‘এই মামা বাংলামোটর যাবেন?' গ্রিন রোডের কাছাকাছি পান্থপথের একটি হাসপাতালের সামনে প্যাডেলচালিত রিকশাচালকের কাছে জানতে চাওয়ার ভঙ্গিটা এমনই ছিলো। ডাকে সাড়া দিলেন চালক। ভাড়া চাইলেন ৭০ টাকা। কিন্তু ঠিক তখনই এসে থামলো একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। গায়ে চকচকে রঙ। পরিপাটি। আরামদায়ক সিট। দেখে ঢোক গিললাম। মানে প্যাডেলচালিত রিকশাচালকের সাথে কথপোকথনটা যেনো থামিয়ে দিতে নিজের কথাগুলোই গিলে ফেললাম।
দুপুরের ভ্যাপসা গরম। শরতের আকাশে ছোপ ছোপ কালো মেঘও জমেছে। তার উপর দুই-এক ফোটা বৃষ্টিও পড়ছে। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত চোখটা ঘুরিয়ে নিলাম প্যাডেলচালিত রিকশাওয়ালার দিক থেকে। অটোরিকশা চালকের কাছেও একই প্রশ্ন ‘যাবেন বাংলামোটরে?’।
এবার আর মামা নয়, সরাসরি আপনি বলে সম্বোধন।
সম্মতি পেতেই প্রশ্ন- ‘কত ভাড়া?’ দরকষাকষিতে ৫০ টাকা ভাড়া ঠিক হলো। এরপর চাপলাম ‘পক্ষ্মীরাজে’। সুইচের এক টিপেই চোখের পলকে বিআরবি হাসপাতাল থেকে গ্রিনরোড সিগন্যাল। সেখানে অবশ্য আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন প্যাডেলচালিত রিকশাওয়ালা। বড় চোখ করে চেয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই হালকা অপরাধবোধে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলাম।
এরপর সিগন্যাল ছাড়তেই যেনো রাস্তার রাজা বনে গেলো আমার ‘অটোরিকশা’। উঁচু-নিচু কোন বাছ-বিচার নেই। ধেই ধেই করে সড়কের মাঝখান দিয়ে চলছে। মহা মুশকিল। বার বার সড়ক দুর্ঘটনায় পড়া আমিতো ঘরপোড়া গরু। একটু ভয়ই পেলাম। কিন্তু থামালাম না। উল্টো বললাম ‘মামা, এত দ্রুত চালাচ্ছেন, পুরোই মোটর গাড়ি!’ হালকা ব্রেক কষে তার উত্তর- ‘প্রাইভেট কারের থেকে এটা কম না!’
হবে না কেনো। ব্যাটারির শক্তির গতি নিয়ে সত্যিই যেনো রাস্তার রাজা হয়ে উঠেছে এই রিকশাগুলো। চালকরা পাত্তা দেয়না কোনো গাড়িকেই। বাস, প্রাইভেট কার কিংবা অন্য কোনো দ্রুতগতির যানবাহনে থোরাই কেয়ার। রাস্তার মাঝ দিয়ে চলে এই রিকশা। যা রীতিমতো আতঙ্কের।
রাজধানীসহ সারা দেশে অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট। অলিগলিসহ মূল সড়কে এসব এই রিকশার দাপটে ভেঙে পড়েছে রাজধানী ট্রাফিক ব্যবস্থা। অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও ঝুঁকিপূর্ণ বাহনটি এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য যানবাহন চলাচলেও প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাফিক পুলিশের নির্বিকার ভূমিকার কারণে যানজট নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই নৈরাজ্য চলছে। এরমধ্যে শুরু হয়েছে অটোরিকশার এই উপদ্রব।
নিউ মার্কেট, সায়েন্সল্যাব, কাওরান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগে সরজমিনে দেখা যায়, এসব এলাকার মূল সড়কে এলোমেলোভাবে চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। সড়কে বাস ও প্রাইভেট কারের মাঝখান দিয়েই ঢুকে পড়ছে এই রিকশাগুলো। কোনোটি মালপত্র নিয়ে, কোথাও যাত্রী নিয়ে। শুধু যে নিয়ম ভেঙে, ট্রাফিক আইন অমান্য করে চলছে তাই নয়। এর চালকেরা সড়কে যখন তখন বাক-বিতণ্ডায় জড়াচ্ছে। কখনও বাইক চালকদের সঙ্গে কখনওবা গাড়িচালকের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখা যায় তাদের। বিশেষ করে হাতিরঝিল। যেখানে কখনওই রিকশা চলতে দেখা যায়নি। সেখানেও চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল হচ্ছে। কিন্তু তাতে কার কী যায় আসে?
তবে মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলায় সত্যিই অতিষ্ঠ নগরবাসী। তবে তারা এমন একটি বাহনের বিপক্ষে নয়। তারা বলছেন, যানজটের এই শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশার চাহিদা রয়েছে। সেই সঙ্গে রিকশাগুলো সুসজ্জিত ও আরামদায়ক সিট থাকায় যাত্রীরা আকৃষ্টও হচ্ছে। তবে অবশ্যই সেটা অলি-গলিতে চললে ভালো হয়। রাজধানীর মূল সড়কে এসব রিকশা ‘এক প্রকারের যন্ত্রণা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পা উঠিয়ে বসে থাকা চালকরা স্রেপ ট্রাফিক আইনই ভাঙছেন না। যেখানে সেখানে দেখাচ্ছেন ঔদ্ধত্য আচরণ। আর মূল সড়কে তাদের নিষেধ করার সরাসরি বিরোধিতা করেন তারা।
কাওরান বাজারে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ওহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাগো মেইন রাস্তা মানা করার কিছু নাই। যাত্রীরা আমাদের চায়। আমাদের রিকশার কারণে জ্যাম হয় না, জ্যাম হয় ট্রাফিকরা (ট্রাফিক পুলিশ) বইস্যা আছে এজন্য।’
ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের দাবি, তাদের রিকশা তৈরি ও পরিচালনায় যে খরচ তা উঠাতে মূল সড়কে রিকশা চালাতেই হবে। তা না হলে তাদের জমা, চার্জের খরচ ও রিকশার খরচ উঠবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুই ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার হয়। একটি ১৩০ ভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন, অন্যটি ২৩০ ভোল্টের। ১৩০ ভোল্টের ব্যাটারি সম্পূর্ণ চার্জ হতে বিদ্যুৎ খরচ হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকার। আর ২৩০ ভোল্টের ব্যাটারি চার্জ হতে খরচ হয় ৫০ থেকে ৭০ টাকার। তবে তা ব্যক্তি ব্যবস্থাপনায়। এরই মধ্যে রাজধানীতে এসব বাহনের ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন স্টেশন ও গ্যারেজে। সেখানে চার্জ দিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত গুণতে হয় বলে দাবি চালকদের।
হাসু নামে এক চালকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, এমন একটি রিকশা তৈরিতে খরচ হয় ৯০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। আবার চার্জ দিতে খরচ হয় দিনে এক-দেড়শ'। জমা দিতে হয় ৫০০ টাকা। সব মিলে গলিতে চালাইলে পেট চলবে না।'
'সরকার আমাগো আলাদা লেন করে দিতে পারে। কিন্তু বন্ধ করা যাবে না,’ দাবি হাসুর।
কেউ কেউ মনে করছেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করা যাবে না, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাবে। নগর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এর জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও পুর্নবাসন ব্যবস্থা।
"অটোরিকশা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। পরে আরও বেশি কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। যারা সড়কে নেমে গেছে তাদের চাইলেই রাতারাতি সরাতে পারব না। এর জন্য কৌশলী হতে হবে," বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান।
দ্রুত নীতিমালা তৈরির তাগিদ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বার্তা২৪.কম’কে বলেন, দুঃখজনক হলো- ২০১৮ সালের পর থেকে বার বার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য নীতিমালা তৈরি করার। কোন কোন সড়কে তারা চলতে পারবে- সে নীতিমালাও হয়েছে। কিন্তু সেটা খসড়া আকারে রয়েছে। এটাকে পুরোপুরি রূপ দেওয়া বা বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আমরা দেখছি অটোরিকশা সংখ্যা সম্ভাব্য ৩০ থেকে ৪০ লাখে ঠেকেছে।
"এটা আরও বাড়তে থাকবে যদি অতিদ্রুত নীতিমালা তৈরি করে নিয়ন্ত্রণ না করা না যায়। যানজট ও সড়কের নিরাপত্তায় এরই মধ্যে একটা বড় ধস নেমেছে, এই ধস ঠেকানো আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা," বলেন ড. হামিউজ্জামান।
এর আগে গত মে মাসে রাজধানীতে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত কোনো রিকশা চলতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলো গণ-অভ্যুত্থানে পতন হওয়া সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তবে সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। আন্দোলনের মুখে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় হাসিনা সরকার।