মক্কায় ব্যবসা করে সেলসম্যান থেকে সিআইপি
মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: সততা আর পরিশ্রমই তার মূলধন। ব্যবসা করতে গিয়ে ঘাটে-ঘাটে হয়েছেন প্রতারিত। তবুও আদর্শ থেকে এক চুল নড়েননি।
‘পবিত্র নগরী মক্কায় সততা আর সেবার মনোভাব নিয়ে ব্যবসা করলে বরকত আসবেই’- এমন বিশ্বাসকে ধারণ করে বিফল হননি। বরং যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে।
এক সময়ে ভাগ্য পরিবর্তনে সৌদি আরবে পাড়ি দেওয়া সেই তরুণ আজ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সিআইপি। তিনি খন্দকার এম এ হেলাল (৪১)। এখানকার ডায়মন্ড হোটেল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। এই গ্রুপের ১২টি হোটেল ছাড়াও ১০টি প্রতিষ্ঠান এখন কয়েক'শ বাংলাদেশির কর্মস্থলের ঠিকানা।
স্থানীয় নীতি অনুযায়ী এখানকার সব ব্যবসা-বাণিজ্য চলে সৌদি নাগরিকদের নামে। বাংলাদেশিরা উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা পরিচালনায় থাকলেও কাগজে-কলমে সবকিছুর মালিক সৌদি নাগরিক।
তবে লাভ-ক্ষতি যাই হোক না কেন, বছর শেষে সংশ্লিষ্ট সৌদি নাগরিকের হাতে শর্তানুযায়ী বিপুল অর্থ তুলে দিতে হয়। আর হিসেব শেষে সঞ্চিত লাভ বিনিয়োগ করে করেই খন্দকার এম এ হেলাল নিজেকে আজ পরিণত করেছেন সফল বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তা হিসেবে।
‘আমি এখানে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম সামান্য একজন সেলসম্যান হিসেবে। বেতন ছিলো মাত্র ৮শ’ রিয়াল। বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদানের জন্য অনাবাসী হিসেবে আমাকে একাধিকবার বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সিআইপি হিসেবে নিজের দেশের স্বীকৃতি- আলহামদুল্লিল্লাহ। এর চেয়ে অধিক পাবার আর কিই বা আছে?’
নিয়ম অনুযায়ী, সিআইপি মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের কার্ড ব্যবহার করে বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ-২ ব্যবহার করতে পারেন। সচিবালয়ে প্রবেশ থেকে ব্যবসা-সংক্রান্ত ভ্রমণে বিমান, সড়ক, রেল ও নৌপথে অগ্রাধিকারভিত্তিতে আসন সংরক্ষণের সুযোগ পান এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সমান সুযোগ পান।
পাশাপাশি দেশ-বিদেশে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈঠক করতে পারেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পান এবং স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও নিজের চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে কেবিন পাওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার পান তারা।
চন্দনাইশ থানার বৈলতলি গ্রামের সন্তান খন্দকার এম এ হেলাল। বাবা হাজী সামছুল ইসলাম। ৫ ভাই ৫ বোনের মধ্যে পঞ্চম। ১৯৯৪ সালে চট্রগ্রামের বরমা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী অবস্থায় পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবে। ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিলো কাপড়ের দোকানে। সামিয়া এলাকায় ৮০০ রিয়াল বেতনের সামান্য বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে বিনয়ী, নিবেদিত প্রাণ, সৎ আর পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে দোকান মালিকের সুনজরে চলে আসেন দ্রুত।
সততায় নিজেকে পরিণত করেন আরবদের বিশ্বাস আর আস্থাভাজন হিসেবে। তিন বছর পর নিজেই শুরু করলেন ব্যবসা। মরক্কো ও সিরিয়া থেকে কাপড় এনে বিক্রির ব্যবসাটা অল্প দিনের মধ্যেই হয়ে ওঠে জমজমাট।
তারপরের গল্পটা কেবলই এগিয়ে যাওয়ার। ২০০০ সালে ব্যবসায়িক অংশীদারদের নিয়ে ‘আল নওয়াব গার্মেন্টস’ নামের পোশাক কারখানা চালু করেন। এখানে বিনিয়োগ করে আর্থিক প্রতারণায় ধাক্বা খেলেও দমে যাননি।
২০০১ শেষের দিকে শুরু করেন হোটেল ব্যবসা। সাড়ে ৭ হাজার রিয়াল পূঁজিতে মাত্র সাতটি কক্ষ নিয়ে ব্যবসা শুরুর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি খন্দকার এম এ হেলালকে।
‘আমি চট্রগ্রামের সন্তান। রক্তে আমাদের ব্যবসা আর হৃদয়ে আদর্শ। প্রথমে চিন্তা করলাম হোটেল ব্যবসার মাধ্যমে মহান আল্লাহর মেহমানদের সেবা করবো। কর্মীদের সাফ বলে দিলাম, হাজীদের সেবা সবার ওপরে। তারপর কিছু অবশিষ্ট থাকলে সেটা আমার ব্যবসা। হাজীদের দোয়া আর সন্তুষ্টিতে খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে বরকত দিয়েছেন। বর্তমানে জেদ্দায় লোহিত সাগর পাড়ে একটিসহ মক্কায় ডায়মন্ড হোটেল গ্রুপের অধীনে ১২টি হোটেল ছাড়াও কার্গো, ট্রাভেল, ট্যুরিজম, ক্যাটারিং ও ট্রান্সপোর্টসহ ১০টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে বেশ ভালো আছি। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া।’
খন্দকার এম এ হেলাল জানান, পবিত্র এ নগরীতে সৎভাবে ব্যবসা করলে আল্লাহ কাউকে ফেরান না। তবে ব্যবসাটা করতে হবে মানুষের কল্যাণে। যারা কোনো না কোনোভাবে অসততা আর অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন তারা শেষ পর্যন্ত এই নগরীতে টিকে থাকতে পারেননি।
দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্যে সরকার দু’বার আমাকে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াতে বাংলাদেশি হিসেবে আমি গর্বিত।
আল্লাহর মেহমানদের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখার মধ্যে পার্থিব আনন্দ খুঁজে পাই। আমৃত্যু মানুষের কল্যাণে নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিতে চাই- যোগ করেন খন্দকার এম এ হেলাল।