হুগলিতে ঈদের দিন হিন্দুর সৎকার করলেন মুসলিমরা

ভারত, আন্তর্জাতিক

কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 13:43:34

করোনার সুতীব্র আঘাতে ভারতে যখন মৃত্যুর মিছিল, তখন ঈদের দিনটিতে মানবতা ও সম্প্রীতির নজির দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে। খুশির ইদ উৎসবে প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারে মৃত্যুর খবর পেয়ে এগিয়ে এলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। করোনার ভয়ে যখন সবাই দূরে সরে রইলেন, তখন ভয় ও সঙ্কীর্ণতা উপেক্ষা করে হিন্দু প্রতিবেশীর দেহ অন্তিম সৎকারে এগিয়ে এলেন মুসলিম সহনাগরিকগণ।

ভারতের বিশিষ্ট সংবাদপত্র 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র অনলাইন বাংলা ভার্সানে প্রকাশিত উদারতা, মানবিকতা ও পরহিতের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সংবাদটি পাঠ করে কাজী নজরুল ইসলামের অবিস্মরণীয় কবিতার কথা মনে পড়বেই: 'হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন হে, কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র…!'

নির্বাচন ও রাজনীতির সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও হুঙ্কারের পটভূমি পেরিয়ে যখন নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত ও রক্তপাত পশ্চিমবঙ্গকে বিপর্যস্ত করেছে এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তাকে কোণঠাসা পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তখনই সম্প্রীতির উদাহরণ তৈরি করলেন সংখ্যালঘু মুসলিমরাই।

প্রকাশিত খবরের বিবরণে প্রকাশ, পোলবা-দাদপুরের আশিক মোল্লা, গোলাম সুবাহানি, গোলাম সারোয়ার, শেখ সানির মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা শুক্রবার (১৪ মে) পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন এক মহৎ কাজ করে নজির সৃষ্টি করেন। ঈদের নামাজ পড়ে তারা যখন উৎসব পালনে ব্যস্ত ছিলেন, সেইসময় খবর পেলেন পাশের গ্রামের ৭২ বছরের হরেন্দ্রনাথ সাধুখাঁর মৃত্য হয়েছে। একদিন আগে মৃত্যু হলেও তার শবদেহ শেষকৃত্য ছাড়াই পড়ে আছে। তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগে মৃত্যু হয় তার। যদিও কোভিড টেস্টের আগেই প্রাণ চলে যায় বৃদ্ধের, তথাপি আত্মীয়-পরিজন তাকে পরিত্যাগ করে দূরে সরে যায়।

আরও জানা যায় যে, হরেন্দ্রনাথের মরদেহ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়ে পাড়া-প্রতিবেশীরাও। আত্মীয়দের মতোই করোনার ভয়ে সৎকারের জন্য নিকট প্রতিবেশীরাদের কেউই এগিয়ে আসে নি। এমনকি, কেউ ফিরেও তাকায়নি সদ্যমৃত বৃদ্ধের মরদেহের দিকে।

পরিতাপের বিষয় হলো, বৃদ্ধের একমাত্র ছেলে যখন সবার কাছে সাহায্যের জন্য দিশাহারা হয়ে ঘুরছেন, তখন কেউ সাড়া দেয় নি। অবশেষে  চরম অসহায়তা দেখে এগিয়ে আসেন মুসলিম প্রতিবেশীরা। সংক্রমণ ভয় উড়িয়ে তারা হাজির হন মৃতের বাড়িতে। নিজেরাই খাট বেঁধে, ফুল মালায় দেহ সাজিয়ে কাঁধে তুলে নেন। চার মুসলিম প্রতিবেশীর কাঁধে শেষযাত্রা হয় ওই হিন্দু বৃদ্ধের।

যাবতীয় আয়োজন এবং শ্মশানের কাঠও জোগাড় করেন মুসলিমরা। দাহ করা পর্যন্ত সদ্য পিতৃহারা ছেলের পাশে ছিলেন তারা। করোনাকালে মানবিকতার প্রকৃত মুখ ও মুখোশ চেনা সম্ভব হলো হুগলিতে। মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ঈদও সম্প্রীতির ঈদে পরিণত হয়ে পরহিতের আদর্শ স্থাপন করলো পশ্চিমবঙ্গে।

অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের আগে ভারতের বিভিন্নস্থানে করোনার চলমান চরম দুর্যোগকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেছে।   দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের হিন্দু অধ্যুষিত ও বিশিষ্ট মন্দিরের জন্য বিখ্যাত তিরুপতি শহরে কোভিডে মৃত রোগিদের অন্তিম সৎকারের কাজে হাত লাগিয়েছেন মুসলিমগণ। অরাজনৈতিক, ইসলাম প্রচারমূলক তবলিগ জামাতের সদস্যরা ভারতের চরম করোনা মহামারির সঙ্কুল পরিস্থিতিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মৃতদেহ সৎকার করছেন।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুরুত্ব পাওয়া খবরে প্রকাশ, যখন আত্মীয়-পরিজন ভাইরাসের ভয়ে লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে কিংবা শত শত মৃতদেহ সামাল দেওয়ার মতো উপযুক্ত জনবল পাওয়া যাচ্ছে না, তখন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে মুসলিম তবলিগ জামাত 'সৌহাদ্যপূর্ণ মানবিকতার' উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। করোনায় জর্জরিত ভারতে এমন উদাহরণ দেশটির উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা ও পরমতসহিষ্ণুতার আদর্শকে উচ্চকিত করেছে।

অথচ গত বছর (২০২০) করোনা পরিস্থিতির শুরুতে তবলিগ জামাত ইসলাম প্রচারের নিয়মিত সংঘবদ্ধ কাজের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। এমনকি, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ‘অপরাধী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছিল তবলিগের গায়ে। দেশদ্রোহ এবং খুনের মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে।

সেই বিতর্ক পিছনে ফেলে কোভিডে মৃতদের সৎকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুন্নি ইসলামি সংগঠন তবলিগ জামাত। এক চিতায় ১০ জনের দেহ তোলার পরিবর্তে ধর্মীয় আচার মেনে যাতে প্রত্যেক কোভিড রোগির সৎকার করা যায়, সেই কাজে ধর্মীয় রীতি ও মৃতদেহের সম্মান বজায় রেখে হাত লাগালেন মুুুুসলিমগণ।

প্রকাশ, গত এপ্রিল মাসে সেখানে দৈনিক প্রায় ১৫টি করে শব দাহ করেছেন তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা। আর মহামারির একেবারে সূচনা পর্ব থেকে সবমিলিয়ে ৫৬৩টি শব দাহ করেছে তবলিগ জামাত। শুধু এই কাজের জন্যই তিরুপতি ইউনাইটেড মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে কোভিড-১৯ জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি (জেএসি) গঠন করেছে তারা।

তবলিগ জামাতের সক্রিয় সদস্য জেএমডি গাউস বলেন, ‘গত বছর মহামারির দায় আমাদের উপর চাপানো হয়েছিল। আর এখন আমাদের প্রশংসা শুনছি।’ তিনি জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তিরুপতিতে তাঁদের ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক তিনটি আলাদা আলাদা দল গড়ে কাজ করছেন। এপ্রিল মাসে এই প্রত্যেকটি দলই কমপক্ষে ১৫টি করে শব দাহ করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

জেএমডি গাউস আরও জানিয়েছেন যে, আগে বয়স্কদের শবই বেশি আসত। এখন অল্পবয়সিদের দেহও দাহ করতে হচ্ছে। পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। হিন্দু, মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান— ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী রীতিনীতি মেনেই দেহ সৎকার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তবলিগ জামাত কর্তৃপক্ষ।

বাইরের কোনও সাহায্য না নিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদেরই পিপিই কিটের ব্যবস্থা করছেন মুসলিমগণ। তবে মুসলিম না হয়েও বেশ কিছু যুবক তাদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগিয়েছে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর