আয়নাঘরের দুঃস্বপ্নের সেই সব দিনের বর্ণনা ভুক্তভোগীদের মুখে

, জাতীয়

নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-10-18 21:04:36

বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে আয়নাঘরের নাম নিয়ে আছে নানা আলোচনা। তাঁর সরকারের পতনের পর সেই গোপন বন্দীশালা থেকে কয়েকজন মুক্তি পায়। তাঁদের কয়েকজনের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সেখানকার ভয়ংকর নির্যাতনের চিত্র। এ নিয়ে প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এতে বলা হয়েছে দেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনে ১৭ কোটি মানুষের সামনে খুলেছে এক নতুন ভবিষ্যতের দুয়ার। ওই ঘটনায় একই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন কারাগারে রাজবন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনি।

নির্যাতন সইতে না পেরে আয়নাঘরের কোনো কোনো বন্দী প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। কেউ বা বরণ করেছেন মৃত্যুকে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই বন্দিশালা থেকে ছাড়া পেয়েছেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর আক্রোশের শিকার হওয়ার গল্প তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টায় জোরপূর্বক গুম করা ছিল তাঁর নেওয়া কৌশলগুলোর অন্যতম। এ অপচেষ্টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহৃত শত শত মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, যেমন বিক্ষোভ-সমাবেশ আয়োজন, রাস্তা অবরোধ, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষুব্ধ কোনো মন্তব্য করার জন্য। ভুক্তভোগীদের অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে। অন্যদের কণ্ঠ রোধ করতে আয়নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। সেখানেও মারা গেছেন অনেকে। সৌভাগ্যক্রমে এই বন্দিশালা থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছেন কয়েকজন।

আয়নাঘরে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁদেরই কেউ কেউ।আয়নাঘরের জীবন নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করা এই ব্যক্তিদের একজন মীর আহমেদ কাসেম আরমান। গত আগস্টে আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান তিনি। বন্দীদের মধ্যে তাঁর মতো আইনজীবী ছাড়াও ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কূটনীতিক, এমনকি মানবাধিকারকর্মীরা।

সাবেক বন্দীদের তিনজনকে আয়নাঘরের একটা ছবি আঁকার অনুরোধ জানিয়েছিল দ্য টাইমস। তাঁদের আঁকা ছবিতে (স্কেচ) দেখা যায়, একটা লম্বা করিডর। আধা ডজন কক্ষ। একটি অপরটি থেকে দূরে, তবে মুখোমুখি। করিডরের দুই প্রান্তে শৌচাগার। একটি দাঁড়িয়ে ব্যবহারের, অন্যটি বসার। প্রতিটি কক্ষে ছিল একটি বড় এগজস্ট ফ্যান। এমন ফ্যান থাকার কারণ, যাতে নিরাপত্তারক্ষীদের আলাপ শোনা না যায় এবং বন্দীদের মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তোলা যায়।

গোপন বন্দিশালায় বিরামহীন যন্ত্রণা ভোগের বর্ণনা দিয়েছেন আবদুল্লাহিল আমান আজমি। সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা আজমিকেও দৃশ্যত তাঁর বাবার কারণে (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির গোলাম আজম) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর তিনিও ওই সামরিক কারাগার (আয়নাঘর) থেকে ছাড়া পান। আমান আজমি আট বছর বন্দী ছিলেন। আজমির অনুমান, ওই কয়েক বছরে অন্তত ৪১ হাজারবার তাঁর চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরানো হয়েছে।

আমান আজমি বলেন, ‘আমি (বন্দিজীবনে) সৃষ্টিকর্তার আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, ঘাস, গাছপালা দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্দী হওয়ার পর প্রথম দিকে আমি দুটি ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে সূর্যের আলো দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর তারা (কর্তৃপক্ষ) সেগুলো বন্ধ করে দেয়।’ জীবনধারণের মতো পরিবেশ না থাকা কারাগারটিতে চলত কঠোর নজরদারি। শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হতো নিয়মিত। চুল কাটা হতো প্রতি চার থেকে ছয় মাসে একবার। জিজ্ঞাসাবাদের প্রাথমিক দিনগুলোয় চলত শারীরিক নির্যাতন। বেশি হতো মানসিক নির্যাতন।

কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মারুফ জামান। ২০১৯ সালে তিনি আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান। এর আগে এ বন্দিশালায় এক বছরের বেশি সময় (৪৬৭ দিন) ছিলেন তিনি।

আয়নাঘরের ছবি আঁকার জন্য দ্য টাইমসের অনুরোধে মারুফ জামান গুগল ম্যাপ খুলে দেখান। জুম করলে দেখা যায়, ঢাকার একটি সামরিক ঘাঁটি। সেখানেই আয়নাঘরের অবস্থান। এ গোপন বন্দিশালার নাম প্রথম জানা যায় ২০২২ সালে বিদেশে বাংলাদেশি গণমাধ্যম নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদন থেকে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা। আগস্টের কোনো এক দিন কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তাঁকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি জঙ্গলে ছেড়ে যাওয়া হয়।

মাইকেল চাকমা বলেন, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি দিনের আলো দেখলাম। যখন দেখছিলাম, দুবার পরীক্ষা করছিলাম, আমি কি এ আলো স্বপ্নে দেখছি, নাকি বাস্তবেই।’

ঢাকায় ২০১৯ সালে একটি ব্যাংকে ঢোকার পর অপহৃত হন মাইকেল চাকমা। কারাগারের ভেতর তিনি জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে জানতে চাইতেন, কেন সেখানে তাঁকে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে কাছাকাছি যে জবাব পেয়েছেন তা হলো, রাজনৈতিক প্রতিশোধ।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি সব সময় তাঁদের কাছে জানতে চাইতাম, আমার কী অপরাধ? আমি কী করেছি? আমি কি দোষী? তাঁরা বলতেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে আমি অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনীতি করছি।’

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর নারী–পুরুষের ছোট একটি দল রাস্তায় লাখো উল্লসিত জনতার ঢেউ ঠেলে হাজির হয়েছিল সেনা সদর দপ্তরের ফটকে।

ওই দলে এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা হাসিনার আমলে জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েও বেঁচে যান। তাঁদের একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান। দেড় বছর নিখোঁজ ছিলেন তিনি। এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা আয়নাঘর প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা দিন–রাত ঘুমাতে পারতাম না। লোকজন কাঁদত, চিৎকার করত, তাঁদের নির্যাতন করা হতো।’

ফটকে হাজির হওয়া নারীরা খুঁজছিলেন তাঁদের হারানো স্বজনদের। তাঁরা অনেক বছর ধরেই দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, স্বজনের সন্ধানে। জীবিত না পেলেও তাঁরা চান, স্বজনের মরদেহের সন্ধানটুকু পেতে।

এ ঘটনার পর কয়েক দিনে ফিরে এসেছেন আরমান, আজমি ও মাইকেল চাকমা। তাঁদের এ মুক্তি গুমের শিকার অন্য ব্যক্তিদের মা, বোন, স্ত্রী–কন্যাদের মনে আশা জুগিয়েছে। তাঁদের সবার প্রশ্ন, ‘আমাদের প্রিয় মানুষ কোথায়?’ স্বজন হারানো এসব ব্যক্তি যেখানেই সমবেত হোন না কেন, তাঁদের দাবি, ‘বন্ধ করা হোক এসব আয়নাঘর’।

এ সম্পর্কিত আরও খবর