রিসিভার নিয়োগের আশঙ্কায় ‘মনোবল হারাচ্ছেন’ ব্যবসায়ীরা

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-11-18 13:01:16

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পতিত সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে। ফলে সরকার পতনের পর এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাংক হিসাব জব্দসহ নানা ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করতে রিসিভার নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও দেশের ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগের অসংখ্য নজির রয়েছে। তবে কখনই পরিণতি ভালো হয়নি। রিসিভার নিয়োগের পর রুগ্‌ণ প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপ। তাদের ব্যবসায় রিসিভার নিয়োগের পর কার্যক্রম ধ্বংসের মুখে পড়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো পরিচালনা করতে না পারার কারণে পাওনা ও ঋণ পরিশোধ আরো অনিশ্চিত হয়ে গেছে।

সম্প্রতি দেশের শিল্প গ্রুপে রিসিভার নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শ্রমিকরা। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিতে পারে কিন্তু ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা দেখতে হবে। দেশ ও অর্থনীতির স্বার্থে ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রশাসক নিয়োগের আশঙ্কায় ‘মনোবল’ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা বলে জানিয়েছেন ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান।

 ‘দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভালো নেই ব্যবসা-বাণিজ্য। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির সার্বিক প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এর মধ্যে বেসরকারি কোনো কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা রাজনৈতিক আক্রোশে পড়েছেন। লাল তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের আশঙ্কায় মনোবল হারাচ্ছেন তারা।’- বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

কেন রিসিভার নিয়োগ করা হয়- এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বলেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অযোগ্য হয়ে যায় বা পরিচালনার মতো অবস্থা না থাকে সেক্ষেত্রে রিসিভার বা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। এই রিসিভার অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে দেখাশোনা করবেন। এই কাজটি সরকার তার নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে করতে পারে কিংবা আদালতের আদেশের মাধ্যমেও হতে পারে।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, রিসিভাররা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির আয় ও ব্যয়ের হিসাব আদালতে জমা দেবেন। কোনো কারণে সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রিসিভার দায়ী থাকবেন। এ ছাড়া চূড়ান্ত রায়ে কোনো কারণে আসামি খালাস পেলে তাঁকে তাঁর সম্পত্তি ফেরত দিতে হবে। ফলে ক্রোককৃত সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সবাইকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।

সম্প্রতি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের সব সম্পত্তি সংযুক্ত করে তা ব্যবস্থাপনায় ছয় মাসের জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে রিসিভার নিয়োগে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে বেক্সিমকো গ্রুপ আপিল করায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে রিসিভার নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। তবে গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগের আদেশ বহাল থাকবে। জানা গেছে, সম্প্রতি বেতন দিতে না পারায় বেক্সিমকো গ্রুপের একাধিক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।

ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ‘নগদ’-এ প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে প্রশাসক নিয়োগের পর নগদের লেনদেন আগের চেয়ে কমে গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।

পতিত সরকারের আমলেও ২০২০ সালে, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে এ রকম বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন চেয়ে গ্রাহকরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।

২০১১ সালে হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (হোটেল শেরাটন) শাখা থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, যা নিয়ে তখন বড় আলোচনা তৈরি হয়। সেই ঘটনার বিচারকাজ এখনো চলছে। তবে টাকা আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক। এই ঘটনায় উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসাও ধ্বংস হয়ে গেছে হলমার্কের।

এদিকে ঋণখেলাপের পরিপ্রেক্ষিতে জনতা ব্যাংকের গ্রাহক এননটেক্স গ্রুপও রুগ্‌ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। অনিয়ম, জালিয়াতি ও তথ্য গোপন করে এননটেক্স গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানকে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল সময়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। অনারোপিত সুদ বাদে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ছয় হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।

এননটেক্স গ্রুপের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, টঙ্গীতে তাঁদের কারখানা ছিল ২২টি। রহস্যজনক আগুনে পুড়ে দুটি কারখানা তিন-চার বছর আগে বন্ধ হয়েছে। অর্থাভাবে দিন দিন কারখানা কমতে থাকে। এখন চালু রয়েছে মাত্র চার-পাঁচটি কারখানা। কারখানার মালিক ৫ আগস্টের আগে দেশে ছেড়ে যান।

ইভ্যালির ক্ষেত্রেও হাইকোর্ট থেকে রিসিভার নিয়োগ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত সেই প্রতিষ্ঠান আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। টাকা ফেরত পায়নি হাজার হাজার গ্রাহক।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা নজির রয়েছে। তবে কোনো দেশেই প্রশাসক নিয়োগে তেমন ভালো ফল পায়নি। চীনে দুর্নীতি দমনের কথা বলে ব্যক্তি খাতের ওপর নানা আক্রমণ চলে। ২০২০ সালে দেশটিতে নজরদারি ও বিধি-নিষেধের প্রধান বলি ছিল শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবা, শীর্ষস্থানীয় গেম নির্মাতা কম্পানি টেনসেন্ট, ফুড ডেলিভারির কম্পানি মাইতুয়ান, সার্চ ইঞ্জিন কম্পানি বাইদু এবং জেডি ডটকম। সরকারি এই নিয়ন্ত্রণ ১৮ মাস বজায় থাকে। চীনের শীর্ষ পাঁচ প্রযুক্তি কম্পানির শেয়ারমূল্য ৪০.৪ শতাংশ থেকে ৭১ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বেক্সিমকো কয়েক মাস ধরে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছিল না। সরকার তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে। গ্রুপটিকে সচল করতে এখন সেখানে রিসিভার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বেক্সিমকোতে রিসিভার দেওয়া মানে বন্ধ নয়; বরং এটা সচল করা হচ্ছে। আমরা চাই না, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা শিল্প বন্ধ হয়ে যাক। কারণ সেখানে অনেক কর্মসংস্থান রয়েছে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর