রাজশাহীতে মাত্রাতিরিক্ত শব্দে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2024-10-15 10:41:53

নগরায়ণের অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজশাহীতে শব্দ দূষণ ক্রমশই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যানবাহনের হর্ন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার টিটি হর্ন, এবং বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতে অযথা উচ্চ শব্দের কারণে নগরবাসীকে নানা শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণে লোকজন নানা সমস্যা ভুগছেন। অনেকের কানের শুনতে সমস্যা হচ্ছে, রক্তচাপ বাড়ছে, ঘুমে বিঘ্ন ঘটছে এবং মানসিক অস্থিরতা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য আরও খারাপ হবে। তাই শব্দ দূষণ কমানোর জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছর ধরে শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে আমাদের এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল, কিন্তু এখন প্রতিদিনই গাড়ির হর্ন, নির্মাণ কাজের শব্দ এবং নানা ধরনের কোলাহল সহ্য করতে হয়। এই শব্দের কারণে আমার পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

নগরীর তালাইমারি এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় মুদি দোকানদার শাহজাদা হোসেন বলেন, শান্তির নগরী রাজশাহী আমাদের কাছে যে স্বপ্নের মতো ছিল, এখন তা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। আমরা যদি সবাই মিলে এই সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হই, তাহলে হয়তো কিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের প্রথম এবং রাজশাহী বিশ্বের চতুর্থ শব্দ দূষণকারী শহর হিসেবে দেখানো হয়। যেখানে রাজশাহীতে শব্দের পরিমাণ দেখানো হয় ১০৩ ডেসিবেল। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রাজশাহী শহরের পাঁচটি জনবহুল স্থানে দিনের বেলা নগরীর ব্যস্ততম সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ২০২২ সালে, এবং একই স্থানে ২০২৩ সালে শব্দের মান নির্ণয় করে। পরিবেশ বান্ধব শহর রাজশাহীর পাঁচটি স্থান, তালাইমারী মোড়, রেইলগেট, বিসিক মঠ পুকুর, লক্ষিপুর মোড় ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় শব্দের মান নির্ণয় করা হয়।

বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে নগরীর রেলগেট ও লক্ষীপুর মোড়ে শব্দ দূষণের মাত্রা ছিল ৯০ ডেসিবেল, যা পুরো নগরীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও নগরীর তালাইমারী এলাকায় ৮৪ ডেসিবেল, বিসিক মোড় এলাকায় ৭৪ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৮৮ ডেসিবেল ছিল শব্দ দূষণের মাত্রা। তবে এক বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে শব্দ দূষণের মাত্রা নগরীর তালাইমারীতে ৮৬ ডেসিবেল, রেলগেটে ৯০ ডেসিবেল, বিসিক মোড়ে ৭২ ডেসিবেল, লক্ষীপুর মোড়ে ৮৯ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৮৭ ডেসিবেল পাওয়া যায়। দিনের চেয়ে রাতেও শব্দ দূষণের মাত্রা খুব একটা কম নয় বলেও পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে।

সবশেষ ২০২৪ সালের ১২ অক্টোবর সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরীর তালাইমারী এলাকায় ৮৮ দশমিক ৮ ডেসিবেল, রেলগেটে ৯৬ দশমিক ৩ ডেসিবেল, বিসিক মোড়ে ৭৬ ডেসিবেল, লক্ষীপুর মোড়ে ৯৬ দশমিক ১ ডেসিবেল ও সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ৯০ দশমিক ৫ ডেসিবেল পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকৌশলী ড. জাকির হোসেন খান বলেন, অধিকাংশ যানবাহন অযথা হর্ন বাজাতে থাকে। বর্তমানে রাজশাহীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যাটারিচালিত অটো এবং রিকশা বিদ্যমান। যেগুলো মূলত টিটি হর্ন ব্যবহার করে। নগরীর তালাইমারী ও রেলগেটে বাসগুলোকে অযথা হর্ন বাজাতে দেখা যায়। অটোরিকশায় ভেপু হর্ন বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেন অন্য কোনো হর্ন ব্যবহার করতে না পারে। এছাড়া অটোরিকশা আর রিকশা নির্দিষ্ট লেনে দাঁড়ালে অহেতুক হর্ন দেওয়া অনেকাংশেই কমে যাবে।

তিনি বলেন, শহরের মধ্যে গতি সীমা নির্দিষ্ট করলে এর পরোক্ষ প্রভাব শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের ওপর পড়বে। শব্দ দূষণের প্রভাব শুধু মানুষের ওপর না, প্রতিটি পশু-পাখির ওপর পড়ে। গাছ শব্দের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যথেষ্ট কার্যকর। আমের শহর রাজশাহীতে আম-জাম জাতীয় ফলের গাছ, নিম, সজনে জাতীয় উপকারী গাছ লাগানো যেতে পারে। যেগুলো বড় হলে শব্দ ও বায়ু দূষণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। সজনে গাছ বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন নির্গমনে কার্যকর গাছ গুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই এসব গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা গেলে অনেকটাই কার্যকরী হতে পারে।

মানুষের কথা চিন্তা করেই নীরব এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এসব সিরিয়াস রোগী, বয়স্ক ও শিশুরাও থাকে। তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এসব এলাকায় শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ শব্দ দূষণের কারণে শ্রবন ক্ষমতা হ্রাস পায়, হার্ট এ্যটাকের ঝুঁকি বাড়ায়, ইরিটেশন ফিল করে, হাইপার টেনশন বেড়ে যায়, শিশুদের প্রতিবন্ধি করে তুলে ও অস্থিরতা বাড়ে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ ব্যাপারে রাজশাহীর নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. এএসএম ইকবাল হোসাইন সাঈদ বলেন, উচ্চ মাত্রার শব্দ দূষণ কানের শ্রবণ ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ সময় এই অবস্থায় থাকলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা থেকে বাঁচতে হলে রাস্তায় গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নগুলো কমাতে হবে। এটা নগর কর্তৃপক্ষকে সমাধান করতে হবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে শহরের লাল-সবুজ অটোরিকশাগুলো একত্রে চলাফেরা করতে গিয়ে শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলছে। একইসাথে মহানগরের বাইরের অটোরিকশাগুলোও শহরে প্রবেশ করছে। যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই শব্দের মাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠেছে। এছাড়া, অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করছে। এ কারণে আমাদের শান্তিপূর্ণ নগরীতে শব্দ দূষণের প্রবণতা বাড়ছে। শব্দ দূষণ প্রতিরোধের জন্য আমরা ব্যাপক প্রচারাভিযানের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অবৈধ যানবাহনের মালিকদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) নূর আলম সিদ্দিকী বলেন, প্রত্যেকের উচিত নিজেদের দায়িত্ব সচেতনভাবে পালন করা। ৫ তারিখের পর থেকে পুলিশ বিভাগ হিসেবে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে এবং পরিবর্তিত অবস্থায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রায় ২০-২৫ দিন আগে থেকেই রাজশাহীর রাস্তায় দুই শিফটে চলাচলকারী অটোগুলোকে আলাদা করা হয়েছে। শুধুমাত্র শুক্রবার দিন দুই শিফটের অটো একসাথে চলে, এবং এর বাইরে কেউ যদি এই নিয়ম ভঙ্গ করে, তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর