'ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন'

, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2025-01-20 19:28:39

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সংস্কার ও পরিবর্তনের কথা উচ্চারিত হয় জোরেশোরে। এরই ধারাবাহিকতায় একাধিক সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়। এসবে লক্ষ্য হিসাবে বলা হয়েছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ পুনরায় যেন ফিরে আসতে না পারে তেমন পরিবর্তনের পথ উন্মুক্ত করার কথা। কমিশনগুলোকে রিপোর্ট প্রদানের জন্য ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়। এরই মধ্যে কয়েকটি কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। তারা যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো নিয়ে সমর্থন ও ভিন্নমত প্রকাশিত হচ্ছে। সরকার অবশ্য বলেছে, সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সব কিছু করা হবে।

বলা বাহুল্য, সংস্কার ও নির্বাচন রাজনৈতিক মহলে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায়ও নির্বাচনের স্থান গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তথাপি কোনও পক্ষই সংস্কার ও নির্বাচনের গুরুত্ব অস্বীকার করছে না। তবে কয়েকটি রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সংস্কারের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনরাবির্ভাব ঠেকাতে রাষ্ট্রের সংস্কার অপরিহার্য। সংস্কারের পথ ধরেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। তাহলেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

এমনই প্রেক্ষাপটে কিছুদিন আগে 'ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ'-এর ‘ঐক্য কোন পথে’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে বলেন, ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন, সেটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্রের জন্য যেমন নির্বাচন প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐক্যের গুরুত্বও অস্বীকার করা যাবে না। ফলে সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক।

প্রসঙ্গত, সংস্কারের জন্য যেসব কমিশন গঠিত হয়েছে এবং তারা যেসব সুপারিশ করেছেন এবং করবেন, সেসব সুপারিশগুলো অবশ্যই জাতীয় আলোচনার বিষয় হযে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র হতে পারে। এরই ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের পথ রচিত হতে পারে। এজন্য, সুপারিশগুলোকে উন্মুক্ত ও প্রকাশ্য হতে হবে। ব্যাপক জনআলোচনার বিষয়বস্তুও হতে হবে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে গঠনমূলক সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের পরিসর দিতে হবে। এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাইরে অবস্থিত সিভিল সোসাইটির প্রতিটি অংশকেই সুপারিশ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে মত প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমকে বিস্তারিত আলোচনার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। তা না হলে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না। সংস্কার নিয়ে আন্তরিক আলোচনার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে। এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কাজটিও পিছিয়ে যাবে।

এজন্য, নাগরিক সমাজকে সতর্ক ও মনোযোগী হয়ে সংস্কারের সুপারিশগুলো চর্চা করতে হবে। একই ভাবে, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের এই আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দৃষ্টান্তমূলক মতামত ব্যক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধিতা বা নাম-কা-ওয়াস্তে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়ের গভীরতাকে ক্ষুন্ন করা মোটেও সমীচিন হবে না। সকলকেই সুচিন্তিত সমালোচনা এবং বিবেচনাযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব হাজির করার মানসিকতা দেখাতে হবে। এর ফলে সুপারিশগুলো আরো ঋদ্ধ ও লাগসই হবে বলে আশা করা যায়। এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক মতামতের ভিত্তিতে ঐক্যে সূত্র ও পন্থা খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হবে।

মনে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সমাজে সংস্কারের বিষয়ে বিভাজন কাম্য নয়। সকল পক্ষকেই জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নিজ নিজ স্বার্থের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দলীয় বা গোষ্ঠীগত বিবেচনার বাইরে না দাঁড়াতে পারলে জাতীয় ঐক্য কখনোই হবে না। নিজেদের ছোট-বড় দ্বন্দ্বের মধ্যে সংস্কারের ইস্যুকে টেনে আনলে অতীতের মতো বিরোধিতার রাজনীতি শুরু হয়ে জাতীয় ঐক্য নস্যাৎ হয়ে পড়বে।

অতএব, 'ঐকমত্য কমিশন' যখন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ চালাবে, তখন সংস্কার, জাতীয় স্বার্থ ও ঐকমত্যই হতে হবে মূল আলোচ্য বিষয়, দলীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত এক্ষেত্রে যেন প্রাধান্য না পায়। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে গ্রহণ করা। তারা যেন যুক্তি ও তথ্য দিয়ে সংস্কার প্রসঙ্গে আলোচনা করে এবং শেষ পর্যন্ত একটি ঐকমত্যে পৌঁছায়। যার ভিত্তিতে তারা নিজেদের মধ্যে এমন একটি চুক্তি ও অঙ্গীকারে উপনীত হবে যে, জনগণের ভোটের বাইারে কোনো নির্বাচন কেউ মানবে না। নির্বাচনের নামে প্রহসন হতে পারবে না। নিজ নিজ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে সবাই। নতুন সংসদে প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করে এগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের উদ্দেশ্যে শাসন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করবে। তাহলেই সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে মধ্যে একটি কার্যকর সমন্বয় সাধিত হবে এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সূচিত ঐকমত্য ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য ও ঐকমত্যের পথ প্রশস্ত করবে। এরূপ একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার ও দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত রাখতে ও গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর