সমুদ্র মোহনার দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচর পানির তলায়  

, জাতীয়

রফিকুল ইসলাম মন্টু, স্পেশালিস্ট রাইটার বার্তা২৪.কম ঢাকা | 2023-08-22 22:27:03

১৯৭০ সালের প্রলয়ের স্মৃতি উসকে দিয়ে সমুদ্র মোহনার দ্বীপ ঢালচরকে আছড়ে চলেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। দিবসের প্রথম জোয়ারে দ্বীপটি পানির তলায় ডুবেছিল। সে পানি না সরতেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় জোয়ার। সেখানে অবস্থানরত পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ চরম আতংকের মধ্যে রয়েছেন। ছোট আকারের তিনটি পাকা দালান সেখানে থাকলেও তাতে হাজারখানেক লোকের বেশি আশ্রয় নেওয়া সম্ভব হবে না। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আগেরদিন বেশকিছু লোক সরিয়ে আনা হলেও অবস্থানকারীরা বিপদে রয়েছেন।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার এই দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচর সমুদ্র মোহনায় অবস্থিত। এর তিন দিকে মেঘনা নদী এবং দক্ষিণে সমুদ্র। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল দ্বীপটি। ভাঙনের মুখে থাকা এই দ্বীপের চারিদিকে নেই কোন বেড়িবাঁধ নেই। ফলে স্বাভাবিক জোয়ারেও ঝুঁকির মুখে থাকে দ্বীপটি।   

ঢালচরের বাসিন্দা এম আবদুর রহমান বিশ্বাস জানান, আম্পানের প্রভাবে ঢালচরের নদীতে পানি বেড়েছে। প্রবল বাতাস বইছে। দিনের প্রথম জোয়ারে দ্বীপের প্রাণকেন্দ্র হাওলাদার বাজার পানিতে ডুবে যায়। এখানকার সকল দোকানপাট পানিতে ডুবে যায়। মালামাল রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক রাস্তাঘাট পানির নিচে চলে যায়। উঁচু এলাকার মাত্র কয়েকটি বাড়িতে পানি প্রবেশ করতে পারেনি। সেখানকার মানুষেরা এখন চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে জোয়ারের পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে।

পানি ঢুকেছে ঘরবাড়িতে

ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বর্তমানে ঢালচরে অবস্থান করছেন। সাধারণ মানুষকে নিরাপদে থাকতে আহবান জানিয়েছেন তিনি। আলাপ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান আবদুল সালাম হাওলাদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচর। এখানকার মানুষদের মূল ভূখণ্ডে সরিয়ে নিতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। অনেক মানুষকে স্থানান্তর করা হয়েছে; কিন্তু পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ এখনও রয়ে গেছে দ্বীপে। এখানে যারা রয়েছে; তাদের ভরসা আল্লাহ। এই রকম বিপদে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আম্পানকে কেন্দ্র করে আমরা খুবই ঝুঁকিতে আছি।

সূত্র বলছে, গত কয়েক বছর ধরে দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচর ক্রমাগত ভাঙনের মুখে রয়েছে। প্রায় সারা বছরই ভেঙে চলেছে। বহু মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায়ও এ দ্বীপে বসবাসের অবস্থা নেই। ঘূর্ণিঝড় থেকে দ্বীপবাসীকে বাঁচাতে এখানে নির্মিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র। কিন্তু একে একে একে সবগুলো আশ্রয়কেন্দ্র নদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে। এছাড়া আশ্রয় নেওয়ার মত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ও ইউনিয়ন পরিষদের পাকা ভবনও নদীতে হারিয়ে গেছে। এখন আশ্রয় নেওয়ার মত পাকা দালান আছে মাত্র তিনটি- পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ভবন, বন বিভাগের ভবন এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের একটি ভবন। এতে হাজার খানেক লোকও আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। 

বাজারের সড়ক পানির নিচে

ঢালচরের বাসিন্দা নুরুদ্দিন মাঝি আমাকে ফোনে জানালেন, পরিবারসহ তারা সেখানেই অবস্থান করছেন। কিন্তু কেন মূল ভূখণ্ডের আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে আমার বাড়ি। এভানে আমার ট্রলার। এগুলো রক্ষা করতেই আমাকে এখানে থাকতে হয়েছে। নুরুদ্দিন মাঝির কথার সঙ্গে সুর মেলালেন আরও অনেকে। নিজেদের সম্পদ রক্ষার জন্যে এরা দ্বীপ ছেড়ে যায়নি। কেননা এই সম্পদ দিয়েই তারা বেঁচে আছেন।   

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে পড়ে ঢালচরে ভেসে উঠছে ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি। সে বার ভেসে গিয়েছিল এ দ্বীপ। ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ন দ্বীপটিতে তখন কেবল জনবসতি শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন সেখানে ঘর বাঁধতে শুরু করে। অনেকে গরু মহিষ চড়াতে ওই চরে মৌসুমভিত্তিক অবস্থান করতেন। প্রলয়ংকরী ঝড়ের তোড়ে পানি বাড়তে থাকে। মানুষগুলো তখন অসহায় হয়ে পড়েন। একটিমাত্র দোতলা ভবনে আশ্রয় নেন কিছু মানুষ। বনজঙ্গলের কারণে দূরের মানুষেরা আশ্রয়ে আসতে না পেরে ভেসে যায় সকলেই। 

পানিতে ডুবে আছে ঢালচর

ঢালচরের একমাত্র পাকা ভবনে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যাওয়া বাসিন্দা ইউসুফ আলী পাটোয়ারীর বয়স এখন ৬৬ বছর। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে ছিলেন কিশোর। সেদিনের ভয়াল চিত্র তুলে ধরে তিনি জানালেন, সে প্রলয়ের কথা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কীভাবে যে বেঁচে আছি আল্লাহই জানেন। ঘূর্ণিঝড়ের দু বছর আগে বড় ভাইয়ের সঙ্গে এই চরে আসি। ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিন দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবল বেগে বাতাস আসে, পানি বাড়তে থাকে। কিছু মানুষ পাকা ভবনে আশ্রয় নিতে পারলেও অনেকেই সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। পাকা ভবনের বাইরে থাকা মানুষদের সকলেই ভেসে গেছে। শুধু মানুষ নয়, শত শত মহিষ, গরু পানির প্রবল তোড়ে ভেসে যায়। ঢালচরের বাসিন্দা ৯৫ বছর বয়সী আমিন উদ্দিন বলছিলেন, আমাদের তো আল্লায় বাঁচাই রাখছে।

চরফ্যাশনের কুলসুমবাগ গ্রামে ৭২ বছর বয়সী হাসান আহাম্মদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে আসে ঢালচরের ভয়াল চিত্র। চরফ্যাশনে বাড়ি থাকলেও গবাদিপশু ও জমি দেখাশুনা করতে ঢালচরে থাকতেন হাচান আহাম্মদের বাবা মৌলভী মন্তাজ উদ্দিন, বড় ভাই হোচেন আহাম্মদ ও ছোটভাই নূর মোহাম্মদ। প্রবল ঝড়ের তোড়ে মহিষ-গরু, অন্যান্য সম্পদসহ তারা সকলেই ভেসে যায়। এদিকে হাসান আহাম্মেদ নিজেও পড়েছিলেন প্রবল ঝড়ে। পাঁচদিন পরে বাবা ভাইদের খোঁজে ঢালচরে যান হাসান। কাউকেই আর খুঁজে পাননি। ওখানে গিয়ে জানতে পারেন, অধিকাংশ মানুষ, গবাদিপশুসহ সবকিছু ভেসে গেছে।

এদিকে বাবা-ভাইদের হারিয়ে বিপাকে পড়েন হাসান আহম্মেদ। বড় ভাইয়ের স্ত্রী সুফিয়া বেগমের কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছিল। স্বামী হারিয়ে তিনিও পাগলপ্রায়। বাবা এবং বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে বয়সে পরিপক্ব না হলেও সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় হাসানকেই। কিন্তু বড় ভাইয়ের স্ত্রী সুফিয়া বেগম কোথায় যাবেন! দুই পরিবারের সম্মতিতে তাকে বিয়ে করেন হাসান। এভাবেই নতুন করে শুরু হয় জীবন। হাসান-সুফিয়ার সংসার বয়ে চলে। শূন্য থেকে শুরু হওয়া জীবনে এসেছে সমৃদ্ধি। তবে সেই ভয়াল রাতের কথা এখনও ভুলতে পারেন না তারা।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান ঢালচরবাসীকে সেই স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। একই সঙ্গে ঢালচরের মানুষদের এ ধরণের বিপদ থেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর