মাসিক, প্রসব পরবর্তী স্রাব, দুধ পান করানো ও গর্ভাবস্থায় রোজার বিধান
-
-
|

নারীদের নানাবিধ অসুস্থতা রোজার মাস নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের প্রধান অন্তরায়, ছবি: সংগৃহীত
বছরের বারো মাসই ইবাদতের মাস। বারো মাসই আমাদেরকে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল ইবাদতে কাটাতে হবে। কোনো মাসে ছাড় নেই। তবে রমজান হচ্ছে একটা সোনালী সুযোগের মতো। এ মাসে আল্লাহতায়ালা শয়তানকে বেঁধে বান্দাকে সুযোগ করে দেন নেকির কাজ করে আমলনামা ভারি করার।
প্রত্যেক নারী-পুরুষিই চান রমজান মাসে খুব বেশি করে ইবাদত করতে। কিন্তু চাইলেই তো আর সব হয় না, নারীদের নানাবিধ অসুস্থতা পুরো রোজার মাস নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের প্রধান অন্তরায়। তাই বলে এটা নিয়ে মন খারাপের কোনো কারণ নেই। এটা আল্লাহর বিধান।
মাসিক ও প্রসব পরবর্তী স্রাবের সময়কার রোজা
রমজান মাসে বা তার কিছু আগে যদি কেউ মা হন, তবে প্রসব পরবর্তী স্রাব (নেফাস), শারীরিক দূর্বলতা ও বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মায়ের পক্ষে রোজা পালন সম্ভব হয় না। কোনো উপায়ও থাকে না প্রসব পরবর্তী স্রাব বন্ধ রেখে রোজা রাখার। তবে মাসিক পিরিয়ড ঔষধ সেবন করে বন্ধ রাখা যায়। মাসিক পিরিয়ড বন্ধ রাখা ও না রাখা নিয়ে প্রথমে আলোচনা করা যাক।
মাসিক পিরিয়ড বন্ধ না রেখে রোজা
ক. রমজান মাসে কেউ যদি হায়েজ বা নেফাসের কারণে রোজা রাখা থেকে বঞ্চিত হয়, তবে অবশ্যই তাকে পরবর্তীতে যতগুলো রোজা বাদ পড়েছিল সব কাজা আদায় করতে হবে। কোনো কাফফারা নেই। শুধু একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা রাখবে।
খ. এই রোজাগুলো সে একাধারে বা দুই-একদিন বাদ দিয়ে, বাদ দিয়ে রাখতে পারবে।
গ. হায়েজের রোজা শাওয়াল মাসে রেখে এরপর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখা উত্তম। তবে কেউ যদি কাজা রোজা শাওয়ালে না রাখে, তবে বছরের অন্য যেকোনো মাসেও রাখতে পারবে।
ঘ. নেফাসের রোজা যেহেতু অনেকগুলো হবে তাই সেটা শাওয়াল বা পরবর্তী যেকোনো মাসে বা পরের রমজান আসার আগে পুরো বছর মিলিয়ে সপ্তাহে দুই-তিনটা বা আরও কম বেশি করে রেখে কাজা আদায় করতে পারবে।
ঙ. নেফাসের সর্বোচ্চ সীমা ৪০দিন। তবে কারও এর বেশি বা কম দিনও হতে পারে। যদি ৪০ দিন হওয়ার আগেই কেউ পবিত্র হয় তবে তার শরীর সুস্থ হলে, তার নিজের ও বাচ্চার কোনো ক্ষতি না হলে- সে চাইলে রোজা রাখতে পারবে। আর যদি কারও ৪০ দিনের ওপর চলে যায়, এর মাঝে রমজানও আসে, তবে এটুকু জানতে হবে যে, ৪০ দিনের ওপর যে রক্তটুকু যাবে তা নেফাস নয় বরং তা ইস্তিহাজা অর্থাৎ কোনো রোগজনিত রক্ত। মা চাইলে আর কোনো ক্ষতির আশংকা না হলে রোজা রাখতে পারবে।
মাসিক বন্ধ রেখে রোজা
এক ধরনের পিল পাওয়া যায় যা খেয়ে মাসিক কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা যায়। এই পিল খেয়ে হায়েজ বন্ধ রাখার জায়েজ ও নাজায়েজ উভয় হুকুমই হবে অবস্থা বুঝে।
পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ রাখার কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলো পূরণ হলে তখন জায়েজ হবে, অন্যথায় নয়। শর্তগুলো হলো-
১. বিবাহিত হলে স্বামীর অনুমতি লাগবে। কারণ পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ করার সঙ্গে পেটে বাচ্চা আসার সম্পর্ক রয়েছে। আর বাচ্চা পেটে আসার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক রয়েছে।
২. পিল খেলে শরীরের কোনো ক্ষতি হতে পারবে না। অনেকের মাসিকের নিয়মিত অভ্যাস অনিয়মিত হয়ে যায়, অনেকের হরমনজনিত সমস্যা দেখা দেয়, শরীর মোটা হয়ে যায়। অর্থাৎ কেউ কেউ অসুস্থ হন আবার কেউ কেউ হন না। যাদের পিল নিলে সমস্যা হয় তারা পিল নিয়ে মাসিক বন্ধ রাখতে পারবেন না। কিংবা যদি কাউকে ডাক্তার নিষেধ করেন পিল নিতে, তবে তার জন্যও জায়েজ হবে না।
৩. বিনা প্রয়োজনে পিল খাওয়া জায়েজ নেই। (অনেকে এমনিতেই মাসিক বন্ধ রাখতে পিল নেন)।
উল্লেখিত আলোচনায় উঠে আসা প্রয়োজনকে নিরঙ্কুশভাবে শতভাগ বৈধ বলা কঠিন। তবে উমরা ও হজপালনের সময় কিছুটা অবকাশ দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে অনেক ইসলামি স্কলার।
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, রমজান মাসে মাসিক বন্ধ রাখার খুব প্রয়োজন হয় না। কারণ রোজার কাজা আদায় করার অনেক সময় থাকে ও কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। তবে এটা দুঃখজনক যে, কদরের রাত আমরা বছরে একবারই পাই। আর এই সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায় মাসিকের কারণে। এক্ষেত্রে পরামর্শ হলো, কারো যদি রমজানের শুরুতে হায়েজ আসে তবে যেন সে পিল না খায়। আর যদি শেষ দশ দিনে আসে তবে শর্তগুলো মেনে পিল নিতে পারে।
হায়েজ মানব শরীরের একটি সাধারণ নিয়ম। এটা কোনো রোগ বা আল্লাহর তরফ থেকে আজাব নয়। বরং একটা রহমত। হায়েজের কারণে মেয়েরা মা হয়। এটা দুঃখজনক কিছুই না, বা ইবাদত থেকে আল্লাহ বঞ্চিত করছেন এমন কিছুও না। কেউ যদি পুরো রমাজানেই হায়েজ বন্ধ না রাখেন তবে তারও দুঃখের কিছু নেই। আপনি ওইটুকু নেকি হাসিল করতে পারবেন, যা আপনার তকদিরে লেখা আছে।
গর্ভাবস্থায় রোজা
গর্ভাবস্থাকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। শুরু থেকে ৩-৪ মাস। ৫ থেকে ৭ মাস ও তারপর থেকে একদম প্রসব পর্যন্ত।
ক. প্রথম অবস্থায় মায়েরা অনেক বেশি দূর্বল ও অসুস্থ থাকেন। বমি হয় প্রচুর এবং জ্ঞান হারান ঘন ঘন। এমন অবস্থায় অনেকে রোজা রাখতে পারেন, অনেকে পারেন না। যারা পারছেন না, বেশি দূর্বল হয়ে যাচ্ছেন; তারা পরবর্তীতে কাজা আদায় করবেন। আর যারা রাখছেন, আল্লাহ তাদের মাঝে বরকত দিন।
তবে মনে রাখবেন, অনিচ্ছাকৃত বমি হলে রোজা ভাঙে না। অনেকে রোজা রাখেন, কিন্তু বমি হওয়ার পর মনে করেন রোজা ভেঙে গেছে এবং খাওয়া-দাওয়া করে ফেলেন; এটা ভুল। তবে বমি মুখে আসার পর কেউ যদি তা ইচ্ছাকৃত গিলে ফেলে রোজা ভেঙে যাবে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাজা রোজা করতে হবে, কাফফারা ওয়াজিব নয়। কিন্তু অবস্থা যদি এমন হয়, অজান্তেই বমি এসে আবার ভেতরে চলে যায়, তবে রোজা ভাঙবে না।
দ্বিতীয় অবস্থায় মায়েরা মোটামুটি সুস্থ থাকেন। তারা একটু আরাম করে রোজাগুলো রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে পরিবারের বাকি সদস্যদের সাহায্য দরকার। গর্ভবতী মা যেন লম্বা সময় রান্না ঘরে কাজ না করেন, বা বাড়ির অন্য এমন কোনো কাজ না করেন যেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও খাবারের প্রয়োজন পরে।
সবাই মায়ের প্রতি যত্নশীল হলে ইনশাআল্লাহ রোজা রাখতে সমস্যা হবে না। তবে কেউ যদি এ সময়েও অসুস্থ থাকেন এবং কোনো রোজা রাখতে অপারগ হন, তবে পরে কাজা আদায় করবেন।
তৃতীয় অবস্থাও দ্বিতীয় অবস্থার মতোই। অনেকে এ সময়ে একদম সুস্থ-সবল থাকেন, অনেকে আবার খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি হাঁটাচলাও বন্ধ হয়ে যায়, হাত-পা ফুলে যায়। এমতাবস্থায় গর্ভবতী নারী যদি পারেন রোজা রাখতে তবে রাখবেন। আর যদি না পারেন, পরে কাজা করে নেবেন। তবে এ সময় অনেক বেশি করে ইবাদত-বন্দেগি করবেন। চেষ্টা করবেন সব নামাজ সুন্নতসহ আদায় করতে। তারাবি এবং তাহাজ্জুদ আদায় করতে। শুয়ে-বসে, সবসময় জিকির ও কোরআন তেলাওয়াত করতে। গর্ভের সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। চেষ্টা করবেন দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে। দাঁড়াতে না পারলে বসে আদায় করবেন। অনেকে তারাবি বা তাহাজ্জুদ বাদ দেন। এটা না করে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে বসে হলেও পুরো নামাজ আদায় করার চেষ্টা করা।
দুধ পান করানো অবস্থায় রোজা রাখা
কেউ যখন রমজানের আগে মা হন অর্থাৎ এমন সন্তানের জনক যে কিনা শুধুই মায়ের দুধ পান করে। তখন ওই মায়ের জন্য কষ্টকর হয় রোজা রাখা। কারণ বাচ্চা দুধ পান করলে মাকেও ঘনঘন খাবার খেতে হয়। আবার মা রোজা রাখলে বাচ্চা দুধ কম পায়। আবার অনেক মায়ের দু’জন দুধের শিশু থাকে। সে ক্ষেত্রে মা রোজা রাখলে মা ও শিশু উভয়েই দূর্বল হয়ে পরে। এমতাবস্থায় সেই মায়ের জন্য অনুমতি আছে রোজা না রাখার। এই অনাদায়ী রোজাগুলো পরবর্তী রমজান আসার আগেই কাজা আদায় করে ফেলবে।
তবে এমন যদি হয়, মা রোজা রাখলে দূর্বল হন না এবং বাচ্চা দুধ পায় পর্যাপ্ত, অথবা বাচ্চা দুধ ছাড়াও অন্য খাবার খায়- সে ক্ষেত্রে মা রোজা রাখবেন।
মাসিক ও প্রসব পরবর্তী স্রাব অবস্থায় ইবাদত
নারীরা রমজান মাসে মাসিক ও প্রসব পরবর্তী স্রাবের কারণে ৩ ধরনের ইবাদত থেকে বঞ্চিত হয়। সেগুলো হলো- নামাজ, রোজা এবং কোরআন তেলাওয়াত।
নামাজ তো আল্লাহতায়ালা মাফ করে দিয়েছেন। রোজা পরবর্তীতে কাজা আদায় করা যাবে। আর কোরআন তেলাওয়াত একটা উত্তম সুন্নত। অনেকেই মন খারাপ করেন ইবাদতগুলো করতে না পারার জন্য। তবে এমন আরও অনেক ইবাদত আছে যা এ সময় নারীরা পালন করতে পারেন।
সেহেরি ও ইফতার বানানোর দায়িত্ব নিয়ে রোজাদারকে ইবাদত করার সুযোগ করে দেওয়া। এই সুযোগ করে দেওয়ার ফলে ইবাদতকারীর নেকির অংশীদার তিনিও হবেন, কিন্তু তার সওয়াব একটুও কমবে না।
সারাক্ষণ ইস্তেগফার, তাহমিদ, তাহলিল, তাকবির ও নানান ফজিলতপূর্ণ জিকির করতে পারেন।
প্রতিবেশীসহ পথেঘাটের গরিব-মিসকিনদের মাঝে ইফতার বিতরণ করতে পারেন।
যারা রোজা অবস্থায় আছেন, তাদের অন্যান্য কাজগুলো করে দিতে পারেন। বেশি বেশি দান-সদকা করবেন।
কোরআনে কারিমের তাফসির পড়বেন, রাসূলের জীবনী পড়বেন, দ্বীনি কিতাব পরে ইলম অর্জন করবেন। তবে কোনো কিতাবে কোরআনের আয়াত থাকলে ওই জায়গাটা স্পর্শ করা যাবে না।
অনেকে নামাজের সময় বা তারাবি-তাহাজ্জুদের সময় ইবাদতের অভ্যাস চালু রাখতে অজু করে জায়নামাজে বসে জিকির করেন ও দোয়া করেন। এতে কোনো সমস্যা নেই, তা করতেই পারেন। তবে এতে অজু করা জরুরি নয়, যেহেতু হায়েজ অবস্থায় অজু হয় না। তাই অজু করা না করার মাঝে কোনো তফাৎ নেই। আর হায়েজ অবস্থায় যদি নাপাকি না লাগে তবে জায়নামাজেও বসতে কোনো সমস্যা নেই।
শেষ দশ দিনের বিজোড় রাত্রিগুলোয় বেশি বেশি দান-সদকার পাশাপাশি বেশি বেশি দোযা ও জিকির করা।