ত এবং সমর্থন করত, কিন্তু যখন সে তাদের জিজ্ঞেস করেছিল সাহিত্য পাতাটা নিয়ে তারা কী ভাবে, উত্তর পেয়েছিল—‘তুমি মনে করো না আমরা ওটা পড়ি, তাই কী? কেন প্রায়শই তুমি বইগুলো নিয়ে আলোচনা করো যেগুলোর দাম পড়ে একশ ছাব্বিশ পেনির মতো! আমাদের মতো মানুষ একশ ছাব্বিশ পেনি বইয়ের পেছনে ব্যয় করতে সমর্থ নয়।’ সে বলেছিল, এরাই, সেসব মানুষ যারা ব্ল্যাকপুলে একদিনের প্রমোদভ্রমণে অগণিত পাউন্ড খরচে আপত্তি করে না।

এই যে ধারণাটা, বই কেনা ও পড়া একটি ব্যয়বহুল শখ এবং সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে—এত বেশি প্রচলিত যে একে (ধারণাকে) বিশদভাবে যাচাই করা জরুরি। ঘণ্টা প্রতি পেনি হিসেব করে গাণিতিকভাবে এটা বলা আসলে কঠিন যে বই পড়া কত খরুচে একটা ব্যাপার, কিন্তু আমি আমার বইয়ের বর্ণনামূলক তালিকা তৈরি করে এবং সেগুলোর দাম যোগ করে হিসেবটা আরম্ভ করেছি। অন্যান্য খরচাদি হিসেবের পর আমার গত পনের বছরের খরচের বিষয়ে ভালোভাবেই ধারণা করতে পারব।

বিজ্ঞাপন

যে বইগুলো আমি গুনেছি এবং দাম হিসেব করেছি সেগুলো আমার ফ্ল্যাটেই আছে। আমার প্রায় সমান সংখ্যক বই অন্য আরেকটি স্থানে আছে, ফলে আমাকে সম্পূর্ণ হিসেব পেতে চূড়ান্ত বইয়ের সংখ্যাকে দ্বিগুণ করে নিতে হবে। আমি এর মধ্যে খুচরো-খাচরা যেমন—প্রুফ কপিগুলো, ছেঁড়া সংগ্রহগুলো, সস্তা কাগজে মোড়ানো বই, প্রচার পুস্তিকা বা ম্যাগাজিন ইত্যাদি হিসেবে ধরিনি। এছাড়াও অপ্রয়োজনীয় বই, পুরোনো স্কুল বই—এরকম আরো কিছু—আলমারির তলায় স্তূপ করা আছে। আমি শুধু সেসব বই গুনেছি সেসব বই স্বেচ্ছায় সংগ্রহ করেছি অথবা স্বেচ্ছায় সংগ্রহ করতাম এবং যেগুলো সংগ্রহ করতে আগ্রহী। এইভাবে আমি দেখি, আমার সংগ্রহে আছে ৪৪২ টি বই, যা নিচে নিম্নোক্ত উপায়ে সংগৃহীত:

ক্রয়কৃত (বেশিরভাগই পুরোনো) ২৫১
উপহার পেয়েছি বা বুক টোকেন দিয়ে কেনা ৩৩
রিভিউ কপিগুলো এবং সৌজন্য কপিগুলো ১৪৩
অফেরত ধার ১০
সাময়িক ধার ৫
মোট ৪৪২

দাম ঠিক করার পদ্ধতি অনুসারে; যে বইগুলো কিনেছি যতদূর সম্ভব সেগুলোর সঠিক দাম ধরে তালিকা করার চেষ্টা করেছি। আমি সেই বইগুলোরও পূর্ণ দাম ধরেছি যেগুলো আমাকে ‍উপহার দেওয়া হয়েছে, যেগুলো সাময়িকভাবে ধার নিয়েছি অথবা ধার নিয়ে ফেরত দিইনি। কারণ, বই উপহার দেওয়া, বই ধার নেওয়া বা চুরি করা কমবেশি সমান। স্পষ্ট করে বললে, আমার মালিকানায় কিছু বই আছে যেগুলো আসলে আমার কাছে নেই, কিন্তু অনেকের কাছেই আমার বইগুলো আছে: সুতরাং যে বইগুলোর জন্যে টাকা খরচ করিনি সেগুলোর সাথে ওইসব বই যেগুলো আমি কিনেছি অথচ আমার মালিকানায় নেই সেসবকে ব্যালেন্স করে নেওয়া যায়। অন্যদিকে আমি রিভিউ ও সৌজন্য কপিগুলোর অর্ধেক দাম ধরেছি। বইগুলো পুরনো হলে যা খরচ করতাম আর বইগুলো কিনলে কেবল মাত্র পুরোনো হলেই কিনতাম। কিছুক্ষেত্রে আমাকে অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল, কিন্তু আমার হিসেবটা খুব বেশি এদিক ওদিক হবে না। দামগুলো নিম্নরূপ

ক্রয়কৃত : ৩৬ পাউন্ড—৯ শিলিং
উপহার : ১০ পাউন্ড—১০ শিলিং
রিভিউ : ২৫ পাউন্ড—১১শিলিং—৯ পেনি
অফেরত ধার : ৪ পাউন্ড—১৬ শিলিং—৯ পেনি
ঋণে কেনা : ৩ পাউন্ড—১০ শিলিং
বইয়ের তাক : ২ পাউন্ড
মোট : ৮২ পাউন্ড—১৭ শিলিং—৬ পেনি

অন্য স্থানে রাখা আমার বইগুলো যোগ করে দাঁড়ায় আমার কাছে সব মিলিয়ে প্রায় ৯০০ বই আছে, যার দাম ১৬৫ পাউন্ড ১৫ শিলিং। এগুলো প্রায় পনের বছরের সঞ্চয়—আসলে এর থেকে বেশি, কিছু বই আমার শৈশবের: তবে আপাতত ধরুন পনের বছর। প্রতিবছর দাঁড়ায় ১১ পাউন্ড ১ শিলিং করে, কিন্তু বইপড়ার সম্পূর্ণ খরচটা হিসেব করতে আরো কিছু খরচ যোগ করা উচিত আমার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খরচটা হয় পত্রিকা ও সাময়িকীর জন্যে এবং এর জন্যে বছরে ৮ পাউন্ড একটা যৌক্তিক হিসেব।

আট পাউন্ডে দুটো দৈনিক পত্রিকা, একটা সান্ধ্য পত্রিকা, দুটো রবিবারের পত্রিকা, একটা সাপ্তাহিক রিভিউ এবং এক বা একাধিক ম্যাগাজিনের দাম হয়ে যায়। এর ফলে হিসেবটা এসে দাঁড়ায় ১৯ পাউন্ড ১ শিলিংয়ে, কিন্তু একটা চূড়ান্ত যোগফলে পৌঁছাতে অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হবে। স্পষ্টতই মানুষ প্রায়শই বইয়ের পেছনে টাকা খরচ করে পরবর্তীতে দেখানোর মতো কোনো প্রমাণপত্র ছাড়াই। এর মধ্যে আছে লাইব্রেরির চাঁদা, আরো আছে বই, মূলত পেঙ্গুইন এবং অন্যান্য সস্তা সংস্করণ, এসব মানুষ কেনে এবং হারায় অথবা ছুঁড়ে ফেলে। যাইহোক, আমার অন্যান্য হিসেবের ভিত্তিতে, এরকম খরচের জন্যে বছরে ৬ পাউন্ড যথেষ্ট। সুতরাং আমার গত পনের বছরে বই পড়ার খরচ বছরে ২৫ পাউন্ডের কাছাকাছি।

বছরে পঁচিশ পাউন্ড অনেক বেশি শোনায় যতক্ষণ না আপনি এটাকে অন্যান্য খরচের সাথে তুলনা করবেন। এটা সপ্তাহে ৯ শিলিং ৯ পেনির মতো, এবং বর্তমানে ৯ শিলিং ৯ পেনি প্রায় ৮৩ টি সিগারেটের (প্লেয়ারস) সমান: এমনকি যুদ্ধের আগে এই টাকায় ২০০’র কিছু কম সিগারেট কিনতে পেতেন। এখন দাম অনুযায়ী, বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমি তামাকের পেছনে খরচ করি। আমি সপ্তাহে ছয় আউন্স তামাক পোড়াই, প্রতি আউন্সের দাম পড়ে আধা ক্রাউন, বছরে যা প্রায় ৪০ পাউন্ডের মতো। যুদ্ধের আগেও যখন তামাকের দাম আউন্স প্রতি ৮ পেনি পড়ত তখনও আমি বছরে প্রায় ১০ পাউন্ড খরচ করেছি এর পেছনে এবং যদি আমি ছয় পেনিতে দিনে গড়ে এক পাইন্ট বিয়ার ধরি, এ-দুটো মিলিয়ে বছরে আমার খরচ পড়বে ২০ পাউন্ডের মতো।

এটা সম্ভবত জাতীয় গড়ের বেশি উপরে নয়। ১৯৩৮ সালে এ দেশের এক অর্থবছরে মানুষ মাথাপ্রতি ১০ পাউন্ড করে মদ ও তামাকের পেছনে খরচ করেছে; যাইহোক, জনসংখ্যার বিশভাগ পনের বছরের কমবয়সী শিশু এবং আরো চল্লিশভাগ মহিলা, সুতরাং গড়ে ধূমপায়ী ও মদ্যপায়ীরা ১০ পাউন্ডের বেশি খরচ করেছে।

১৯৪৪ সালে, এইসব খাতে মাথাপ্রতি বাৎসরিক খরচ ২৩ পাউন্ডের কম ছিল না। মহিলা এবং শিশুদের আগের মতোই হিসাব করলে ৪০ পাউন্ড একটা যৌক্তিক ব্যক্তিগত হিসাব হবে। চল্লিশ পাউন্ড কেবল মাত্র প্রতিদিন এক প্যাকেট করে তামাক পাতা এবং সপ্তাহে ছয়দিন করে আধা পাইন্ট কোমল পানীয়ের পেছনে—এটা মোটেও চমৎকার খরচ নয়। অবশ্যই সব দামই আজকাল বেশি, বইসহ: এরপরও, বইপড়ার খরচ, এমনকি যদি ধার না করে কিনে পড়া হয় এবং বিশাল পরিমাণে সাময়িকীও নেওয়া হয়, তবুও তা মোট মদ ও সিগারেটের খরচের সমান হবে না।

বই পড়ে কারো অর্জিত জ্ঞানের মূল্য এবং বইয়ের মূল্যের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল। বই—যার মধ্যে আছে উপন্যাস, কবিতা, পাঠ্যবই, রেফারেন্স বই, সমাজবিদ্যা সংক্রান্ত প্রবন্ধ এবং আরো অনেক কিছু, সেসবের আকার এবং দাম পরস্পর মেলে না, বিশেষ করে যদি কেউ সাধারণত পুরনো বই কেনে।

আপনি পাঁচশ লাইনের একটি কবিতার জন্যে ১০ শিলিং খরচ করতে পারেন এবং একটা অভিধানের জন্য ছয় পেনি খরচ করতে পারেন যেটা থেকে আগামী বিশবছর অদ্ভুত অদ্ভুত মুহূর্তে সাহায্য নেবেন। কিছু বই আছে যা মানুষ বারবার পড়ে, কিছু বই হয়ে ওঠে মনের আসবাবের একটা অংশ এবং কিছু জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দেয়, কিছু বইয়ে মানুষ ডুবে যায় কিন্তু গভীর মনোযোগে পড়ে না, কিছু বই মানুষ এক-বসাতেই পড়ে শেষ করে আর একসপ্তাহ পরেই ভুলে যায়: আর টাকার হিসেবে দামটা প্রায় সবসময়েই এক। কিন্তু কেউ যদি বই পড়াকে বিনোদনের সাথে তুলনা করেন, সিনেমা দেখার মতো, তাহলে একটা খসড়া হিসেব দাঁড় করানো যায় যে কত খরচ পড়ে এর পেছনে।

যদি আপনি শুধু উপন্যাস আর সস্তা সাহিত্য পড়েন, এবং সবগুলো বই কিনেই পড়েন তবে একটি বইয়ের মূল্য হিসেবে আট শিলিং খরচ করেন, এবং চারঘণ্টা সময় ব্যয় করেন একটি বই পড়তে—এতে ঘণ্টায় দুই শিলিং করে পড়ে। এই খরচটা সিনেমাহলের দামি সিটগুলোতে বসে সিনেমা দেখার মতোই। যদি আপনি ভারিক্কি বইয়ে মনোযোগ দেন এবং তাও সব কিনে পড়েন তাহলেও খরচটা একই হবে। বইগুলোর দাম আরো বেশি হতে পারে কিন্তু সেগুলো পড়তে সময়ও বেশি যাবে। অন্যদিকে বইগুলো পড়ে ফেলার পরও বইগুলো আপনার মালিকানায় থাকবে, এবং সেগুলো একতৃতীয়াংশ দামে বিক্রিও করা যাবে। যদি আপনি পুরনো বই কিনে পড়েন তাহলে অবশ্যই খরচ পড়বে অনেক কম: সম্ভবত ঘণ্টায় ছয় পেনি একটা ভালো হিসাব। আবার অন্যদিকে যদি আপনি বই না কেনেন কিন্তু কেবল ধার করেই পড়েন বাণিজ্যিক লাইব্রেরি থেকে, তাহলে বইপড়ায় আপনার ঘণ্টাপ্রতি খরচ পড়বে আধাপেনি; যদি আপনি সেগুলো পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েন তবে কোনো খরচই পড়বে না।

যথেষ্ট আলোচনা করেছি এটা দেখাতে যে বইপড়া হচ্ছে রেডিও শোনার পরে সবথেকে সস্তা বিনোদন। ইতিমধ্যে, ব্রিটিশরা ঠিক কতো টাকা খরচ করে বইয়ের পেছনে? যদিও তারা (বই ক্রেতারা) অস্তিত্বশীল তবুও আমি কোনো হিসেব আবিষ্কার করতে পারিনি। তবে আমি জানি যুদ্ধের আগে এ দেশে বছরে প্রায় ১৫,০০০ বই প্রকাশিত হতো, যার মধ্যে পুনর্মুদ্রণ এবং স্কুলের বই রয়েছে। যদি প্রতিটা বইয়ের ১০,০০০ কপি করে বিক্রি হয়ে থাকে, এমনকি তা স্কুল বইয়ের ক্ষেত্রেও—এটা সম্ভবত বাড়াবাড়ি হিসাব এবং প্রতিটা মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কিনেছে প্রায় তিনটা করে বই। এই তিনটা বইয়ের একত্রে দাম হতে পারে এক পাউন্ড বা তার থেকে কম।

এই হিসাবগুলো অনুমিত এবং কেউ আমাকে সঠিক হিসাবটা দিলে আমি খুশি হব। কিন্তু যদি আমার হিসেব সঠিকের কাছাকাছি হয় তবে এটা শতভাগ শিক্ষিত জনগণের একটি দেশের জন্য গর্বের নয় এবং যেখানে একজন সাধারণ মানুষও সিগারেটের পেছনে খরচ করে একজন ভারতীয় কৃষকের পুরো জীবিকার চেয়েও বেশি। এবং যদি আমাদের বইয়ের পেছনে খরচ এতটাই কম হয় অন্তত আমাদের এটা স্বীকার করা উচিত যে উচ্ছন্নে যাওয়া, সিনেমায় অথবা মদের দোকানে যাওয়ার তুলনায় অবসর কাটাতে বইপড়া একটি অনুত্তেজনাকর বিষয়, বইয়ের দাম বেশি এটা আসল কথা নয়।

বিঃদ্রঃ

* অরওয়েলের সময়ে ১ পাউন্ড সমান ছিল ২০ শিলিং এবং ১ শিলিং সমান ১২ পেনি।
* পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে ১ পাউন্ড সমান ১০০ পেনি হিসেব করা হয়।
* বাংলায় ঠিকঠাক হিসেবটা বুঝতে বর্তমান হিসেব অনুযায়ী পাউন্ডকে টাকা ধরে পেনিকে পয়সা হিসেব করে পড়া উচিত।
* বর্তমানে এক পাউন্ড সমান ১১২ বাংলাদেশি টাকা প্রায়।