ধর্মঘটের চাপে নতুন সড়ক আইনে অঘোষিত শিথিলতা!

ঢাকা, জাতীয়

নাজমুল হাসান সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-10 13:52:38

নতুন সড়ক আইন-২০১৮ সংশোধন বা পরিমার্জনের দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অঘোষিত ধর্মঘট পালন করেছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। আর এরই প্রভাব পড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের উপর। তবে বুধবার (২০ নভেম্বর) মধ্যরাত পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। তাই ধর্মঘটের চাপে নতুন আইনে অঘোষিত শিথিলতা আনা হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

এদিকে, ধর্মঘট প্রত্যাহারের ফলে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সকাল থেকেই রাজধানীতে গণপরিবহনের চাপ লক্ষ্য করা গেছে। আর নতুন আইন বাস্তবায়নে ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে ‘ট্রাফিক পক্ষ’, যা চলবে আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই ১৫ দিন মূলত নতুন সড়ক আইনটি গণপরিবহন চালক, হেলপারসহ যাত্রী ও পথচারীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে।

ধানমন্ডি, আসাদগেট, খামারবাড়ি ও বিজয়সরণি ও ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় গণপরিবহনের ব্যাপক চাপ ও দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশরা সিগন্যালগুলোতে তৎপর। তবে আইন প্রয়োগে তারা যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন।

নতুন সড়ক ও পরিবহন আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ট্রাফিক সার্জেন্টরা কেমন ভূমিকা পালন করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বরত এক সার্জেন্ট জানান, আজ থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু। মূলত নতুন আইনের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে। তবে এখনো নতুন আইনে জরিমানা ও মামলা দেওয়া শুরু হয়নি।

কেন শুরু হয়নি জানতে চাইলে তিনি জানান, এ বিষয়ে উপরের কোনো নির্দেশনা নেই। আর পরিবহন মালিক শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছে তাই বিষয়টা বিবেচনাধীন আছে।

রাস্তায় গণপরিবহনের চাপ

ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগ তেজগাঁও জোনের সার্জেন্ট রেজাউল করিম বলেন, ‘নতুন আইনে আমরা অ্যাকশনে যাচ্ছি না। তবে লাইসেন্সবিহীন চালক, নিবন্ধন, ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স। ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ি পেলে সেগুলো ডাম্পিং করা হচ্ছে। আর লাইসেন্সবিহীন চালকদের ক্ষেত্রে পুরনো আইনে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া উল্টো পথে চলাচল, যত্রতত্র পার্কিং ও পারাপারের ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি থাকলেও জরিমানা করা হচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের প্রাথমিক ব্রিফিং কিংবা শাস্তিস্বরূপ নতুন সড়ক আইন মুখস্থ করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর জরিমানার ক্ষেত্রেও নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। জরিমানার ক্ষেত্রে ডিএমপির নিজস্ব অধ্যাদেশ বলে কমিশনার জরিমানা কমিয়ে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’

ট্রাফিক পক্ষ চলাকালীন যতটুকু সম্ভব নমনীয়তা দেখানো হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব থেকে বড় ব্যর্থতা আমরা অসচেতন পথচারীদের এখনো আইনের আওতায় আনতে পারছি না। উল্টোপথে পথচারী পারাপার, জেব্রা ক্রসিং না মেনে রাস্তা পারাপারসহ বেশ কিছু সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারছি না। এক্ষেত্রে পথচারীদের ধরে ধরে জরিমানা আদায়ের ক্ষেত্রে শিথিল থাকার নির্দেশনা আছে।’

কথা প্রসঙ্গে সার্জেন্ট রেজাউল করিম বলেন, ‘ট্রাফিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শীতলতা থাকায় অনেকে সুযোগ নিচ্ছেন। বিশেষ করে ৮০-৯০ ভাগ অ্যাম্বুলেন্স ফিটনেসবিহীন। তারপরও মানবিক কারণে আমরা তাদের ছাড় দিচ্ছি। কিন্তু তারা এই সুযোগ বার বার নিচ্ছে। তবে সড়কে একেবারেই চলাচলের সক্ষমতা হারিয়েছে এমন অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে আমরা কঠোর হচ্ছি।’

পথচারীদের এখনো আইনের আওতায় না আনতে পারাকে ব্যর্থতা বলে মনে করছে ট্রাফিক পুলিশ

রাজধানীতে দায়িত্বরত একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্ট ও পুলিশ সদস্য জানান, নতুন আইনে মামলা ও জরিমানার ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো এখনো নতুন রশিদ বই আসেনি এবং ডিজিটাল ডিভাইসে সফটওয়্যার আপডেট হয়নি। আইন পাসের এক সপ্তাহের মধ্যে এসব সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এগুলো করা হচ্ছে না।

এদিকে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা মনে করছেন, পরিবহন মালিকদের কাছে শুধু জনগণই নয় সরকারও জিম্মি। তাই এই আইন কার্যকরে শৈথিল্য বা বিলম্ব করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধানযুক্ত করে গত ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হয় 'সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮।

নতুন আইনের উল্লেখযোগ্য ১৪টি বিধান:

১. সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

২. সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন।

৩. মোটরযান দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।

৪. ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হবে।

৫. নিবন্ধন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

৬. ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।

৭. ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

৮. ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।

৯. সঠিক স্থানে মোটরযান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

১০. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

১১. একজন চালক প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।

১২. গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

১৩. আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেণি পাস এবং চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে হবে। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

১৪. গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। এই বিধান আগেও ছিল।

এছাড়া সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর