রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা পরিচয়ে জাল পাসপোর্ট নেওয়া ভারতীয় নাগরিক হাফিজ আহমেদ-এর প্রকৃত পরিচয় উদঘাটনে এখন হন্যে হয়ে ঘুরছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ‘হাফিজ আহমেদ’ নামে রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস থেকে পাসপোর্ট করে বাংলাদেশি সেজে দুই বছর আগে সৌদি পাড়ি দেন তিনি।
ভারতের বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত একাধিক চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি তিনি। তবে তার আসল নাম কী বা ভারতে ঠিক কী ধরনের মামলার আসামি ছিলেন তা প্রকাশ করছে না বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে গোয়েন্দা সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের একটি সংস্থা হাফিজকে দুর্ধর্ষ আসামি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ভারতীয় সংস্থা পরিষ্কার করে না জানালেও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেটুকু তথ্য পেয়েছে, তাতে হাফিজ নামধারী ব্যক্তি জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাকে শীর্ষ মাদক কারবারি হিসেবেও কাজ করার কিছু ক্লু পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দুদকের কর্মকর্তারা সবকিছুর আগে দুটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইছেন। প্রথমত হাফিজ আহমেদ নামে জাল পাসপোর্ট করা ওই ব্যক্তির আসল নাম ও পরিচয়। দ্বিতীয়ত- রাজশাহীতে অবস্থানকালে এবং ঢাকায় গিয়ে সৌদি পাড়ি দেওয়ার আগ পর্যন্ত কাদের সহযোগিতা নিয়েছেন তিনি। সেই তথ্যের সন্ধানে ঢাকা-রাজশাহীর কর্মকর্তারা এখন তৎপর।
জানা গেছে, জাল পাসপোর্ট বানাতে সহায়তাকারীদের নামে এরইমধ্যে মামলা দায়ের করেছে দুদক। পাসপোর্টটি রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস থেকে সম্পন্ন এবং রিলিজ হওয়ায় মামলাটি দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দায়ের করা হয়। তবে তা তদন্ত করছেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘হাফিজ আহমেদ পরিচয়ধারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভারতে দুই থেকে তিনটি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো নাশকতা ঘটানোর চেষ্টা অর্থাৎ জঙ্গি কার্যক্রম কিংবা মাদকসংশ্লিষ্ট। দুটি বিষয়েই ওই ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন। সেটা এখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটি উদঘাটনে কাজ করছে।’
দুদক কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, ‘তার প্রকৃত নাম কী, তিনি রাজশাহীতে এসে কার আশ্রয়ে ছিলেন বা কারা তাকে সহযোগিতা করেছিল সেটা এখনো জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে কাজ করা হচ্ছে। দ্রুত রহস্য উদঘাটন সম্ভব হবে বলে আশা করি।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজশাহীর দুইজন শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ভারতীয় নাগরিককে জাল পাসপোর্ট দেয়ার বিষয়টি নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়। জাল পাসপোর্ট ইস্যু করাতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে মূল সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে সেসময়ে তিনি কোনোভাবে মুখ খুলছিলেন না। ফলে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি এগোনো সম্ভব হয়নি। পরে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে ভারতীয় সংস্থার কাছে জানতে চাওয়া হয়। ধাপে ধাপে কিছু তথ্য মেলে। সেগুলো নিয়ে এখনও তদন্ত কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা।
দুদক’র মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৬ জন রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন ভারতীয় নাগরিক হাফিজ আহমেদ। আবেদনে নিজেকে রাজশাহীর ছোটবন গ্রামের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করেন তিনি। মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করেই সম্পন্ন হয় প্রি-এনরোলমেন্ট। পরে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সেই আবেদনটি নিজ জিম্মায় রাখেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী রঞ্জুলাল সরকার।
বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে ওই বছরের ১২ জুলাই পুলিশ প্রতিবেদনের জন্য অন্য ৪৩টি পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে হাফিজ আহমেদেরও প্রয়োজনীয় তথ্যও পাঠানো হয় রাজশাহী মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখায়। পরে ৩১ জুলাই পুলিশের পক্ষ থেকে হাফিজ আহমেদকে ভারতীয় নাগরিক বলে প্রতিবেদন পাঠানো হয় পাসপোর্ট অফিসে।
কিন্তু পুলিশের ওই প্রতিবেদনের তথ্য গোপন করে ফেলেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে ওই বছরের ১৬ আগস্ট পাসপোর্টটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদনের জন্য মডিউলে চলে যায়। এরপর একই বছরের ৩০ আগস্ট পাসপোর্টটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ৭ সেপ্টেম্বর পাসপোর্টটি গ্রহণ করেন হাফিজ আহমেদ। পাসপোর্ট রিলিজের পরপরই হাফিজের সকল আবেদন ও নথিপত্র পাসপোর্ট অফিস থেকে গায়েব করে ফেলেন কর্মচারী-কর্মকর্তারা।
আর পাসপোর্ট পেয়েই ভিসা আবেদন করেন হাফিজ আহমেদ। তা হাতে পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০০৩৫ ফ্লাইটযোগে সৌদি আরবের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। এরপর তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
সম্প্রতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে গোপনে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। তবে হাফিজ আহমেদ ও তার বাংলাদেশে থাকা কোনো ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে এখনও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে ঠিকই ধরা পড়েছেন জালিয়াতি করে পাসপোর্ট দেয়া রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের ৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
তাদের বিরুদ্ধে দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আবজাউল আলম, রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী রঞ্জুলাল সরকার, হুমায়ুন কবির, দেলোয়ার হোসেন, আলমাস উদ্দিন, ইব্রাহিম হোসেন, আবদুল ওয়াদুদ এবং ভারতীয় নাগরিক হাফিজ আহমেদ।
এর মধ্যে আবজাউল আলম বর্তমানে বগুড়া পাসপোর্ট অফিসে একই পদে কর্মরত। তবে যে বছর আবজাউল আলম ভারতীয় নাগরিককে জেনেশুনে জাল পাসপোর্ট দেন, সেই ২০১৭ সালে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর তাকে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। পাসপোর্ট কার্যালয় দালালমুক্ত করে সেবাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, সেবা সহজীকরণ, নতুন উদ্ভাবনী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, দক্ষ অফিস ব্যবস্থাপনার জন্যই তাকে পুরস্কৃত করা হয়।