ফুটবল আমাদের, ক্রিকেটও আমাদেরই-দুটোই বাংলাদেশের

বিবিধ, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পোর্টস এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-23 18:12:48

১১ ঘন্টার বাংলাদেশ সফরে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো অনেক কথাই বললেন। আশার কথা শোনালেন। স্বপ্ন দেখালেন। তবে প্রসঙ্গক্রমে উঠা এক প্রশ্নে ক্রিকেট নিয়ে যা বললেন সেটাই যে এখন ‘হলুদ কার্ড’ পাওয়ার মতোই ‘ফাউল’!

আগে শুনি প্রশ্নটা কি ছিল?

এক সাংবাদিকের প্রশ্নঃ-‘ফুটবল একসময় বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় ছিল। এখন সেই স্থান নিয়েছে ক্রিকেট। ফুটবলের পুরনো সেই জনপ্রিয়তায় ফিরে যাওয়ার জন্য বাফুফেকে আপনার পরামর্শ কি?’

উত্তরটা দেওয়ার জন্য ইনফান্তিনো একটু সময় নিলেন। তার ডানদিকে বসা বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাম মুর্শেদি, বামদিকে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। দুজনেই ইনফান্তিনোকে কী যেন পরামর্শ দিলেন। এদেরই একজন তাকে বলেও দিলেন কী বলতে হবে। এই প্রতিবেদকের কাছে থাকা অডিও রেকর্ডে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে পাশের কেউ একজন ইংরেজিতে উত্তরটা কী হবে সেটা ইনফান্তিনোকে বলে দিচ্ছেন।

সেটা শোনার পর ফিফা সভাপতি হুবহু তাই বললেন- ‘প্রথমত ক্রিকেট এদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটা আমি বিশ্বাস করি না। এই রুমের মধ্যে ক্রিকেট বুঝে তেমন মাত্র একজনকে আমি দেখতে পাচ্ছি (বিসিবির পরিচালক কাজী এনাম আহমেদকে দেখিয়ে)। বোঝার জন্য, খেলার জন্য ফুটবল অনেক সহজ। বল নিয়ে আপনি দৌড়াচ্ছেন। গোল করছেন। ম্যাচ জিতছেন। ফুটবল হলো গতির খেলা। হৃদয়ের খেলা। উত্তেজনার তুঙ্গে সবাইকে পৌঁছে দেওয়ার খেলা। পুরো বিশ্বজুড়ে ফুটবল খেলা হয়। আর দেখুন, বিশ্বের কয়টি দেশ ক্রিকেট খেলে? সম্ভবত ১০ বা ১১টি দেশ। মাত্র কয়েকটি দেশ খেললে তো আপনি দ্রুত সময়ের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছাবেনই! কিন্তু ফুটবল এক্ষেত্রে অনেক কঠিন। এখানে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। ফুটবলে লড়াই করা, দৃঢ়তা-দক্ষতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমরা যারা ফুটবল খেলি, তারা সেই লড়াকু প্রতিযোগী। বিশ্বের ২১১টি দেশ ফুটবল খেলে আর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় মাত্র একটি দেশ; এবার যেমন ফ্রান্স। চ্যাম্পিয়ন হয় মাত্র একটা দেশ, কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে বাকি ২১০টি দেশ বাজে ফুটবল খেলে! ব্যাপারটাকে এভাবে দেখি আমি, ২১১টি দেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় মাত্র একটি দেশ।’

সেই একই প্রশ্নের ব্যাখ্যায় আরো অনেক কিছু যোগ করেন ফিফা সভাপতি। আর শেষটা করেন এভাবে- ‘ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে বাংলাদেশের পারফরমেন্স এবং সেই ম্যাচ এদেশের মানুষকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। আন্তর্জাতিক ফুটবলের স্বর্ণালী সাফল্যে ফেরার দিনটা বাংলাদেশের চলে এলো বলে! আর হ্যাঁ, যেখানে ক্রিকেটের কোনো সুযোগই নেই!’

ফিফা সভাপতির এই উত্তরের শুরু এবং শেষটা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। আসলে হওয়ারই কথা। আরেকবার তার বলার সেই উত্তরের শুরু এবং শেষটা মনে করিয়ে দেই।
 
শুরুতে তিনি বলেছেন-‘প্রথমত ক্রিকেট এদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটা আমি বিশ্বাস করি না।’ আর শেষ করেছেন এভাবে-‘ ক্রিকেটের কোনো সুযোগ নেই এখানে।’

ঠিক কোন পরিসংখ্যান বা তথ্য ঘেঁটে ফিফা বস একথা বলেছেন তা জানা যায়নি। নাকি কথার ছলেই ঠাট্টার ভঙ্গিতে এটা বলেছেন সেটাও ঠিক পরিষ্কার নয়। তবে ফিফা সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসা কেউ বিশ্বের অন্য আরেকটি জনপ্রিয় খেলাকে নিয়ে ঠাট্টার মেজাজে কিছু বলবেন- সেটা মানার তেমন উপায় নেই।



সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো ক্রিকেট নিয়ে ফিফা সভাপতি যখন এই মন্তব্য করেন তখন হলে উপস্থিত বাফুফে কর্মকর্তাদের মুখে হাসি ধরে না। উচ্চস্বরে হাসির সঙ্গে হাততালির শব্দও শোনা গেল প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ের দোতলার পদ্মা হলে। অর্থাৎ ফিফা সভাপতি যা বলেছেন সেটা এক অর্থে অনুমোদন করলেন আয়োজকরা।
 
ব্যাপারটা যেন এমন-হাঁ বলে সম্মত হলো! হাঁ বলে সম্মত হলো!! হাঁ বলে সম্মত হলো!!!

ফুটবলকে তুলতে গিয়ে ক্রিকেটকে নিচু করে দেখানোর এই মানসিকতাই জানাচ্ছে আমরা এখনো জাতীয়তাবোধকে সম্মান জানাতে না শেখা জাতি হয়েই আছি!

নিজ দেশের একটি খেলাকে বড় করে দেখাতে গিয়ে নিজেরই আরেকটি খেলাকে ছোট করার এমন কুপমুন্ডকতা দুনিয়ার আর কোথাও আছে কিনা, জোর সন্দেহ!

এই প্রসঙ্গে দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে জীবন পার করা ক্রিকেট সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি দুঃখ করে বার্তাটোয়েন্টিফোরকে বলছিলেন-‘বাংলাদেশে ক্রিকেট আজ এই যে উচ্চ আসনে, সাফল্য ও জনপ্রিয়তায় পৌঁছেছে তার পেছনে খেলাটার নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। কর্মকর্তাদের দুরদর্শী পরিকল্পনা আছে। আছে খেলোয়াড়দের ত্যাগ-তিতিক্ষা। সঙ্গে আছে মানুষের ভালোবাসা। ক্লাবগুলোর অবদানও কম নয়। অন্য কোনো খেলা যেমন ফুটবলকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে ক্রিকেট এই উচ্চাসনে পৌঁছায়নি। নিজ শক্তি এবং স্বকীয়তায় ক্রিকেট আজ উঁচুতে। আর কে না জানে ক্রিকেটের স্পিরিটই হলো অন্যকে ছোট বা হেয় না করা। আমাদের ক্রিকেটাররাও দেশের ফুটবলকে ভালবাসে প্রাণ দিয়ে। আর তাই ফুটবলের সাফল্যে মাশরাফি বা মুশফিকরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সেই আনন্দের সঙ্গী হন। কিন্তু ক্রিকেট এবং ফুটবলকে এই ভাগাভাগি করার যে বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে সেটা খুবই হীনমন্যতার প্রকাশ। বলার অপেক্ষা রাখে না ক্রিকেট এখন যে কোনো বিচারে বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান খেলা।’

ফিফা সভাপতি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের সংখ্যা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটাও ঠিক সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। টেস্ট ক্রিকেট খেলে ১২টি দেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে খেলা দেশের সংখ্যা এখন ১০৪টি। যে ১২টি দেশ টেস্ট খেলে তারা ভাল খেলেই বলে টেস্ট ক্রিকেটে সুযোগ পায়। ফুটবলেও তেমনটাই। বিশ্বকাপে খেলে ৩২টি দেশ। কিন্তু সবাই কি ভালোর মানে উত্তীর্ণ?

এই যেমন সামনের বিশ্বকাপে খেলবে কাতার। আপনি এখনই বাজি লাগিয়ে ফেলতে পারেন- কাতার সেই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবে না!

কোনো সন্দেহ নেই ফুটবল বিশ্বের নাম্বার ওয়ান খেলা। অর্থকড়ি, সম্প্রচার, জনপ্রিয়তা, গতিময়তা-সবকিছুতেই ফুটবল শীর্ষস্থানে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন ফুটবলের অবস্থান কোন পর্যায়ে? একবারও বাস্তবতায় ফিরতে পারছেন ফুটবল কর্তারা?

আশির দশকের বাংলাদেশের প্রাণোচ্ছ্বল এবং স্বর্ণালী সময়ের ফুটবল আজ কেন মরচে ধরা? আজ কেন দর্শকশূন্য গ্যালারিতে ফুটবল হচ্ছে? কেন ফুটবল র‌্যাঙ্কিং ২১১ এর মধ্যে ১৮৭ তে? কখনো কি কারণ খুঁজেছেন ফুটবল পরিচালনায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসা কর্তারা?

খুঁজবেন না।

ঐতিহ্য হারানোর কারণ খুঁজতে বসলেই তারা সবাই দশে শূন্য পাওয়া ফেল্টুস ছাত্র হয়ে যাবেন যে!

আমাদের ফুটবল-ক্রিকেটের জার্সির রং কিন্তু একই। জার্সির বুকে গর্বের লাল-সবুজের একই পতাকা নিয়ে মাঠে নামেন ফুটবলার এবং ক্রিকেটাররা।
 
দেশটা যেমন আমাদের। ঠিক তেমনই ফুটবল-ক্রিকেট দুটোই আমার, আপনার, আমাদের এই দেশেরই!

এ সম্পর্কিত আরও খবর