যশোর-৩ (সদর) : নাবিল নিশ্চিত, অমিতের অন্তহীন অভিযোগ!

বিবিধ, রাজনীতি

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম, যশোর থেকে | 2023-08-29 01:04:01

পাশাপাশি দুটো ব্যাটারিচালিত ট্যাক্সি ছুটছে। একটির চারধারে নৌকার পোস্টার সাঁটা। পাশেরটি ধানের শীষের পোস্টারে ঢাকা। ট্যাক্সিতে চালক ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু মাইকের প্রচন্ড শব্দে কান ঝালাপালা! ট্রানজিস্টারে রেকর্ড করে রাখা ডায়লগে উচ্চস্বরে ভোট প্রার্থনা চলছে। যশোর সদরের এম. এম. রোড, দয়াটানা মোড়, মনিহার বাস স্ট্যান্ড, চিত্রার মোড়, আর এন রোডের যেদিকেই চোখ যাচ্ছে ব্যাটারিচালিত ট্যাক্সিতে স্বয়ংক্রিয় ভঙ্গিতে নৌকা ও ধানের শীষের নির্বাচনী প্রচারণার এমন সহ-অবস্থান দেখলে নির্বাচন কমিশনের হাততালি দেয়ার কথা!

সত্যিকার অর্থে যশোর-৩ নির্বাচনী আসনে প্রার্থীদের সহ-অবস্থান বলতে শুধু এই ব্যাটারিচালিত যান্ত্রিক যানেই সীমাবদ্ধ। বাকি সবকিছুই যে উভয়পক্ষের হিংসা-জেদের আগুনে পুড়ে ছারখার সম্প্রীতি! প্রতিদিনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণা, পোষ্টার সাঁটানো, স্থানে স্থানে জনসভা, জনসংযোগ-এমনসব নির্বাচনী অভ্যাসে মারামারি, বোমাবাজি, হোন্ডাগুন্ডা ও হেলমেট বাহিনীর মাস্তানিতে শান্তি ভিন্ন রাস্তা খুঁজছে; পালিয়ে যাওয়ার!

প্রায় প্রতিদিনই অনাচার, অত্যাচারের এন্তার অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং রিটার্নি কর্মকতার কাছে ধরনা দিচ্ছেন ধানের শীষের প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। বিএনপির সাবেক তথ্যমন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত এবারের নির্বাচনে যশোর-৩ আসন থেকে ধানের শীষের প্রার্থী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার কাছে জানতে চাওয়া হলো-কেমন চলছে প্রচারণা? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই অমিত এন্তার অভিযোগের ঝাঁপি খুললেন-‘ এই যে আপনি ফোন করলেন তার মিনিট বিশেষ আগের ঘটনা। আমাদের এখানে সিটি প্লাজা বলে একটা বড় মার্কেট আছে। সেখানে আমি নেতাকর্মীদের নিয়ে কিছুক্ষণ প্রচারণার কাজ করলাম। পুলিশের লোকজনও সেখানে ছিলো। আমরা আমাদের কাজ শেষ করে খানিকটা সামনে বাড়তেই হঠাৎ দুটো বোমা ফুটলো, একটি গুলির আওয়াজও শুনলাম। মুহূর্তেই আতঙ্ক চারধারে। দৌড়াদৌড়ি শুরু। পুলিশের উপস্থিতিতেই এমন মাস্তানি চলছে।’

_কে করছে এটা, কারা এবং কেন?

প্রশ্নের উত্তরে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের ব্যাখাটা এমন-‘আমার কাছে মনে হয়েছে, গত দশ বছর ধরে যে অনাচার চলেছে, তাতে প্রশাসনের পেশাদারিত্বও নষ্ট হয়ে গেছে। আমি প্রায় প্রতিদিনই এসব হামলা এবং হুমকির বিষয়ে রিটার্নি কর্মকর্তাকে জানিয়েছি, তাকে আমার বেশ আন্তরিকই মনে হয়েছে। কিন্তু তার নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে যে বাস্তবায়নই হচ্ছে না। আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও এসব নিত্যদিনের ঘটনার কখনো লিখিত অভিযোগ করছি, কখনো মৌখিকভাবে জানাচ্ছি। কিন্তু কোন প্রতিকারই যে পাচ্ছি না। আসলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যখন এমন ঘটনাগুলো ঘটে, তখন সেটার প্রতিকার করা মনে হয় একটু কঠিনই হয়। আমি যে এসবসব কাণ্ডে খুব অবাক হয়েছি, তাও কিন্তু নয়। এটা কোন বিছিন্ন ঘটনা নয়। সারা দেশেই তো আমাদের নির্বাচন কর্মীরা এমনসব হামলা-অত্যাচারের শিকার হচ্ছে।’

ব্যাটারিচালিত ট্যাক্সি বাদে শহরের প্রধান প্রধান সড়কের কোথায়ও অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের ধানের শীষের কোন পোস্টার চোখে পড়লো না। অথচ পুরো শহরময় হাসিমুখে ঝুলছে নৌকার প্রার্থী কাজী নাবিলের পোস্টার। নৌকার পোস্টারে শীতের আগমনী বৃষ্টিও তেমন সমস্যা তৈরি করতে পারেনি। নাবিলের পোস্টার প্লাস্টিকে লেমিনেটেড! বৃষ্টিতে ভিজে সেই প্লাস্টিকে মোড়া পোস্টার বরং রাতের নিয়নসাইনের রঙিন আলোয় আরো ঝলমলো দেখাচ্ছিলো!

-তাহলে কি পোস্টার না লাগিয়ে কৃচ্ছতা সাধন করছেন ধানের শীষের প্রার্থী অমিত? জবাবে কষ্টের হাসি হেসে অমিতের আরেকদফা অভিযোগ-‘পোস্টার আমরা লাগাচ্ছি। কিন্তু সেই পোস্টার বুটপরা, হেলমেটপরা মানুষের উপস্থিতিতে মই বেয়ে উঠে কিছু লোকজন ছিঁড়ে ফেলছে। তাতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি শুধু বলার জন্যই এই অভিযোগ করছি, তা নয়। আমাদের কাছে এমনসব ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজও আছে। আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি ভোট চাইতে। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষরা অতটুকুনও সহনশীল নয়। আমাদের এখন ভোট চাইতে দিতেই দেয়া হচ্ছে না। আর ভোটারদেরকে ভোটের দিন ভোট দিতে দেবেন-এটা ভাবা তো খুব কঠিন!’

অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের এমনসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এই প্রতিবেদককে বলেন-‘যেহেতু এখন ওদের আর কেউ ভোট দেবে না, তাই তারা শুধু অভিযোগ-অনুযোগের মধ্যেই আছে। পুরো দেশের মতো যশোরেও এখন উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশ বিরাজ করছে। তারা প্রতিদিন অভিযোগ করে যাচ্ছে কিন্তু তারা তো ঠিকই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে নির্বাচনের পরিবেশ কত ভাল ও সুষ্ঠ।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার যশোরের ছয়টি আসনের আওয়ামী লীগের নির্বাচন কার্যাবলী পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। তিনি তার বিশ্লেষণে জানান-‘ছোটখাটো কোন ঘটনা ঘটে থাকলে সেটা যে তারা (বিএনপি) নিজেরাই ঘটাচ্ছে, এটাও আমরা জানি। আর হামলা-হুমকি বিষয়ে তারা যা বলছে তার পুরোটাই বানোয়াট। আমরা তো উপজেলা-শহরে, সদরে রোজই ঘুরছি, কোথাও তো কোন সমস্যা দেখিনি। শুধু লোকসমাজ পত্রিকাটা খুললেই হামলা-টামলার ছবি ও নিউজ দেখি, ওগুলো সব পাতানো!’

উল্লেখ্য লোকসমাজ যশোরের পুরানো পত্রিকা। এই পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত!

শাহীন চাকলাদার দাবি করেন বর্তমান নির্বাচনী দৌড়ে তাদের প্রার্থী কাজী নাবিলের অবস্থান বেশ সুসংহত। জয় তার নিশ্চিত। শুধু এই আসনেই নয়, যশোরের ছয় আসনের সবকটিতেই আওয়ামী লীগ জিতবে বলে তিনি আশা করেন।

যশোর সদরের ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-৩ আসন গঠিত। এই আসনে ’৯০ পরবর্তী ৬টি সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দু’বার এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৪ বার নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে এই আসনে মুল লড়াইটা হবে নৌকার কাজী নাবিল এবং ধানের শীষের অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের মধ্যেই। জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, জাকের পার্টির মনিরুজ্জামান মনির এবং জেএসডির সৈয়দ বিপ্লব আজাদও আছেন নির্বাচনের দৌড়ে, তবে অনেক পিছিয়ে থেকে দৌড়াচ্ছেন তারা! এই আসনে ভোটার ৫ লাখ ২৩ হাজার ৭২৪ জন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর