বাঙলার কিছু বিলুপ্ত বই পুস্তক
বহু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েও কালের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, কখনোবা লেখকরা সমসাময়িক সময়ে গুরুত্ব পেয়েও পরে হারিয়ে গেছেন। কোথাও চর্চার আড়ালে, কোথাও বা পুস্তকের দুর্লভ হওয়ার কারণে কোথাওবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে বইপত্র অনেকসময় ধ্বংস হয়ে স্মৃতির ধুলোতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
এখন যে বইয়ের কথা বলছি যথা ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘মসূয়ার ইতিহাস’, ‘ধ্রুব’, ‘বিক্রমাদিত্য’ ও ‘প্রতাপাদিত্য’, এই সকল বইয়ের রচয়িতা শ্রদ্ধেয় শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য—সম্পর্কে আমার মায়ের ঠাকুরদা হন। আমার মা শ্রীপূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী প্রতাপ ভট্টাচার্য্যের সন্তান। পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের স্ত্রী শ্রীমতী সুনীতি দেবীকে আমি দেখেছি ও তার মুখে ছেলেবেলায় কিছু গল্পও শুনেছি, তাঁকে সম্বোধনে বম্মা (বড়মা থেকে) বলে ডাকতাম। এই পাঁচটি বইয়ের প্রতিটিই রচনার দিক থেকে ভিন্ন। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের কারণে ১৩৫৪ সনের ১২ই চৈত্র মসূয়ার (বর্তমান বাংলাদেশের ময়মসিংহ জেলার মসূয়া গ্রাম) বাড়ি (ভারতী কুটীর) ত্যাগ করে স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুই কন্যা নিয়ে তাকে ভারতবর্ষে আসতে হয়। সেইসময় স্বভাবতই তাঁকে বেশ অর্থকষ্টে পড়তে হয় কিন্তু এসবের মধ্যেও ক্রমাগত নিজের সাহিত্যসৃষ্টি অব্যাহত রেখেছিলেন।
প্রথমে গৌরীপুর, কালীপুরে কিছুদিন কাটিয়ে মালদার চাঁচলে বাস করেছিলেন। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন শারীরীকভাবেও খুব সুস্থ ছিলেন বলে জানা যায় না। ১২৯০ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া নামক বর্ধিষ্ণু গ্রামে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য জন্মগ্রহণ করেন। এই মসূয়া গ্রামেই শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম হয়। বম্মার মুখে শুনেছি বড়দাদু তথা শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের বিশেষ সুহৃদ ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যের বিভিন্ন কর্ম নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। তাঁর যেসকল বই বিশেষ জনপ্রিয় ছিল তার মধ্যে ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘বিক্রমাদিত্য’, ‘কেদার রায়’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘ধ্রুব’, ‘মসূয়ার ইতিহাস’ উল্লেখযোগ্য। শিশুসাহিত্যের এই মূলগ্রন্থগুলি ছাড়াও পাখি নিয়ে বিশেষ কিছু কাজ করেছিলেন যথা ‘গায়ক পাখি’, ‘বাংলার পাখি’, ‘পক্ষীতত্ত্ব’। বাংলার পাখি সম্পর্কে শিশুদের সম্যক জ্ঞান হোক এই আশায় এসকল বই তিনি লিখেছিলেন। এই বইগুলো আজ প্রায় দুর্লভ। ১৩৬০ সনের ১লা বৈশাখ তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
আমাদের মহাকাব্যের দিক থেকে “মহাভারত” মানুষের সংবেদনশীলতাকে, জীবনযাপনকে বোঝার সবচেয়ে অপূর্ব সৃষ্টি। সম্ভবত ছোটদের মহাভারতকেই এখানে ‘ছেলেদের মহাভারত’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এখন সময় ও উন্নত ভাবনায় এসে এই নামকরণে আমাদের অসন্তোষ থাকতেই পারে। তবে যেভাবে ছোটবেলাকে ছেলেবেলা বলা হয় এটা তারই সাদৃশ্যযুক্ত প্রয়োগ সমসাময়িক প্রভাব থেকে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচিত ‘ছেলেদের মহাভারত’ প্রকাশের বেশ কয়েকবছর পরে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ‘ছেলেদের মহাভারত’টিও প্রকাশিত হয়। সেইসময়ের বিশিষ্ট প্রকাশক ‘বৃন্দাবন ধর এন্ড সন্স লিমিটেড” থেকে এই বই প্রকাশিত হয়। তিনটি স্থানে এই প্রকাশনার অফিস ছিল যথা ৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা, ৯০, হিউয়েট রোড, এলাহাবাদ এবং ৭৮/৬, লায়েল স্ট্রিট, ঢাকা”। এই প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ছিল আশুতোষ লাইব্রেরি। এই আশুতোষ লাইব্রেরিই তাঁর বেশীরভাগ বই প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিল। এই প্রকাশনী সেইসময়ের বিখ্যাত প্রকাশনীদের অন্যতম। ওখান থেকে ছোটদের বই বেশি প্রকাশিত হতো। এই প্রকাশনা থেকেই ‘শিশুসাথী’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকায় বহু বিশিষ্টজনেরা লিখেছেন নিয়মিত। এই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদনাও করেছেন। সেই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ও রমেশ্চন্দ্র মজুমদার দুজনের পরিবারের মধ্যে বিশেষ ভাবের সম্পর্ক ছিল বলে জানতে পারি। শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য’র অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়।
১৩৫৬ সনে ‘ছেলেদের মহাভারত’-এর চতুর্থ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। সেইসময় এই বইটির মূল্য ছিল আড়াইটাকা। এই বইটি মুদ্রিত হয়েছিল ‘নিউ আর্য্যমিশন প্রেস (১১নং রঘুনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা)’ থেকে। ‘ছেলেদের মহাভারত’ আসলেই শিশুদের সুখপাঠযোগ্য একটি বই। আঠারোটি পর্বে রচিত এই মহাভারত অতি সরল সহজ ভাষায় রচিত। মূলগ্রন্থটিতে ব্লক প্রিন্টের অপূর্ব সব ছবি সাযুজ্য বজায় রাখে। দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, অভিমন্যুর যুদ্ধ, ভীম ও বকরাক্ষস এইসব ছবি মনের মধ্যে রচনা ও চিত্রের যুগপৎ ব্যবহারে দারুণ কল্পজগৎ সৃষ্ট করে। মহাভারতটি পড়লে বোঝা যায় কিশোর-কিশোরীদের মনের কথা ভেবেই যেন সতর্ক থেকে লেখা হয়েছে। প্রকাশভঙ্গি সাধুভাষায় হলেও তা ভীষণভাবে বোধগম্য। “মাকে বলিও,—বাবাকে বলিও,—জ্যেঠা মহাশয়,—মাতা দ্রৌপোদী আর অপরাপর সকলকে বলিও—অভিমন্যু বীরের মতো মরিয়াছে। আর বলিও অভিমন্যু শত্রুর নিকট একটিবার দয়া ভিক্ষা করে নাই—যুদ্ধে বিন্দুমাত্র ভয় পায় নাই; অভিমন্যু বাপের মান রাখিয়াছে। সূত! তুমি আরো বলিও, আমার জন্য যেন কেউ কাঁদেন না”—যুদ্ধ শেষে বালক যোদ্ধা অভিমন্যুর তাঁর সারথির প্রতি কথাকে তিনি এইপ্রকারের ভাষায় লিখেছেন। যার ফলে “ছেলেদের মহাভারত” পরপর ঘটনার পারম্পর্যে এক সুখপাঠ্য রচনা হয়ে উঠেছে।
১৩৩৬ সনে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য কতৃক ৭নং বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট (কলকাতা) থেকে তাঁর লেখা ‘মসূয়ার ইতিহাস’ প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে এর মূল্য ছিল ২ টাকা। ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অধীনে মসূয়া গ্রামের কাশ্যপবংশীয় ব্রাহ্মণ ও মৌদগল্য গোত্রীয় কায়স্থগণের বংশ পত্রিকা, বংশ-বিবরণ, প্রধান ব্যক্তিগণের জীবনী ও অন্যান্য কথা নিয়ে এই বই। এটি মূলগ্রন্থে ‘প্রথম ভাগ, ব্রাহ্মণ কাণ্ড’ নামে অভিহিত। এই গ্রন্থের শেষে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য খেদোক্তি করেছেন—“এই ইতিহাস সংগ্রহ করিতে গিয়া আমি পদে পদে বিশেষ বাধা পাইয়াছি। গ্রামের প্রায় কাহারও নিকট সহানুভূতি পাই নাই। এমনকি বইখানা লেখা হইলে পরেও সকলকে পুনঃ পুনঃ আহ্বান করিয়াছি। বড় দুঃখ এই যে, এমন একটা গুরুতর বিষয় বুঝিবার বা জানিবার কাহারও একবিন্দু কৌতূহল নাই।”
তিনি এও বলেছেন—“বিভিন্ন অসুবিধের কারণে এর সব অংশ প্রকাশ পায়নি। এটা প্রথম ভাগ। সম্ভব হলে পরে বাকিটা প্রকাশিত হবে।” সেই ভাবনা থেকেই হয়তো এই বই ‘প্রথম ভাগ, ব্রাহ্মণ কাণ্ডের’ নামে নামাঙ্কিত ছিল। মূলত যাঁর মুখনিঃসৃত উপদেশ বাণী শুনে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য এই বই লিখতে তৎপর হয়েছিলেন তাঁর সেই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠপুরুষ শ্রী ঈশান চন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে এই বই তিনি উৎসর্গ করেছেন। বইটি বাঙালির জীবনচরিত বোঝার এক অপূর্ব ঐতিহাসিক কাজ। সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, খাওয়া-দাওয়া, বেশভূষা সমস্ত কিছুর সুন্দর বিবরণ এই বইতে পাওয়া যায়।
ব্রহ্মপুত্র যেখানে “আড়ালিয়া খাত” নামে পরিচিত ছিল সেইসময়, সেখানে নদীর ভাঙনে প্রতি মাসে বাসস্থান সরিয়ে নিতে হতো সেই থেকে গ্রামের নাম হলো ‘মাস্যা’—এটাই নাকি মসূয়া নামের উৎপত্তির প্রাথমিক কারণ। কেউ বা বলেন মা অসূয়া থেকেই নাকি মসূয়ার উৎপত্তি। একদিকে ঈশা খাঁ অন্যদিকে সম্রাট আকবর আর এদিকে বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় এইসমস্ত প্রভাব ছাড়িয়ে কিম্বা নিয়ে বাঙ্গালি জাতি তার সাধারণ জীবন কিভাবে যাপন করত তারই ঐতিহাসিক নিদর্শন এই বই। মসূয়া ছাড়াও তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার ভিটাদিয়া, নওপাড়া, উখড়াশাল, বাণিয়াগ্রাম, আচমিতা এইসব অঞ্চলের কথা এবং বিভিন্ন গোত্রের ব্রাহ্মণদের জীবনযাপনের সম্যক পরিচয় এই বই থেকে পাওয়া যায়। এখানে শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য নিজেদের বংশের বিশিষ্ট পণ্ডিতগণেরও কথা বলেছেন। সেইসময় দাবা, পাশা ছাড়াও ‘বলাই নিয়া পালাই’, ‘কান্দুরে কান্দু’ (গাছে চড়ে), মেয়েদের সব অভিনব খেলা ‘বাঘবন্দী’, ‘চাপিলা চুপিলা’, ‘লল্ট গোঁসাই’ প্রভৃতি খেলাধূলার প্রভাব ছিল।
পোশাকে গরদ, তসর ছাড়াও গিলাপ, বনাত, দোলাই—এইসব বস্ত্রের উল্লেখ আছে। প্রথম কিভাবে চাল ধোয়া জলের ব্যবহারে লেখার কালি প্রস্তুত হতো সেকথাও এখানে লিপিবদ্ধ আছে। স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারেও এই বইতে নিজের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে বাঙ্গালির সংস্কৃতির ইতিহাস জানার অনবদ্য এক বই এই ‘মসূয়ার ইতিহাস’। ১৩২৪ সনে সম্ভবত এই বইটি প্রকাশিত হয়। এর সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৫৭ সনে। এই বইটির প্রকাশকও ‘বৃন্দাবন ধর অ্যান্ড সন্স লিমিটেড’। এটি মুদ্রিত হয়েছিল ‘শ্রীনারসিংহ প্রেস (৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট,কলকাতা ‘ থেকে। বইটির সেইসময় মূল্য ছিল ‘দশ আনা’। শিশুসাহিত্যের জনপ্রিয় এই বইটি সেইসময়ে ডিরেক্টর বাহাদুর কর্তৃক অবিভক্ত বাংলার সমস্ত স্কুলের পুরস্কার ও লাইব্রেরির পাঠ্যপুস্তক রূপে অনুমোদিত ছিল। বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, এই কাহিনী পড়ে যাতে শিশুরা ভক্তিপরায়ণ হয় এটাই তাঁর একান্ত কামনা। গল্পটি পড়লে বোঝা যায় একটি সদর্থক, ইতিবাচক শিশু চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সততাকে সাফল্য ও সুখের উপকরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। এধরনের বই নিঃসন্দেহে শিশুমনে সুপ্রভাব আনতে সক্ষম হয়েছিল। ধ্রুব ও ধ্রুবতারার এই যে গাঠনিক মেলবন্ধন তিনি দেখিয়েছেন তাতে কল্পনার প্রভাব থাকলেও তা খুব সহজেই মনের কাছাকাছি এসে যায়। ঐতিহাসিক গল্প রচনার দিক থেকে এই বইটি অন্যতম। ছয় আনা মূল্যের এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৩২২ সনে। এর প্রকাশক ছিলেন ‘পপুলার লাইব্রেরী, ঢাকা’ এবং এটি ঢাকার আশুতোষ প্রেস হতে মুদ্রিত হয়েছিল। গোলকপুর, ময়মনসিংহের জমিদার উপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী বাহাদুরকে তিনি এই বই উৎসর্গ করেছিলেন। মূলত বিক্রমাদিত্যকে কেন্দ্র করে এই কাহিনী আবর্তিত হলেও এখানে বারবার রাজ্যের কথা এবং অবশ্যই মহাকবি কালিদাসের কথা এসেছে। ভূমিকায় অবশ্য তিনি লিখেছেন যেহেতু মহারাজ বিক্রমাদিত্যের কোনো প্রামাণিক ইতিহাস নেই তাই কিংবদন্তীর ওপর নির্ভর করেই এই বই তাকে লিখতে হয়েছে। সংস্কৃত শ্লোকের প্রাসঙ্গিক প্রয়োগে এবং কাহিনীর সহজবোধ্য ভাষায় এই বইটিও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বই। শিশুদের কাছে কিভাবে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি গল্পের ছলে সামঞ্জস্য রেখে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা যায় এই বই তার উপযুক্ত নিদর্শন।
তাঁর রচিত ‘প্রতাপাদিত্য’ নামক বইটিও বাঙালির যুদ্ধ ও বীরত্বের ইতিহাসের এক যোগ্য নমুনা বলা যায়। বাঙ্গালির শক্তি মোগলের আধিপত্যেও যে একেবারে হীন হয়ে যায়নি, তারা যে ক্রমাগত সাহস দেখিয়ে বাংলাকে রক্ষা করার প্রয়াস নিয়েছে তা স্পষ্টভাবে এই রচনাতে প্রতিভাত। বিভিন্নরকম বাধা-বিপত্তি থাকলেও সবসময় সাহিত্যের কাজ করার চেষ্টা করেছেন একাগ্রমনে, তাই হয়তো অন্যদিকের স্বচ্ছলতার প্রতি তোয়াক্কাও করেননি। তার সাহিত্যকর্মের কথা সেই সময়ে কারোরই অজানা ছিল না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শ্রীনলিনীরঞ্জন সরকার (অর্থ সচিব, পশ্চিমবঙ্গ), সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক), রায় বাহাদুর জলধর সেন, অমৃতলাল বসু, ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার (ভাইস চ্যান্সেলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন (ভাইস চ্যান্সেলর, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়), ডাঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মহামহোপাধ্যায় আদিত্যরাম ভট্টাচার্য্য (প্রো-ভাইস চ্যান্সেলার, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস), রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র (জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ও ‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মেলন’-এর সম্পাদক), রায় বাহাদুর সুরেশচন্দ্র সিংহ (ম্যাজিস্ট্রেট, হাওড়া), পদ্মিণীভূষণ রুদ্র (অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম কলেজ), শশাঙ্কমোহন সেন, সঞ্জীবচন্দ্র চৌধুরী (অধ্যাপক, নেপাল রাজ কলেজ), মৌলভী মহম্মদ ইছরাইল (বি-এল ওয়াকফ কমিশনার), সুরেশচন্দ্র ঘটক, ডাঃ নলিনিকান্ত ভট্টশালী (কিউরেটর, ঢাকা মিউজিয়াম) এঁদের সকলের বন্ধুতা, সম্মতি ও প্রশংসা তার সাহিত্যজীবনের সহায়ক ছিল।
তাঁর সাহিত্যকর্মের বিষয়ে অবগত হয়ে স্বয়ং রবিঠাকুর ১৩৩২ সালের ৩০শে ফাল্গুন তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা প্রকাশ করেন, তাঁর কিছুটা অংশ এইরকম—“শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় যে কাজে জীবন নিয়োগ করিয়াছেন তাহার কিছু কিছু পরিচয় পাইয়া আমি বিশেষ আনন্দলাভ করিয়াছি।” শোনা যায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন নিতান্ত সরল মানুষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশেষ স্নেহ করতেন তাঁকে। এই মেধাবী ও সরল মনের মানুষটির সঙ্গেও পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের একপ্রকার বন্ধুতা ছিল। তিনি শ্রী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে লিখেছিলেন—“নমস্কার দাদা, আপনার পাখী আর বাঙ্গালির গল্প প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আবশ্যক। শিক্ষকেরাও ইহার প্রয়োজনীয়তা গ্রহণ করিবেন।” শ্রদ্ধেয় উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তাঁকে লিখছেন—“আপনার ‘গায়কপাখী’ সবগুলিই চেনাজানা অথচ কাহারো জীবনকথা আমাদের জানা নেই। আপনি জানাইলেন, বঙ্গ সাহিত্যের ইহা অভিনব সম্পদ হিসাবে গণ্য হইবে।” দুঃখের কথা এইসব বই এখন পাওয়াই যায় না, বাঙালি এইসকল বই এর কথা বর্তমানে জানেই না।