প্রকৃত ইসলামী সমাজ সব ধর্মাবলম্বীর সমানাধিকারের রক্ষাকবচ
ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুর মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব সম্প্রদায় আইনগত ও সামরিক-বেসামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানবতার আহাজারি থামাতে পারছে না। বরং ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরেও মুসলিমরাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। ‘ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা: পর্ব- ৬
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো বিষয়ে চিন্তার শৈথিল্য ও বিভ্রান্তি আসে ইতিহাসহীনতা, অজ্ঞানতা ও কুপমণ্ডুকতা থেকে। অথচ ইসলামে, যে কোনো বিষয়ের মতোই অমুসলমান ও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে আচরণ ও নীতিমালার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র অজ্ঞানতা ও কুপমণ্ডুকতার কোনো স্থান নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলাম ধর্মে মানুষের ওপর কোনোরূপ জবরদস্তি নেই। ধর্ম প্রচারে কেবল যুক্তি প্রয়োগ করতে হবে; সদুপদেশ ও সদাচরণ অবলম্বণ করতে হবে। প্রতিমা-পূজকের প্রতিমাকে পর্যন্ত মন্দ বলা নিষিদ্ধ রয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা আন আমের ১০৮তম আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য দেব-দেবীর উপাসনা যারা করে তাদের উপাস্যদের তোমরা গালি দিয়ো না।’
ইসলামের বিধান মতে, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মজলুমকে সাহায্য করতে হবে। আল্লাহতায়ালা এমন কারও প্রতি দয়া করবেন না, যে আল্লাহর সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়াশীল নয়। অমুসলমানকে যে মুসলমান পীড়া দেয়, নিগৃহীত করে বা অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখে সে প্রকৃত বিচারে মুসলমান নয়। এসবই পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের কথা-কাজ তথা হাদিসের শিক্ষা। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দাবি প্রতিষ্ঠা করে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ফরমান জারি করেছিলেন তা থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলমানের স্থান, মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি বলেছেন, ‘অমুসলিমের জীবন আমাদের জীবনের এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতোই।’
আদি ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার সনদে অমুসলমানদেরকে মদিনায় বসবাসের অধিকারসহ সকল সামাজিক-রাজনৈতিক-নাগরিক-আইনগত অধিকার দিয়েছিল। এমনকি তাদের একটি অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও অন্য অংশের প্রতি কোনোরূপ অন্যায় আচরণ করা হয়নি। আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সর্তক থাকো সে ব্যক্তি সম্পর্কে, যে ব্যক্তি অমুসলমানের ওপর জুলুম বা নির্যাতন করে অথবা তাদের হক বা অধিকার নষ্ট করে অথবা তাদের সামর্থ্যরে চাইতে বেশি কাজের বোঝা চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়; আমি কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়বো।’
মুমিন-মুসলমানদের আমির বা নেতা হজরত উমর (রা.) শুধু রাজ্য শাসনকালেই নয়, মৃত্যুকালেও অমুসলমানের অধিকার সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে যান।
এ প্রসঙ্গে ইসলামের মূল ভাবনা সম্পর্কে গভীর অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে, যে ধর্ম কেবলমাত্র ধর্ম নয়, দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থাও বটে, জাতিগঠন করলে কোনোভাবেই আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি বা প্রতিক্রিয়াশীলতা আসতে পারে না। আক্রমণ ও প্রতিক্রিয়ার মনোভাব তাদের ক্ষেত্রেই আসতে পারে এবং ইতিহাসের বিচারে এসেছেও, যারা ধর্মের ছদ্মাবরণে ছ্যুৎমার্গের কিংবা বৈষম্যের বা অসাম্যের ধ্বজ্বা ধারণ করে। যারা সমাজ-সংসারে চাণক্য বা মেকিয়াভেলির সুবিধাবাদ ও নীতিজ্ঞানহীনতা প্রচার ও গ্রহণ করেছে, যাদের ধর্ম পুরোহিত সমাজভিত্তিক ব্যক্তিগত পূণ্য লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং যারা ধর্ম ও বাস্তব জীবনে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কে রূপরেখা সম্পর্কে অজ্ঞ ও দিক-নিদের্শনা শূণ্য, তাদের সমস্যা আর ইসলামের সমস্যা তাই কোনোভাবে এক নয়। যেহেতু ইসলাম ব্যক্তিগত ও মানসিক নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সেহেতু প্রকৃত মুসলমানের একটি বাস্তব ও পালনযোগ্য জীবন-দর্শন এবং জীবন-মিশন রয়েছে।
অন্য ধর্মীয়দের এটা নেই বলেই, তাদের বৈষয়িক ও ধর্মীয় বিষয় আলাদা করতে হয়। এদের ধর্ম অন্য ধর্মের লোককে ঘৃণা করতে শিক্ষা দিতে পারে এবং ধর্মকে তত্ত্বগতভাবে একটি নিরাপদ স্থানে রেখে বৈষয়িক ও জাগতিক বিষয়ে নীতিজ্ঞানহীনতার অবলম্বন করতেও অবাধ সুযোগ দিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ হিসাবে সকল মানুষের সম্মান, মর্যাদা, অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হবে- কারণ সকল মানব সম্প্রদায়ই ইসলামের দৃঢ়তর বিশ্বাস মতে, আল্লাহর সৃষ্টিকূলের সদস্য। কাজেই ইসলামী সমাজে ও বিশ্বাসে সম্প্রদায়গত লাভের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কেবল সম্প্রদায়গত উন্নতি করলেই মুসলমানের কর্তব্য শেষ হয় না; যুক্তি ও আইন দ্বারা সমাজে সকলের জন্য কল্যাণ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই মুসলমানের কাজ।
বিভিন্ন ধর্মে কোনো ধর্মীয় অনুশাসন পালন না করেও সেই ধর্ম-সম্প্রদায়ের সদস্য থাকা যায়; কিন্তু ইসলামে কেবলমাত্র সম্প্রদায়গত মুসলমানের কোন মূল্য থাকবে না, যে পর্যন্ত সে বাস্তব জীবনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় গণ্ডিতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা না করবে। অতএব ইসলামী সমাজ মানে কেবলমাত্র মুসলমানের সমাজ নয়; ইসলামী শাসন মানে কেবলমাত্র মুসলমানদের সম্প্রদায়গত-শ্রেণীগত শাসন নয়। ইসলামী সমাজ ও ইসলামী শাসন মানে, এমন একটি সমাজ কাঠামো ও শাসন ব্যবস্থা, যেখানে ইসলামের মূলভাবের ওপর ভিত্তি করে শাসন-প্রশাসন-বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে; মানুষ হিসাবে মানুষ যেখানে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-অঞ্চল-লিঙ্গ নির্বিশেষে পরিপূর্ণ মানবিক সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার পেয়েছে; অর্থনীতি থেকে সমাজতত্ত্ব, বিজ্ঞান থেকে শিল্পকলা-সাহিত্য তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলাম যে মানববান্ধব, কল্যাণধর্মী ও প্রগতিশীল পথ নিদের্শ করে, আপামর মানুষের জন্য সেই পথ অবারিত করাই ইসলামী সমাজের লক্ষ্য; সেই পথের কল্যাণ সকলকে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়াই ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।
সেজন্য প্রকৃত ইসলামী সমাজই হবে মুসলমান ও অমুসলমান নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকারের সনদ এবং মানবিক সম্মান, মর্যাদা, কল্যাণ ও অধিকারের রক্ষাকবচ। এই কথাটির ব্যাপক অর্থ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা নিয়োজিত শুধু তারাই নন, সকল মুসলমানকেই বুঝতে হবে ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিপালন করতে হবে এবং কোনরূপ অপবাদ ও পূর্ব-ধারণার বাইরে এসে নিজেদের বাস্তবসম্মত কল্যাণ, মর্যাদা, সম্মান, অধিকার ও নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে অমুসলমান ভাই-বোনদেরকেও অনুধাবন করতে হবে।
আরও পড়ুন: পর্ব- ৫: ‘মদিনা সনদ’ নাগরিক সমানাধিকারের এক অনন্য উদাহরণ