এমন হলে ভালো লাগে না। রিকশায় দশ নম্বর থেকে বাসায় ফিরবার সময় একটা প্রাইভেট কারের সামনে প্রায় উল্টে পড়েছিলাম। ট্যাক্সিটা রাস্তা ক্রস করতে চাইছিল, কিছু বুঝবার আগেই প্রায় ফাঁকা রাস্তায় চলন্ত রিকশার সামনে এসে ব্রেক করল। তাল সামলাতে না পেরে উড়ে গেলাম।
দামি গাড়ি, ফ্রন্ট ডোরের কিছুটা তুবড়ে যাওয়ায় ড্রাইভার যখন রিকশাঅলাকে মারতে উদ্যত হবে, বিস্ময় কাটিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম, “আমার জীবনের দামের চেয়ে গাড়ির দাম বেশি নাকি মিয়া? দিয়েছিলেন তো পিষে আরেকটু হলে!” জানি না ওই চিৎকারে বিশেষ কিছু ছিল কিনা, ট্যাক্সির পেছনে বসা সফেসটিকেটেড ভদ্রলোক ভেতর থেকে বেরিয়ে নিজের ড্রাইভারকে শান্ত করলেন। খুব দ্রুতই একটা “হতে পারত” ধরনের ঝামেলা মিটে গেল। চারপাশ মুহূর্তে ঘিরে ফেলা লোকজন এদিক ওদিক চলে গেল হতাশ হয়ে, তারা গণ্ডগোলভুক, পৃথিবীর এ-প্রান্তে পথচারীদের সম্ভবত হাতে কোনো কাজ থাকে না, রাস্তায় কিছু ঘটলেই উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। রিকশাঅলা ঝড়ের গতিতে আমাকে নিয়ে বারো নম্বরের পথ ধরল।
মামা, যা থেরেটটা দিছিলেন না! নাইলে আজকে আমার খবর আছিল।
আপনি আরেকটু সাবধানে চালাবেন। হাইওয়েতে রিকশাকে কেউ গোনায় ধরে না।
আইজ আপনেই কন মামা, আমার দুষ ছিল কুনো?
রিকশাঅলার নাম জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল। একেকদিন করিও। টুকটাক সামাজিক-রাজনৈতিক আলাপ ওদের সঙ্গে করতে ভালো লাগে। এই যে মেট্রোরেল হচ্ছে, মায়ানগরের পথঘাট পরিণত হচ্ছে খানাখন্দে, এসব নিয়ে দেখা যায় ওরা বেশ তথ্য রাখে। বেশিরভাগই সরেজমিন মন্তব্য। হয়তো নির্মাণ শ্রমিকদের কাছ থেকে ওরা তথ্যগুলো পায়। প্রতি পিলারে কয় গাড়ি সিমেন্ট লাগে, কোথায় কত বড় চুরি হচ্ছে, কবে নাগাদ এই যজ্ঞ শেষ হতে পারে। কেউ কেউ আবার দারুণ সরকার-ভক্ত। নিয়মিত আমাদের লাইনের মাথা থেকে রিকশায় দশ নম্বরে যাই, এদিকটায় ওদের প্রায় সকলেই চেনে আমাকে। কিন্তু আজ আর কথা বিশেষ এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না।
আসলে বুকের রক্ত ছলকে ওঠা ব্যাপারটা টের পেয়েছিলাম তো। এক মুহূর্তের এদিক ওদিকে কত কিনা হতে পারে। কিভাবে ভারসাম্য ঠিক রাখলাম জানি না। রাস্তায় উল্টে না পড়ে একটা পল্টি খেয়েও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। এই ক্ষণিকের উড্ডয়ন ও পল্টিতে একটা সার্কাস ছিল সম্ভবত, সঙ্গে কিছু সাফল্যও। তাই কি অমন জোর পেয়েছিলাম কন্ঠে? জানি না।
বাসায় ফিরেছি বহুক্ষণ পেরিয়ে গেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এ-সমস্ত ভাবছি। ফাঁকা ড্রয়িংরুমে এই রাতের প্রথম প্রহরেও গহন রজনীর নিস্তব্ধতা। বাইরে থেকে শব্দ আসছে খুব অল্প। মশার যন্ত্রণায় জানালাগুলো বন্ধ। এখন তো সারা বছর মশার যন্ত্রণা। কী চমৎকার বিবর্তন হয়েছে ব্যাটাদের। কয়েলে কাজ হয় না, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত, সকল ঋতুতেই ওদের প্রজনন বহাল থাকে। টিভি অন করা যেতে পারে। যদিও টিভিতে এখন আর দেখার মতো প্রোগ্রাম কই হয়?
আমি সম্ভবত বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি এ সাতাশেই। বেঁচে থাকার দিনগুলোতে নানাভাই সারাদিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর এনিমল প্লানেটে বাঁদর-কুমির এইসব দেখত। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল বুড়ো হলে এসব চ্যানেল দেখতে হয়। এখনো ধারণাটা বদলায়নি। এনিমল প্লানেট আর আসে না, আমাদের ডিশের লাইন খুব যা-তা ধরনের, থাকতে হয় তাই আছে। বিলও বেশি না, সম্ভবত দেড়শো টাকা দিতে হয় মাসে। আমি ন্যাটজিও আর ডিসকভারি চ্যানেল ছাড়া টিভিতে কিছু দেখবার মতো খুঁজে পাইনা। বিশেষত, বাঁদর বিষয়ক যে কোনো অনুষ্ঠান দারুণ লাগে, বাস্তবে বাঁদর দেখার মতো উত্তেজক না হলেও মন্দ না ততটা। শেষ কবে সাক্ষাৎ বাঁদর দেখেছি? মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলাম। জাহাঙ্গীর গেট থেকে বাংলা-মটরের বাসে উঠব। জাহাঙ্গীর গেটের কিছু আগে দেয়াল ঘেরা একটা আর্মি কোয়ার্টারের বাগানে দেখলাম চার সদস্যের এক বাঁদর পরিবার জুলজুল করে চেয়ে আছে আমার দিকে। তাদের বসবাস এক ফলবতী কাঁঠাল গাছে, ওগুলোর গায়ের রঙও ছিল হলদেটে, কাঁঠালের মতন।
লীনা বাসায় নেই। এই না থাকাটার কারণ হয়তো কোনো নিমন্ত্রণ। কারো বিয়ে বা কারো সন্তানের জন্মদিন, মুসলমানি ইত্যাদি। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে প্রায় একা একাই সবখানে যায় লীনা। এই সংসারে আমার থাকা-থাকিটা যান্ত্রিক। ছুটির দিন ছাড়া ওদের সঙ্গে তেমন কথা হয় না। সকালে অফিসের জন্য বের হয়ে যাই। সারাদিন কাটে কাজের মাঝে। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা কি নয়টা। ট্র্যাফিক জ্যাম, কোনো গাড়ি না পেয়ে দুই তিন কিলোমিটার হণ্টনের ক্লান্তি আমাকে অবশ করে দেয়। বেশিরভাগ দিনেই পারিজা ঘুমিয়ে পড়ে। লীনা আর আমার সংসার খুব বিমর্ষ ধরনের। মেয়েটা এসব দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছে। বড় হলে নিজেও হয়তো অবসন্ন আর বিষণ্ন এক মানুষ হবে। আজকাল এ-নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না আমরা কেউ। লীনা করে কিনা তা অবশ্য জানা নেই। আমাদের সঙ্গমে মরচে ধরে গিয়েছে।
বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলাটা নিশ্চয়ই একটা বিপ্লবী ধরনের ঘটনা। লীনা আর আমার বিয়েটা ছিল ঘর-পলাতক। অবশ্য, আমার পালাবার দরকার হয়নি। ও-ই একদিন গাঁটছড়া বেঁধে সবকিছু নিয়ে আমার ঘাটে এসে ভিড়েছিল। খুব ক্রিটিকাল এক সময় তখন। নানাভাই ভীষণ অসুস্থ। যে কোনো দিন ঝরে যাবেন। আম্মা ঘুমাতে পারছেন না রাতের পর রাত, হাইস্কুল পড়ুয়া ছোটবোন ত্রপা আর কী বা সাহায্য করবে? আব্বার পোস্টিং তখনও মায়ানগরের বাইরে। একা একা কতদূর সামলানো যায়? এসবের মধ্যেই আমাদের প্রেম চলছিল। রেস্টুরেন্টে, রিকশায়, সোহরোয়ার্দী উদ্যান কিংবা পাবলিক বাসে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাড়পত্র মেলেনি কারো অথচ মনে হতো দারুণ বড় হয়ে উঠেছি। একদিন সুলতানের চিত্রকলার মতো প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক ভালোবাসা-বাসির সময় আমিই ওর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলেছিলাম, “আমাদের উচিত বিয়ে করে ফেলা।” লীনা হেসেছিল। ওর ঘেমে ওঠা নাকের ডগা, কাজল লেপ্টে যাওয়া চোখ আর অপ্রশস্ত কপালের রেখায় খেলা করতে শুরু করেছিল বিস্ময়।
এখনো আমরা পাশ করে বের হলাম না। বিয়ে যে করবে আমাকে, খাওয়াবে কী?
তোমার কি ধারণা আমি এখন কোনো চাকরি পাব না?
কী যে পাবে! আমার বাসায় রাজি হবে কেন তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে?
রাজি হওয়া লাগবে না লীনা। চলো আমরা নিজেরাই বিয়ে করে ফেলি।
অনুমেয়-ভাবেই কেউ রাজি হলো না ওদের বাসায়। আম্মা বললেন, বিয়ে করবি বেশ। তোর নানাভাইয়ের এমন অবস্থা, আমি একা মানুষ, তোর আব্বা শহরের বাইরে। সময়টা আনন্দের না শিপন। ত্রপার এসএসসি আর ক’দিন বাদেই।
মানুষ হিসেবে নিজেকে পলাতক মনে হয় আমার, চিরকাল। সব সঙ্কট থেকে গা বাঁচিয়ে কিভাবে ভালো থাকা যায়, এই চেষ্টা ছোট থেকেই করতাম। নানাভাইকে যে আমি ভালোবাসতাম না, এমন নয়। সেই ভালোবাসা ছাপিয়ে আমার মনে হতো, নব্বই ছুঁই ছুঁই একজন বৃদ্ধ সহজ স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, সে দুঃখে নিজের জীবনের স্রোত আটকে দিলেই কি মানুষটা অমরত্ব পাবেন কিংবা অন্তত দশ বছরের বাড়তি আয়ু? বাসা থেকে লীনাকে জোর করে বিয়ে দেবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। পাত্র হিসেবে আমার তেমন যোগ্যতা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাংলা-সাহিত্য পড়ি, ভবিষ্যতে চাকুরির বাজারে তার কদর খুব সামান্য। আর, আমাদের বয়সটা, আজ মনে হয়, ওই সময় বাইশ যেমনই থাকুক, আজকের চিন্তায় নিতান্তই কৈশোরকাল। গোঁফ-দাড়ি পেয়েছিলাম বংশগত কারণেই, আমাকে বেশ বড় দেখাত এটা অনুমান করি। আসলে আর কত বড় ছিলাম? তবু, ঘটনাটা আমার পক্ষে মোড় নিলে লীনা এক ঘোলাটে শীতের ভরদুপুরে একটা লাগেজ নিয়ে উঠে এসেছিল আমাদের বাসায়।
যাক, ওসব মনে করে আর কী লাভ-ক্ষতি? ফলাফলের চিন্তা ঝেড়েই আমার মগজে অতীতের সুতীব্র সঙ্গীত দিনমান বাজতে থাকে। জীবন এমন নিস্তরঙ্গ হবে কখনো ভাবিনি। কোনো শঙ্কা নেই, ঢেউ বা প্রবল স্রোত নেই। এই পাঁচ বছর আগেও এত এত এক্সাইটমেন্ট যে পুষতাম বুকে, সেসব কি বেলুনে পোরা বাতাস ছিল? বেলুনটা ফুটো করে দিল কে? চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে ন’টা বাজে। এক জায়গায় বসে কেমন ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিয়েছি। ফোন বেজে চলেছে বেডরুম থেকে। উঠে গিয়ে ধরব, ইচ্ছে করছে না। শরীরে হু-হু করে মেদ বাড়ছে। নিয়মিত বাইরে খাওয়ার ফল। হিসেব করলে দেখা যাবে, প্রতি মাসে কয় বেলা ঘরের রান্না খাওয়া হয় তা হাতের কড়ে গুনে বের করতে পারব।
শ্লেষ্মাজড়ানো একটা কন্ঠে আমার নাম ধরে ডাকল কেউ। কোন একটা ঘরের ভিতর থেকেই। বাইরে থেকে ডাকলে বোঝা যেত।
“শিপন, তোর মোবাইলে রিং হয়। ফোন উঠাস না কেন?..”
যেন প্রশ্ন না। শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠটা নির্দেশ দিচ্ছে ফোন ওঠাবার। আজ যখন ফিরেছি, লক ছিল বাইরে থেকেই। চাবি ঘুরিয়ে খুলেছি খুব স্মরণ আছে। অন্ধকার আমার ভালো লাগে না তবু লীনা রুমগুলোর বাতি নিভিয়ে বের হয় সব সময়। আমি আবার সবকটা লাইট জ্বালিয়ে, ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ভরে এরপর ড্রয়িং রুমে বসেছিলাম। কেউ ভেতরে থাকলে টের পেতাম না?
“শিপন, কী হলো? তুই জানিস না ফোনের রিংটোন শুনলে আমার মাথা ব্যাথা করে?”
কে বলতো এই কথা? নানাভাই?
ডিভান থেকে শরীরটা ওঠাতে খুব বেগ পেতে হলো। একসময় কলেজ টিমে দুর্দান্ত ফুটবল খেলা আমার এত বড় ভুঁড়ি হয়েছে ভাবা যায় না। মোটা লোকদের এত অপছন্দ করতাম। বলে বেড়াতাম মানুষ চাইলেই ফিট থাকতে পারে। এমনকি ফেসবুকে একবার বন্ধুদের থেকে অপিনিয়ন চেয়েছিলাম, “জাতি হিসেবে বাঙালি কি অলস?” আশিভাগ লোক ভোট দিয়েছিল অলসতার পক্ষে। মেনে নিয়েছিলাম, এই ভুখণ্ডের মানুষ অলস। বাস না পেলে মাইল মাইল হাঁটবে। বাস এভেলবল দেখলে আধা কিলোর জন্যও ভিড় ঠেলে উঠে পড়বে।
বেশ তো। দৃশ্যটা খুব অস্বাভাবিক লাগল না। একটা ধুতি আর স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে নানাভাই বসে আছেন বেডরুমের এক কোনায়। শৈশবে আমি ঈশ্বরের অবয়ব কল্পনা করতে চেষ্টা করতাম। দেখতাম যে একটা উঁচু আসনে বসে আছেন তিনি, প্রাচীন এক বৃক্ষের ছায়াতে, পরণে ধুতি আর পাতলা স্যান্ডোগেঞ্জি। নানাভাই পরতেন লুঙ্গি। এখন ধুতি কেন পরে আছেন কে জানে। চেহারায় ঝলমল করছে হাসি। আমাকে দেখে বললেন, “ফোন ধরিস না কেন রে গাধা?”
ফোন করেছে ত্রপা। নানাভাইয়ের হাসি হাসি মুখের সামনেই কলটা রিসিভ করলাম।
হ্যাঁ, ত্রপা, বল।
ফোনের ওপার থেকে অসহিষ্ণু কন্ঠে ছোটবোন বলল, “ভাইয়া ফোন ধরছিলি না কেন? কতক্ষণ ধরে ট্রাই করছি জানিস?”
অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত লাগছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী হয়েছে?
পারিজাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবি আর আমি সুপারশপে গিয়েছিলাম সন্ধ্যায়। বাবু তো খুব পছন্দ করে ঘুরতে। কিডস কর্নারে ওকে রেখে আমরা কেনাকাটা করেছি। এসে দেখি নেই।
নেই মানে কী?
জানি না ভাইয়া। কী করব বুঝতে পারছি না। ভাবি খুব কান্নাকাটি করছে। আমরা কী করব এখন?
ত্রপা ফোনের ওপাশে কথা বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করল। কী বলছে হড়বড় করে শুনতে পেলাম না। আমাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে এর মানেটা কী? এই যুগে কারো বাচ্চা হারায়?
তোরা কোথায় এখন?
পল্লবী থানায়।
পুলিশ কী বলেছে?
আর কোনো জবাব পেলাম না। ও হয়তো ফোন কেটে দিয়েছে। পারিজার বয়স চার বছর। দৌড়ে বেড়ায়। চুপচাপ থাকা স্বভাব হলেও ভেঙে ভেঙে প্রায় ভালোই কথা বলতে পারে, বোঝে। অফিসের ড্রেস পরেই আমি বাইরে বেরুলাম। পল্লবী থানা যেতে দশ মিনিট লাগবে। রিকশায় বিশ টাকা নেয়। একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লাম। কী করব মাথায় আসছে না। বাচ্চারা হারিয়ে গেলে তাদের কিভাবে খুঁজে বের করে? মসজিদে নিখোঁজ সংবাদ দেব কি?
থানার সামনে রিকশা থেকে নেমেছি, দেখলাম গেটের সামনে ত্রপা আর লীনা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই ওরা ছুটে এলো। দুজনকেই বড় অসহায়, আশাহীন দেখাচ্ছে। টানা কেঁদেছে দুজনে, বোঝা চলে।
শিপন এখন কী করব আমরা? আমার পারিজাকে খুঁজে এনে দাও।
পুলিশ কী বলেছে?
জিডি নিয়েছে। বলেছে চব্বিশ ঘণ্টার আগে কিছু করতে পারবে না। আজকের মধ্যে পাওয়া না গেলে কাল বিকেল থেকে ওরা তল্লাশি শুরু করবে। অতক্ষণে আমার পারিজা কোথায় থাকবে? ও আল্লাহ গো!
চোখের সামনে লীনা জ্ঞান হারাল। মাটিতে পড়ার আগে ওকে ধরে ফেললাম আমি। ত্রপা আবার উচ্চশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে। ধমক দিতে ইচ্ছে হলেও সামলে নিলাম। একটা বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে এতটা কেয়ারলেস কিভাবে হয় মানুষ? কয়েক মিনিটেই জ্ঞান ফিরল লীনার। আবার চারদিকে লোক জমে গিয়েছে। মানুষ পারেও। কারো কি কোনো কাজ নেই? একটা সিএনজিতে ওদের তুলে দিয়ে বললাম, “তোমরা বাসায় যাও। আমি দেখছি কী করা যায়।”
***
সুপার শপের দারোয়ান বলল, “বাচ্চাটারে আমি বাইর হইতে দেখছি। আর দুইজন মহিলার পিছে পিছে কেমন হেইলা দুইলা আগায়া গেল। আমি তো ভাবছি অরাই গার্জেন সার।”
আশ্চর্য। এত দিন ধরে এই দোকানে শপিং করি আমরা। একটু খেয়াল করবেন না?
এত এত লোক সার, কত খেয়াল রাখুম কন?
ওখান থেকে বেরিয়ে আশেপাশের প্রায় সব দোকানে অস্থির হয়ে খোঁজ করলাম। চার বছরের বাচ্চা। সবুজ হাতাকাটা ফ্রক পরা, ফর্সা রঙ, লালচে চুলে ছোট্ট দুই বেণি, কপালের বাম পাশে আধা ইঞ্চির মতো কাটা দাগ, পায়ে গোলাপি স্নিকার। অনিক প্লাজার সামনে অজস্র ফুডকোর্ট, খেলনার দোকানদাররা কেউ কিছু বলতে পারল না।
কত বাজে এখন?
ধীরে ধীরে বাসের সংখ্যা কমে যাচ্ছে রাস্তায়। দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে। পথে যতগুলো মসজিদ পেয়েছি কিংবা ওয়ার্ড কমিশনারের বাসায়, কোথাও জানাতে বাকি রাখলাম না। কোনো বাচ্চা পেলে যেন সঙ্গে সঙ্গে এনাউন্স করা হয়। মিরপুর বড় ঘিঞ্জি এলাকা হয়ে গিয়েছে আজকাল। অতো ছোট মা’টা আমার এই ভিড়ের মাঝে কোথায় চলে গেল?
বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছেনা আর।
কোন মুখ নিয়ে ফিরব? তবু এক সময় ক্লান্তি এসে ভর করল। চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আষাঢ়ের রাত্রি, বাতাস ভেজা ভেজা। হয়তো বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণ পর। লীনার বড়ভাই অনেকক্ষণ ধরেই ফোন করছে। আজব মানুষ। এতবার ফোন করার কী আছে? পর পর অনেকগুলো সিগারেট আর কয়েক কাপ চা ফুরিয়ে গেল, বেঞ্চে বসে আছি কতক্ষণ ধরে? চা’অলা বলল, “মামায় কি সিক?”
নিজেদের বাসায় পা রাখলাম বহুদিন পর। কেন যে ছেড়েছিলাম এ বাসা, আজ আর হৃদয়ে তার কোনো অভিঘাত নেই। আমায় দেখে আম্মা-আব্বা ছুটে এলেন। ত্রপাও।
কোনো খোঁজ পেলি শিপন?
নাহ। কেউ দেখেনি। ওই এলাকার কোথাও বাদ রাখিনি খুঁজতে। মসজিদে কেউ দিয়ে গেলে মাইকিং করে জানাবে বলেছে। লীনা কোথায়?
আব্বা বললেন, পাগলামো করছিল খুব। ডাক্তার এসে সিডেটিভ দিয়ে গেছে। তুই যা ভিতরে। মেয়েটার তোকে দরকার এখন খুব। ঘুম ভাঙলে আবার কান্নাকাটি শুরু করবে। গোয়েন্দা বিভাগের সলিমুল্লাকে জানিয়েছি আমি। ওর টেরিটোরি তো এদিকেই। কালকের মধ্যে একটা না একটা সংবাদ পেয়ে যাব। টেনশন করিস না।
আমার রুমটার দরজায় আবার দেখলাম নানাভাইকে। সেই একই রকম হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন।
এই দুঃসময়েও আপনি হাসছেন নানাভাই?
হাসব না তো কাঁদব নাকিরে গর্ধব?
আপনি একটা অমানুষ।
হয়েছে। আর তুই খুব মানুষ।
নানাভাইকে পাশ কাটিয়েই ভিতরে ঢুকলাম। লীনা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আমার সেই পুরনো বিছানায়, বিয়ের প্রথম রাতটা যেখানে আমরা কাটিয়েছিলাম। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে ধীরে ধীরে, ঘুমাচ্ছে। দু’গালে, চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখা। নীলাভ ডিম লাইটের আলোতেও বোঝা চলে। পুরনো আমলের ইলেকট্রিক পাখাটা ঘোঁচ কোঁচ ঘোঁচ কোঁচ ধরনের শব্দ করছে। ছোটবেলায় কত খেলতাম এই শব্দের সঙ্গে। যান্ত্রিক ঘর্ষণের এ আওয়াজকে যেমন খুশি তেমন অর্থ করেই শোনা যেত। ট্রেনে চড়ার সময় যেটা করা যায়। ওর পাশে বসে রইলাম কিছুক্ষণ চুপচাপ। এমন মমতায় শেষ কবে ওর কপালে হাত রেখেছি মনে পড়ল না।
ঘুমালে বউ?
নাহ। ঘুম আসে না।
তুমি ঘুমাও পাখি। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
ভাঙা প্রাণহীন কন্ঠে লীনা বলল, “এভাবে না শিপন। আমাকে আদর করো।”
দূর থেকে দুয়েকটা নিশাচর গাড়ির শব্দ আসছে, খুব নিচু লয়ে বাতাসে ভাসছে খোল করতাল হারমোনিয়ামের ধ্বনি। উত্তরে এক ফুরোতে থাকা গ্রাম আছে তা জানি, মিলিটারি আবাসিকের পেছনে। সেখানে কি যাত্রাপালা চলছে রাতজাগা সব দুঃখী আত্মাদের নিয়ে? আশ্রয়ের সন্ধানে আমি লীনার বুকে আমার মুখটা ডুবিয়ে দিলাম। যে সঙ্গমে মরচে ধরেছিল আমাদের, আজ তা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাক।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সম্মানজনক এ পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করেছে। তার দারুণ কাব্যময় গদ্যের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যা ঐতিহাসিক ক্ষতগুলোকে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে প্রকাশ করে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক সাহিত্যিক হান কাং।
হান কাংয়ের প্রথম ইংরেজি উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' সম্পর্কে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচক ড্যানিয়েল হ্যান মন্তব্য করেছেন, বইটির তিন খণ্ড জুড়ে সমাজের সবচেয়ে অপরিবর্তনশীল কয়েকটি কাঠামোর অসহনীয় চাপ পাঠকমনকে বিচলিত করে তোলে। এই উপাদানগুলো হল চাহিদা ও আচরণ এবং প্রতিষ্ঠানগত কর্মপদ্ধতি, যা একে একে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়।
২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার প্রাইজ পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার এই লেখক । উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান'র জন্য তাকে এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়।
হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার শহর গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে সিউলে চলে আসেন। হ্যান ক্যাং একটি সাহিত্যিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার বাবা একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। তিনি লেখার পাশাপাশি শিল্প ও সঙ্গীতেও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
বোধহয় বৈরি সময়ে উর্বর মস্তিষ্কে চিন্তারা বেশি করে ভিড় করে। মৌলিক প্রতিভা সে চিন্তাকে ঘনীভূত করে জমাট বাধায়, উপহার দেয় চিন্তা বা কল্পনা করতে না পারা মানুষদের জন্য অভিনব কিছু। সাহিত্যে কবিতার যে শক্তি তা কম কবির লেখনিতেই মূর্ত হয়েছে কালেভদ্রে। কিন্তু মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে ধারণ করে যে শব্দের সমষ্টি অজস্র পীড়িতের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই তো সার্থক কবিতা। আর তার নির্মাতাই হয়ে উঠেন সার্থক কবি।
কবিতার এই যে মানদণ্ড তাতে একজন হেলাল হাফিজ অনেক আগেই উত্তীর্ণ। ৭ অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবির জন্মদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য! দুঃখকে নিত্যসহচর করে বেঁচে থাকা অধিকাংশ কবিদের অমোঘ নিয়তি হেলাল হাফিজকেও ছাড়েনি। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোণায় জন্ম নেওয়া কবিতার এই বরপুত্র নব্যঔপনিবেশিক শাসকদের রোষানল দেখেছেন। দেখেছেন মুক্তির আকাঙ্খায় উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির ব্যগ্রতা।
যৌবনের উদ্দাম দিনে দ্রোহ ও প্রেম-দুই-ই পেয়ে বসেছিল হেলাল হাফিজকে। তাকে অবলম্বন করতেও ছাড়েননি তিনি! সহজ কথায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সবার কথাকে, তাইতো তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁর সমকালীনতাকে। অন্তত ৫ দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে কবিতার এই বরপুত্র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছেন। এই সময়েও তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য ম্লান হয়নি এতটুকুও! এখানেই তাঁর সার্থকতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলা সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত এক বন্ধ্যা সময়েও মুগ্ধ পাঠকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে হেলাল হাফিজের শব্দগাঁথা, যা তিনি জীবন অভিজ্ঞতা ও সঞ্চিত বিশ্বাসে ভর করে লিখেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের তপ্ত আবহের মাঝে। ‘এখন যৌবন যার জুদ্ধে যখন তার শ্রেষ্ঠ সময়’-কবি হেলাল হাফিজের শক্তিশালী শব্দমালা এখনও পথে-প্রান্তরে দেয়ালে উৎকীর্ণ, হয়তবা এই পঙতির চিরকালীন আবেদনময়তার জন্যই।
‘যে জলে আগুন জলে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে দ্রোহ ও প্রেমের যে আখ্যান কবি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক দশক পরে এখনও পাঠককে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে বললেও অত্যুক্তি হবে-বলা প্রয়োজন আন্দোলিত করে।
২০১৩ সালে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবিকে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১৯ সালে কবি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘বেদনাকে বলেছি কোঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ। সঙ্গীহীন ব্যক্তিগত জীবনে কল্পনালোকে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন কবি।
তবে ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে যে প্রবল শক্তি নিয়ে একজন হেলাল হাফিজ আবির্ভূত হয়েছিলেন তার সামান্যই হয়ত নিতে পেরেছি আমরা। কবিতার শক্তি যে সত্যসুন্দরের আহ্বান নিয়তই জানিয়ে যায় এই সমাজ হয়ত তাকে সর্বাঙ্গীন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়।
তা সত্ত্বেও সত্যসুন্দরের দীপশিখা জ্বেলে যান কবি হেলাল হাফিজ। শুভ জন্মদিন কবি।
বীর সাঈদ
মোঃ আলাউদ্দীন ভুইয়া
সাঈদ ছিল গুণী, এই পুলিশ যেন খুনি,
টের পাইনি সাঈদ বাবা।
সরলতার সুজোগে, দানবের মত হুজুগে,
তাঁজা বুকে মারলি থাবা।
হে ঘাতক চিনলে না-সাইদ কে,
অন্যরা কারা।
আকাশ ছুঁয়ে গুলি মেরে দিতে
করে কারা!
প্রশ্ন; বল, বল, বল ওরে ঘাতকের দল,
শত শত সংসার করে দিলে-অচল।
বুঝে, না বুঝে চালিয়েছ-বন্ধুকের নল।
আমাদের দেশ, করে দিলে শেষ,
অন্ধকারে তল।
এখন বুঝি, হত্যা ছিল তোমাদের পুঁজি,
তোমরা তো হার মানিয়েছ ব্রিটিশের যোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ ক্যান্সার রোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ পাকের ডান্ডা।
সব শেষে পেলে শুধু ঘোড়ার আন্ডা।
হে; প্রভু তোমার কাছে ফরিয়াদ,
না, ছিল ছাত্র জনতার অপরাধ,
শুধু হকের উপর ছিল প্রতিবাদ,
ওরে তার পাপের ছিল এত ভার।
হেলমেট খুলে গেল ইশারায় বিধাতার,
মুহুর্তে ভেসে গেল দানবের ছায়া,
ছেলের মত দেখেও, ঘাতকের হল না যে মায়া,
ঘাতক তোমার নামের মাঝে করি শুধু-বমি,
দোয়া, সাঈদ না ফেরার দেশে সুখে থাক তুমি।
কিছু না বোঝার আগে বুকে নিলে-তীর।
আজ তুমি হয়ে উঠেছ বাংলার বীর।
আজিম রাস্তায় হাঁটছে। কিন্তু চমকে যাচ্ছে বারবার। এ কোথায় এলো সে! আজিম ছাড়া সবার মাথায় হেলমেট। অথচ রাস্তার কোথাও কোনো মোটর সাইকেল নেই। হেলমেট পড়ে যে মারামারি করছে তাও না। প্রতিটা মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। অথচ মাথায় হেলমেট! কেবল আজিমের মাথায় কিছু নেই। হেলমেটের কারণে মুখের কিছুই দেখা যায় না। হেলমেটের সামনে অংশ কালো গ্লাস দিয়ে ঢাকা। হেলমেটের মানুষ হাঁটছে। ওই অবস্থাতেই কথা বলছে একে অপরের সাথে। কী অদ্ভুত। একটা বাস গেলো। বাসের যাত্রীদের সবার মাথায় হেলমেট। একেবারে মুখ ঢাকা।
আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কোথায় এলো সে!
‘আজিম সাহেব?’
কে যেন ডাক দিলো।
‘কে, কে?’
চমকে উঠলো আজিম।
‘এই যে আপনার পেছনে।’
আজিম হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। একটা লাল হেলমেট পরা মানুষ।
‘কে আপনি? আপনাকে চিনছি না তো। হেলমেট পরে আছেন কেন?’
হেলমেটের মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটা হাসছে।
‘আপনিও পরবেন। সমস্যা নাই।’
‘দেখুন, হেলমেট না খুললে আমি কথা শুনব না। আপনাকে না দেখে তো আমি কথা বলছি না।’ আজিম রেগেই গেলো এবার।
লোকটা হেলমেট খুললো। আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কি দেখছে সে!
লোকটার মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। চোখ নেই, নাক নেই। শুধু ঠোঁট, দাঁত আর জিহবা আছে। দাঁত দেখিয়ে হাসছে লোকটা।
লোকটার হাসি দেখে আশেপাশে আরো কয়েকজন হেলমেট মানব এলো। ওরাও দাঁড়ালো। আজিম খেয়াল করলো, সবাই গোল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট খুলে ওরাও হাসছে জোরে জোরে।
ওদেরও সবার মাথা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। এদেরও চোখ নেই, নাক নেই। দাঁত বের করে হাসছে আজিমের দিকে তাকিয়ে। যেন আজিম একটা কৌতুক।
একটা ঝাঁকুনি দিলো শরীরটা। মনে হলো হোঁচট খেলো। এতেই ঘুমটা ভাঙলো আজিমের। বিরক্ত মুখে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটায় সময় দেখলো। রাত ৪টা ২৯ মিনিট। কোনো মানে হয়? প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এই গভীর রাতে। স্বপ্নটা আবারো হানা দিয়েছে আজিমের চোখে। সেই একই স্বপ্ন। গরমে ঘেমে গেঞ্জি আর বিছানার চাদর এক হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মগবাজারে আজিম যে বিল্ডিংটায় থাকে সেটা আটতলা। আজিম থাকে টপ ফ্লোরে। মাথার ওপরে ছাদ। আর ছাদ দিনভর সূর্যে তেতে থাকে। ফ্যানে আপাতত ঠাণ্ডা মেলে কিন্তু শরীরতো বিদ্রোহ করে।
তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট বাসাটায় আজিম একটা রুমে থাকে। অন্য দুই রুমে থাকে সাদেক ও আফজাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হলে দুইজনই ছিল আজিমের রুমমেট। সাদেক এখন ব্যাংকার আর আফজাল কাজ করে ওষুধ কোম্পানিতে। পাস করে বের হওয়ার পর বাসাও একটা নেয়া একসাথে। সেই সাথে ডাইনিং রুমের জন্য একটা ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ আর কম দামের একটা সোফা সেট। ব্যাচেলর হলেও বাসাটাকে একটা পরিবারের স্পর্শে রাখা।
আজিম সাংবাদিক। সবচেয়ে দেরি করে বাসায় ফেরা লোক। রাত ১২টায় অফিস থেকেই বের হয়। বাসায় ফিরে বিছানায় যেতে যেতে রাত ১টার মত বেজে যায়। এরপরও যদি রাত ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তাহলে মন ও মেজাজ কিছুই ভালো থাকার কথা না। এর ওপর বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে এসেছে এক স্বপ্ন। সেটা দু:স্বপ্ন না ভালো কিছু সেটাই বুঝতে পারছে না আজিম। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বিছানার পাশে রাখা স্টিলের গ্লাসটা শেষ করেও কাজ হলো না। ডাইনিং এ যেতেই হবে। এক বিন্দুও ইচ্ছা করছে না আজিমের। বাড়ি গেলে বিছানার পাশে বিশাল পানির বোতলটা রেখে দিয়ে যেতেন আজিমের বাবা, সিদ্দিকুর রহমান। সাথে একটা গ্লাস। রাতে যেনো রুম থেকে বের হওয়া না লাগে। রুমের দরজা লক করে না আজিম। ভোরের দিকে টের পেতো আজিমের গায়ে চাদর। কখন সিদ্দিকুর রহমান এসে চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দিয়ে গেছে টেরেই পায়নি সে।
রুমের দরজা খুলেই দেখে ডাইনিং রুমের বাতি জ্বালানো। ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছেন সিদ্দিকুর রহমান!
আজিম অবাক হলো।
‘বাবা, আপনি কখন এলেন?’
পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া সিদ্দিকুর রহমানের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমাটা হাতে নিয়ে ফ্রেমের কাঁচটা পাঞ্জাবির কাপড়ে পরিস্কার করলেন। এটা সিদ্দিকুর রহমানের অনেক পুরানো অভ্যাস।
‘তোমার এখানে আসতে আসতে রাত ৯টা বেজে গেলো। তুমি অফিসের কাজে এই সময় ব্যস্ত থাকো, সেটা আমি জানি। তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি।’
‘কী বলেন? আপনি এসেছেন, আমাকে বলবেন না? এতক্ষণ ধরে এখানে? খেয়েছেন? বাসায় আসার পরও ডাকেননি কেন?’
আজিম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সিদ্দিকুর রহমান রুটিন মেনে চলা লোক। খেয়েছেন কিনা ঠিক মত, না ঘুমিয়ে এখানে বসে থাকা?
‘আরে তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না। এখানে বসো। আমি ঠিক আছি?’ সিদ্দিকুর রহমান হেসে বললেন।
‘আচ্ছা তোমার লেখা মনে হচ্ছে কম আসছে। কারণ কী?’
আজিম হাসলো।
‘বাবা, ইদানিং ডেস্ক সামলাতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার সময় কম পাচ্ছি। তাই রিপোর্ট লেখার সময় কম মিলছে।’
‘এটা কী করে হয়। তুমি এত ভালো রিপোর্ট করো আর তোমাকে ডেস্কে বসিয়ে দিলো! এডিটর জানে না তোমার রিপোর্ট ভালো হয়?’
‘জানেন বাবা। তারপরও উনার মনে হয়েছে ডেস্কেও যদি সময় দেই তাহলে ভালো হয়। আর ইচ্ছে করলেই বাইরে গিয়ে স্পেশাল রিপোর্ট করতে পারি। তাতে এডিটরের কোনো না নেই।’
‘হুম। আর তুমি বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছো!’
আজিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নেয় তখন সিদ্দিকুর রহমান বেশ খুশি হয়েছিলেন। আজিমের মনে আছে ছোট বেলায় ওদের বাসায় দুটো পত্রিকা দিয়ে যেতো হকার। ইত্তেফাক আর অবজারভার। বইয়ের চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল আজিমের ওই দুই পত্রিকা। খেলার খবর, কত ছবি, কত শব্দ, কত কত বাক্য। পাস করে বের হওয়ার পরই একটা পত্রিকায় চাকরি হয়ে যায় আজিমের। সিদ্দিকুর রহমানের খুশি ধরে রাখে কে! ছেলের নামে যেদিন রিপোর্ট ছাপা হয় নিজে সেদিন বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের বাসায় পত্রিকা নিয়ে দিয়ে আসেন। ছোট্ট শহরে ছেলেকে বিখ্যাত বানিয়ে তুলতে সিদ্দিকুর রহমানের উৎসাহের কমতি নেই।
‘আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?’ আজিম পানি দিল তাঁর বাবাকে।
‘হ্যাঁ, তোমার বন্ধুরা বেশ খাইয়েছে। খেয়েই তো ড্রইংরুমে হেলান দিয়েছিলাম। তাতেই ঘুম।’
‘ঘুম ভাঙার পর আমার রুমে যেতেন। এখানে বসে ছিলেন কষ্ট করে।’
‘তুমি খুব ক্লান্ত থাকো। বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই চলে এলাম।’
‘ভালো করেছেন। কখন রওনা দিলেন?’
‘রওনা দেয়ার কথা সকালেই। কিন্তু দেরি হয়ে গেলো। প্রচণ্ড রোদ আর গরম মাথায় নিয়ে বের হলাম। বাসে উঠার পর বৃষ্টি। বাস থেকে নামার পর আবার গরম।’
বাইরে তাকালো আজিম। বিজলির চমক দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে দ্রুত।
‘এক কাজ করো। চা বানাও। তোমার জন্যও বানিও। চা খেতে খেতে গল্প করি।’
রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নিজের রুমের আর ড্রইংরুমের জানালার গ্লাস টেনে দিলো আজিম। বৃষ্টিতে ঘর ভিজে যায়। ওদিকে ডাইনিংয়ে জানালার পাশেই বসেছেন সিদ্দিকুর। বাতাসে তাঁর পাতলা চুল উড়ছে। ৭০ এর বেশি বয়স হলেও চুলে কালো রং দেন তিনি। আজিম ভাবে, বাবাকে সাদা চুলে কখনোই ভালো লাগবে না।
‘জানালাটা লাগিয়ে দিব?’
‘না, থাক। তুমি চায়ের ব্যবস্থা করো।’
আজিম রান্নাঘরে যায়। বাবার জন্য চা বানানোটা সহজ। পানি গরম করলেই হয়। কাপে একটা টি প্যাক। আর কিছু না। আজিমও এভাবেই চা খায়। তবে চায়ে তার নেশা নেই।
চায়ে চুমুক দিলেন সিদ্দিকুর রহমান।
‘চায়ের সাথে কিছু খাবেন? মুড়ি আছে।’
‘না, তুমি বসো। দেশের কী অবস্থা?’
পত্রিকা সরিয়ে এক পাশে ভাঁজ করে রাখলেন সিদ্দিকুর।
‘আমি সাংবাদিক বলে আমার কাছে দেশের খবর সব থাকবে?’
আজিম ইচ্ছে করেই ওভাবে বললো।
‘অবশ্যই। তুমি দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছো। কাজ করছ খবর নিয়ে। মানুষ তোমার কাছেই তো খবর জানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।’
আজিম ভাবতে থাকে। এর কী উত্তর হতে পারে? আসলেই কি আজিম খবরের সাগরে ভেসে বেড়ায়? মানুষ চাইলেই কলসিতে করে বা বোতলে করে চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়? কাগজের দাম বাড়ছে। মানুষ বাসায় পত্রিকা রাখা কমিয়ে দিচ্ছে। এখন অনলাইনের সময়। চাইলেই পকেটে থাকা ফোনেই খবর পড়ে নেওয়া যায়। আগে সারাদিন কাজ করে একটা সংবাদপত্র প্রকাশ হতো। এখন ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চলে এসেছে। যা মিনিটে মিনিটে খবর সাপ্লাই দেয়। তাতে তো কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। খুশি হওয়ার কথা। মুহিত সেদিন লিখেছে, ওজন কমানোর পাঁচ উপায়। সেটা সেদিন সবচেয়ে বেশি পঠিত সংবাদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এডিটর পর্যন্ত বাহবা দিয়েছে ওকে। আমেরিকার নির্বাচন, ইউরোপের বাজারের খবর পর্যন্ত এখন মিনিটে মিনিটে আপডেট করা যায় দেশে বসে। কিন্তু, যমুনায় ভেসে যাওয়া গ্রামের স্কুলটার আপডেট কী? কবে আবার স্কুলটা চালু হবে সেই খবরটা মেলে না এত এত অনলাইনে। কাগজে আরো মেলে না। এখন কাগজের অনেক দাম।
‘থাক, দেশের অবস্থা বলতে হবে না। তোমার অবস্থা বলো। লেখাটা চালু রেখো। ছেড়ে দিও না। রিপোর্ট না লিখতে পারো এখন, কলাম লিখবে। তুমি কলামও ভালো লিখতে পারো।’
‘কলেজে পড়ার সময় ডিরোজিও কে নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। আপনার মনে আছে?’
`হ্যাঁ। ডিরোজিওর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলে। আমাদের শহরের সাপ্তাহিক পত্রিকাটায় ছাপা হয়েছিল সেটা। বেশ মনে আছে।’
‘এসএসসি পরীক্ষার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় বইটি কিনে দিয়েছিলেন আপনি। এক উপন্যাসে কত চরিত্র, কত ইতিহাস। কত কত নায়ক।’
‘তোমার ওই লেখা ছাপানোর কয়েক দিন পর ওই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আমার দেখা। আমাকে বলে, স্যার লেখাটা আপনার ছেলেই লিখেছে নাকি আপনি সাহায্য করেছেন? দিয়েছিলাম ধমক। ও নিজেই লিখেছে।’
‘তাই নাকি। এ কথা তো বলেননি কোনো দিন?’ আজিম অবাক হয়।
‘ওতটুকু বয়সে তোমাকে ওই কথা বললে তোমার কনফিডেন্স কমে যেতো। আমার মনে আছে, উপন্যাসটা পড়ে তুমি ডিরোজিওর ওপর আরো দুইটা বই পড়ে ফেলেছিলে।’
আজিম চায়ে চুমুক দেয়।
আজিম ভাবছে, সে বাসায় এলো। তার বাবাকে চোখে পড়লো না কেন? এসেই অবশ্য নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। গোসল করেই ঘুম দেয়। অফিসেই রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলে আজিম। ছোটবেলায় রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার শুরু করতে হতো। সিদ্দিকুর রহমানের কড়া নির্দেশ। রাত আটটায় বিটিভির বাংলা সংবাদ শুরু। সেটা দেখে তারপর খাওয়া। আর ১০টার দিকে ঘুম। আজিম হলেও রাত আটটার দিকে খেয়ে ফেলতো। অভ্যাসটা এখনো আছে।
বাবা তো ওর ঘরেও শুয়ে থাকতে পারতো। আজিম আসলে কিছু মেলাতে পারছে না।
‘আমি বাসায় আসার পর আমাকে ডাকলেন না কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?’ আজিম এবার প্রশ্নই করে।
‘আরে ওদের সাথে খেয়ে ড্রইংরুমেই সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। কখন যে ঘুম এসে গেলো টের পাইনি। বাতিটাও নেভানো ছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি।’
এটা ঠিক। আজিম নি:শব্দে বাসায় ঢুকে। না পারতে ড্রইং বা ডাইনিংয়ের বাতি জ্বালায় না। এমনিতেই দেরি করে বাসায় আসে। এর ওপরে রাতে শব্দ করাটা আসলেও অন্য দুইজনের ওপর অন্যায়।
‘তুমি কেমন আছো সেটা বললে না কিন্তু।’ সিদ্দিকুর চশমার কাঁচ মুছলেন।
‘এইতো বাবা। চলছে।’
‘না। সামথিং রং। আমাকে বলো।’ সিদ্দিকুর ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘তেমন কোনো সমস্যা না।’
‘তাহলে যে স্বপ্নটা দেখছো, ঘুম ভাঙছে রাতবিরাতে সেটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না?’
‘বলেন কী? আমার এ কথা আপনি জানলেন কী করে?’ আজিম অবাক হয়। সাদেক বা আফজালের কেউ বলবে। এরা যে কী?
‘আমাকে বলো।’
আজিম পানি খেলো। সিদ্দিকুর এমনিতেই তাকে নিয়ে টেনশন করেন। এসব স্বপ্ন টপ্নের কথা বলে তাঁকে চিন্তায় ফেলার ইচ্ছা ছিল না আজিমের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাবাকে বললেই একটা সুরাহা মিলবে।
‘বিষয়টা তোমাকে নিয়ে হেলমেট মানবেরা হাসাহাসি করে ওই পর্যন্তই? নাকি আরো কিছু দেখো?’ সিদ্দিকুর জানতে চাইলেন।
‘মাঝে মাঝে একটু বেশিও দেখি। হঠাৎ এক হেলমেট মানব দৌড়ে আসতে থাকে। হাতে বড় একটা লাঠি। এটা দিয়ে সে আমার মাথায় জোরে আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি মাটিতে বসে পড়ি। লাঠির আঘাতে আমার মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যায়। বেরিয়ে যায় মগজ, রক্তে মুখটা ভরে যায়। আর….’
‘আর কী?’ সিদ্দিকুর মন দিয়ে শুনছেন।
‘মাথাটা ফেটে যাওয়ার সাথে সাথেই মাথাটা থেকেই কতগুলো বর্ণ, শব্দ দৌড়ে বের হয়ে গেলো! ঠিক যেমন কোনো বস্তা বা ব্যাগে আটকা ইঁদুর ছাড়া পেলে যেভাবে দৌড় দেয়, ঠিক সেই রকম।’
‘বর্ণগুলো বা শব্দগুলো কীসের?’
‘জানি না। আমি খেয়াল করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এরপরই ঘটে আরেকটা ঘটনা। একজন হেলমেট মানব একটা সংবাদপত্র নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসতে থাকে। আরেকজন হেলমেট মানব একটা হেলমেট নিয়ে আসতে থাকে। আমার মগজবিহীন রক্তাক্ত মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে দিতে থাকে। এমনকি চোখটাও ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকার হয়ে আসে সবকিছু।’
আজিম ঘামতে থাকে। শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। টেবিলে মাথা ফেলে দুই হাত দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা অসম্ভব যন্ত্রনা করে বাবা।’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছো কী রক্ষা করা দরকার? ওই শব্দগুলো বেঁচে থাকুক, বর্ণগুলোও।’
‘এই আজিম। আজিম। উঠ। কীরে কী হলো তোর?’ সাদেক ডাকছে।
আজিম মাথা তুলে তাকালো, চোখে বিস্তর ঘুম।
‘কীরে, ডাইনিং টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন?’ সাদেক অবাক হলো।
আজিম মাথাটা তুলে এদিক ওদিক তাকালো। সকালের রোদ এসে পড়েছে টেবিলে। গরমে ঘেমে গেছে আজিমের শরীর।
‘উঠে রুমে যা। রুমে গিয়ে ঘুমা। কখন এসেছিস এখানে?’
আজিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো।
‘কীরে কিছু খুঁজছিস?’ সাদেকের প্রশ্ন। আফজালও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
বাসায় আর কেউ নেই। আজিম বুঝতে পেরে আর কিছু বললো না।
‘আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই। মুখ ধুয়ে আসছি। নাস্তা করব তোদের সাথে।’
‘আজিম, তুই বাড়ি যাবি কবে? ভাবছি ছুটি পেলে তোর সাথে যাব। কাকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তোর সাথে না হয় থাকলাম দিনটা।’ আফজাল বলে।
‘তাই তো। কবে যেন আজিম?’ সাদেক বলে।
‘আগামী সপ্তাহে। ১৭ তারিখ। বাবার মৃত্যুর এক বছর হবে।’ আজিম খেয়াল করলো টেবিলে দুই কাপ চা। একটা শেষ হয়েছে। আরেকটাতে কেউ চুমুক দেয়নি।
পরিশিষ্ট
দুপুরে অফিসে যাচ্ছে আজিম। মেট্রোরেলের গেটের নিচে এক ভবঘুরে লোক বসা। এই গরমে তার গায়ে চাদর। দুই পাশে পুরানো ছেঁড়া কম্বল। এ ধরণের ভবঘুরে ঢাকা শহরে অনেক। তারপরও আজিম দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মাথায় হেলমেট। এমন হতদরিদ্র, ভবঘুরে লোকটার মাথায় লাল একটা হেলমেট। যার সামনের দিকটা কালো গ্লাসে ঢাকা!
‘ভাই, ওরে কী দেখেন। পাগল। ওভারব্রিজ নাইলে মেট্রোরেলের গেটের কাছে বইসা থাকে হেলমেট পইরা, চাদর গা দিয়া। এখন দেখি এখানে বইসা পড়সে। কবে উঠব কে জানে।’
সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার বলছিল আজিমকে এসব কথা।
হঠাৎ করে ভবঘুরেটা হেলমেটের গ্লাসটা উপরের দিকে তুললো। আজিমের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।
আজিমের দিকেই তাকিয়ে বললো, ‘কীরে, হেলমেট পড়বি?’