চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আটক বহুল আলোচিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের শনির দশা চলছেই। রিমান্ডে থাকা যুবলীগের এই কথিত নেতার সহসা জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। অন্যদিকে সরকারি প্রকল্পগুলোর ঠিকাদারি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে তাকে। তার ঠিকাদারি কোম্পানির কাছে থাকা সরকারি প্রকল্পগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে নতুন ঠিকাদার। আর সেজন্য প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হবে। শুধু জি কে শামীম নন, চলমান অভিযানে তার মতো বিতর্কিত ঠিকাদারদের সরকারি প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভাতেও জি কে শামীম প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভায় সভাপতিত্ব করেন।
একনেক সভাসূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার স্থাপন প্রকল্পটির ৫ম দফা মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য একনেক সভায় তোলা হলে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে জি কে শামীমের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে।
এ সময় জি কে শামীমের হাতে এত এত সরকারি প্রকল্প কিভাবে গেল সেটি নিয়ে সভায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সরকারপ্রধান। বৈঠকে উপস্থিত গণপূর্তমন্ত্রীর কাছে জি কে শামীমের কোম্পানির হাতে থাকা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান তিনি। একই প্রতিষ্ঠান অনেকগুলো কাজ পেলে কাজের সময়বৃদ্ধি করে দুর্নীতি, অপচয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে সভায় উপস্থিত একাধিক সদস্য মন্তব্য করেন। এ প্রেক্ষিতে একক কোম্পানি যেন একসঙ্গে দুটোর বেশি সরকারি প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে না পায় ভবিষ্যতে সেদিকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেন সরকারপ্রধান।
বৈঠকে গণপূর্তমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিতর্কিত কাউকেই সরকারি প্রকল্পে দেখতে চাই না।‘
জি কে শামীমকে ‘প্রভাবশালী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাকে বাদ দিতে আইনি কিছু জটিলতার কথা পূর্তমন্ত্রী তুলে ধরলে প্রধানমন্ত্রী জবাব দেন, আমি যখন এ চেয়ারে (প্রধানমন্ত্রীর) বসি তখন কাউকে চিনি না। অপরাধীদের কোন ছাড় নেই। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কিভাবে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করেন। আর এতে করে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও দেখতে হবে।
বৈঠকে জি কে শামীমের ইস্যুতে আলোচনার কথা বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে নিশ্চিত করেন বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, জি কে শামীমকে বাদ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিতদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে আছেন। জি কে শামীমকে বাদ দিয়ে পুনঃদরপত্রের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
এদিকে চলমান অভিযানে ২০ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে জি কে শামীম আটক হন। জি কে শামীম ও তার পরিবারের লোকজনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তার কিছুদিন পরেই জিকে শামীমের হাতে থাকা প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি নানা গুঞ্জন তৈরি হয়।
প্রসঙ্গত, রোববার (২০ অক্টোবর) জাতীয় সংসদ ভবনে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বৈঠকে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জি কে শামীমের প্রকল্পের কাজ স্থগিত কিনা, সেসব প্রকল্পের কাজের কী অবস্থা—জানতে চান গণপূর্তমন্ত্রীর কাছে। জবাবে পূর্তমন্ত্রী জানান, বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা প্রক্রিয়া চলমান। যারা কাজ পেয়েছে তারা তো সব প্রক্রিয়া শেষ করেই কাজ পেয়েছে? জি কে শামীমের কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে, আবার কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ চলছে।
এর দুই দিন পরেই জি কে শামীমের প্রকল্পের কাজের কী অবস্থা সেটি একনেক বৈঠকেও উঠে এলো। জানতে চাইলে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ নুরুল আমিন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন।‘
এদিকে জি কে শামীমের প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের কথা জানতে চাইলে গণপূর্তমন্ত্রী পরে ফোন করার কথা বলে ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি আর কল রিসিভ করেননি।
৫৩ প্রকল্প জি কে শামীমের হাতে:
গণপূর্ত অধিদপ্তরের ৫৩টি প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। এসব প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
৫৩টি প্রকল্পের ২৪টির অনুমোদন দিয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আটটি প্রকল্প, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তিনটি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। বাকি ১৭টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
৫৩ প্রকল্পের মধ্যে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্স এককভাবে ১৩টি প্রকল্প ও বাকি ৪০টি প্রকল্পের কাজ যৌথভাবে চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিকে বিল্ডার্সের ১৩টি প্রকল্পের কোনোটিই পুরোপুরি শেষ হয়নি। কোনো প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৯৯ শতাংশ। আবার কোনো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে শুধু উত্তরা নিম্ন ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ১০০ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি হয়েছে।
এককভাবে কাজ পাওয়া ১৩ প্রকল্পের অন্যতম ১০টি প্রকল্প:
=> সচিবালয়ের নির্মাণাধীন নতুন ২০ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলা থেকে ২০ তলা পর্যন্ত পূর্ত এবং অভ্যন্তরীণ স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক কাজের ভৌত ৮০ শতাংশ এবং ৫২ শতাংশ আর্থিক আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে।
=> আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থপোডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, নিটোরের এলইডি বাতি স্থাপন ও বৈদ্যুতিক কাজের ১০০ শতাংশ ভৌত এবং ৯৯ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে।
=> শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সম্প্রসারণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩২ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩১ শতাংশ।
=> ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি ৯০ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ।
=> রাজধানীর বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের চারটি অংশের গড় ভৌত অগ্রগতি ৭১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫১ দশমিক ১৭ শতাংশ।
=> ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় নির্মাণকাজের ভৌত ৯৫ শতাংশ, আর্থিক ৯২ তাংশ।
=> গাজীপুরে পাঁচটি র্যাব কমপ্লেক্স এবং একটি র্যাব ট্রেনিং স্কুল নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত ৯৯ শতাংশ, আর্থিক ৯৪ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
=> মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আধুনিকায়ন প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ, আর্থিক ৬৭ শতাংশ।
=> আজিমপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ।
=> সচিবালয়ে নতুন ২০ তলা ভবনের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৩ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ।