‘রোজ তাই কথা বলে আমার কবি' কফিল আহমেদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই কফিল আহমেদ ছিলেন ক্যাম্পাসের 'কালচারাল আইকন'। মধ্য আশি দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প, সাহিত্য, নন্দন ও কাব্যচর্চায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য একজন। পোষাক, পরিচ্ছদ, জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি ও তৎপরতায় তিনি অর্জন করেন বিশিষ্টতা।
জাহাঙ্গীরনগরের পরিমণ্ডল থেকে কফিল আহমেদ ক্রমে ক্রমে জাতীয় স্তরের একজন কালচারাল অ্যাক্টিভিস্টে রূপান্তরিত হয়েছেন। কবিতা চর্চার পাশাপাশি মগ্ন হয়েছেন সংগীতে। ১ সেপ্টেম্বর কবি ও সঙ্গীত শিল্পী কফিল আহমেদের জন্মদিন।
কফিল আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন সাংস্কৃতিক আবহের জনপদ বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় । উজান-ভাটির সঙ্গমস্থল করিমগঞ্জে নদী মেখলা দিগন্ত মিশে থাকে অবারিত ফসলের মাঠে। অদূরের হাওরাঞ্চলের ভেজা বাতাসে ভেসে আছে মন-উচাটন সুর ও সংগীত। স্বদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের স্পর্শে তিনি জীবন ও যাপনের সমান্তরালে আত্মস্থ করেন শিল্পের আদি ও অকৃত্রিম চৈতন্য।
জন্মস্থানের বহুমাত্রিকতা আরও ঋদ্ধ হয়েছে কফিল আহমেদের বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবনের বিন্যাসে। প্রথাগত শিক্ষা তিনি পেয়েছেন কিশোরগঞ্জ, যশোর ও জাহাঙ্গীরনগরে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স (১৯৮৭ সালে) করলেও কফিল আহমেদ অপ্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাবৎ বাংলাদেশ ও বিশ্বসভ্যতার কাছ থেকে। পৃথিবীর পাঠশালার নিষ্ঠাবান বিদ্যার্থী হিসাবে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন ও শিল্পের নানা শাখায় তিনি অনায়াসে বিচরণ করেছেন।
জীবন তাকে প্রশিক্ষিত করেছে নিজের প্রযত্নে। তিনি যা অর্জন করেছেন, তাও পেয়েছেন জীবনের অভিজ্ঞানে। বাংলাদেশের পুরোটা ভূগোল ও জনসমাজ তাকে উজাড় করে দিয়েছে জন্মভূমির রূপ, রস, বিভা, বৈচিত্র্য ও দর্শনের নির্যাসমিশ্রিত জীবনবোধ। মানুষের হৃদয় ও অনুভূতিতে নির্মিত হয়েছে তার সাংস্কৃতিক কাঠামো। ফলত তিনি নিজেকে পরিণত করেছেন মানুষ আর পৃথিবীর জন্য। কফিল আহমেদের ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে মানবমুখিতা ও বিশ্বজনীনতার উপস্থিতি এ কারণেই অনিবার্য বাস্তবতা।
কফিল আহমেদ তার লেখালেখি ও চর্চার ক্ষেত্রে সর্বদাই প্রথা ও প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে মৃত্তিকা ও মানব-সংলগ্ন থেকেছেন। সমাজের স্রোতে প্রবহমান চিরায়ত মানুষকে করেছেন তার অন্বেষার প্রপঞ্চ। নিজেও প্রধানত থেকেছেন সামাজিক-মানবিক বৃত্তে।
তার সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখিও মূলত ও সম্পূর্ণত লিটলম্যাগ ভিত্তিক। জড়িত ছিলেন মধ্য-আশির দশকের অন্যতম সাহিত্য কাগজ 'পূর্ণদৈর্ঘ্য', 'নদী', 'ফৃ', 'দামোদর', 'নান্দীপাঠ' এবং 'মান্দার'-এর সঙ্গে। বহুবছর পর, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে 'উড়কি' থেকে বের হয় তার গ্রন্থ, কবিতাগদ্যকথা, 'রোজ তাই কথা বলে আমার কবি'।
'ঘোড়াউত্রা'র উদ্যোগে কফিল আহমেদের গানের সংকলন 'পাখির ডানায় দারুণ শক্তি গরুর চোখে মায়া' প্রকাশ পায় ২০০১ সালে। কবিতার মতোই গানের ক্ষেত্রেও তিনি কথা ও সুরের বিশিষ্টতায় অর্জন করেন স্বাতন্ত্র্যবাদীর সুস্পষ্ট পরিচিতি।
বাংলা গানে এক নতুন চিন্তা ও শক্তির বিকল্প প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি ও সংগীতকার কফিল আহমেদ। উন্মোচন ঘটিয়েছেন তিনি সৃজনের নিজস্ব পরিসর। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতার সুরবিন্যাসের আন্তরিকতা লক্ষ্য করা যায় তার কাজে। সাহিত্য ও সংগীতের পাশাপাশি মাঝে মাঝে রঙে-রেখায় জীবন, মানুষ ও ধরিত্রীর গল্প করেন তিনি। তার মধ্যে বিচ্ছুরিত হয় বহুমাত্রিক প্রতিভার আলোয় দীপ্ত বর্ণচ্ছটা।
এক শিল্প-সচেতন সত্তা ও ব্যক্তিত্বে কফিল আহমেদ পরিক্রমণ করেছেন জীবনের পুরোটা সময়। ষাট-স্পর্শী জীবন ও যাপনে চিরসবুজ থেকেছে মানুষ, সমাজ, প্রকৃতি ও শিল্পের নান্দনিক মেলবন্ধনে। কিশোরগঞ্জ, জাহাঙ্গীরনগর, বাংলাদেশ হয়ে সমগ্র পৃথিবীর শৈল্পিক পাটাতনই তার কাজের ক্ষেত্র। কবিতায়, গানে তিনি সেই মানবিক, বৈশ্বিক আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন।