সম্পর্ক স্থাপনে ভাষা প্রয়োগ ও ব্যবহারে ইসলামের নির্দেশনা
পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুন্দর, শ্রদ্ধাপূর্ণ, আন্তরিক ভাব ও ভাষা প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটা ইসলামের শিক্ষাও বটে। মানুষ যদি এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবে তার যথাযথ প্রয়োগ করেন, তাহলে সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের অবস্থা অন্যরকম উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন পর্বে শব্দ প্রয়োগে সতর্ক হওয়া চাই।
কেবল শব্দ নয়, কথা বলার ভঙ্গিও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুন্দর ভাষাভঙ্গি এবং সহৃদয় কথাবার্তা যার সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয় তাকে প্রশান্ত, নির্ভরযোগ্য এবং আশ্বস্ত করে। এই অনুভূতি একজন শ্রোতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয়।
পবিত্র কোরআন শব্দ, বাক্য ইত্যাদিকে পবিত্র এবং অপবিত্র- দুই ভাগে ভাগ করেছে। পবিত্র তথা সদালাপকে তুলনা করা হয়েছে এমন একটি গাছের সঙ্গে, যে গাছের শেকড় বেশ গভীরে প্রোথিত এবং ওই গাছের শাখা-প্রশাখা ব্যাপক বিস্তৃত। যে গাছের ফল থেকে সবাই উপকৃত হয়। আর অপবিত্র কথাকে বলা হয়েছে এমন এক বৃক্ষের সঙ্গে, যে বৃক্ষ মাটি থেকে মূলোৎপাটিত হয়ে গেছে এবং যে বৃক্ষের কোনো ফল নেই। তা থেকে মানুষ কোনোভাবেই উপকৃত হয় না। এ উদাহরণ পবিত্র কোরআনে দেওয়া হয়েছে।
বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নোংরা শব্দ কিংবা বাক্যের ব্যবহার বক্তার রুচিহীন ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। পক্ষান্তরে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগ বক্তার সুরুচিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। এরকম সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তি সহজেই সমাজে তার মর্যাদা ও উচ্চ অবস্থান নিশ্চিত করে। শব্দ ব্যবহার এবং ভাষাভঙ্গির সৌন্দর্যহীনতা বক্তাকে সাময়িকভাবে পরিচিত করে তুললেও তার সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা স্থায়ী হয় না। অল্পসময়ের মধ্যে তার প্রতি শ্রোতারা অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এ ধরণের বক্তা সমাজে বিচ্ছিন্ন ও নি:সঙ্গ হয়ে পড়ে।
পবিত্র কোরআনের সূরা ত্বহার ৪৪ নম্বর আয়াতে সুন্দর ও নম্র ভাষায় কথা বলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সহৃদয় ভাষা ও বাচনভঙ্গির সাহায্যে যে কথা বলা হয়; তার প্রভাব অনেকটা হৃদয় নিংড়ানো সঙ্গীতের মতো। এ কারণে হজরত মূসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহতায়ালা যখন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে অহংকারী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ শাসক ফেরাউনকে তওহিদের দাওয়াত দেওয়ার আদেশ দিলেন, তখন মূসাকে বলেছিলেন যেন ভদ্র, নম্র ও মিষ্টি মধুর ভাষা ব্যবহার করে ফেরাউনের সঙ্গে আলাপকালে। কোনোভাবেই যেন কড়া ভাষা ও শব্দ ব্যবহার না করে। বলা হয়েছে, ‘তার সঙ্গে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশগ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে।’
হজরত মূসা (আ.) আল্লাহতায়ালার নির্দেশনা পেয়ে বিনয়ী কণ্ঠে সুন্দর ভাষাভঙ্গি ও শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ায় ফেরাউন উগ্র আচরণ না করে বরং যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
কোরআনে কারিমের দৃষ্টিতে যথাযথ ও সুস্থ সম্পর্ক হলো সেটাই- যা পারস্পরিক সম্মান, মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। মূলতঃ সম্পর্কটা খুবই স্পর্শকাতর একটা বিষয়। একটি অশোভন বাক্য এমন একটি অপরিহার্য সঙ্কট তৈরি করে ফেলতে পারে, যে ক্ষতি আর কিছুতেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে উঠে না। সম্পর্কে একবার ফাটল সৃষ্টি হলে তা দ্বিতীয়বার জোড়া লাগানো অনেক সময় অসম্ভব হয়ে উঠে।
এদিক থেকে কোরআনে কারিম মানুষের কাছে প্রত্যাশা করে সুদূরপ্রসারী চিন্তা এবং সঠিক ভাষাভঙ্গি ও আচরণের মাধ্যমে সবচেয়ে সুন্দর কথা যেন সে উপস্থাপন করে।
সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- যার সঙ্গে সম্পর্ক গড়বেন, তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া; তার প্রতি শিষ্টাচারপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করা। অসম্মানজনক কোনো আচরণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। পবিত্র কোরআনে মুমিনদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘তারা যেন অশোভন কথাবার্তা কিংবা অসুন্দর শব্দ ব্যবহার করা থেকে সবসময় বিরত থাকে।’
জ্ঞানীরা বলেছেন, সুন্দর কথা বলা এবং আস্তে আস্তে কথা বলা সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি ও রীতি। এই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বৈশিষ্ট্যটি যেন মুসলমানরা অর্জন করে এবং চর্চা করে সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআন তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেইসঙ্গে যেসব লোক চীৎকার-চেঁচামেচি করে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলে তাদেরকে গাধার আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে।