মোদি যুগের কি শেষের শুরু, তার পথ দেখাবে বাংলা?

ভারত, আন্তর্জাতিক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কলকাতা | 2023-08-28 01:19:44

গোটা ভারতে সব রাজ্য মিলিয়ে ভ্যাকসিনের জন্য এখনও অব্দি মোদি সরকারের বরাদ্দ মাত্র ৩৫ হাজার কোটি রুপি। আর শুধু পশ্চিমবঙ্গ দখলের জন্য খরচ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি রুপি। তবে ভোটতো শুধু বাংলায় ছিল না। ছিল আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালা, পদুচেরী -এই চার রাজ্যেও। ওই চার রাজ্যে বিজেপির ভোটের ব্যয়ের অঙ্কটা না হয় বাদই থাক। তবে এরই নাম কি নরেন্দ্র মোদির -সবকা সাথ সবকা বিকাশ?

২রা মে ফল প্রকাশের পর সেই প্রশ্নটাই আরও শক্তিশালী হচ্ছে ভারতীয়দের মনে।

সাধারণ ভারতবাসীর এখন প্রশ্ন, ওই ৩০ হাজার কোটি রুপির উৎস কী? সাদা নাকি কালো? ভারতে নোট বাতিল, প্রথম লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাহাকার, করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনের অভাব, দেশজুড়ে মৃত্যুর মিছিল, ফের লকডাউনের হাতছানি, তখনও মোদি-অমিত শাহের জুটি কেনও মশগুল ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দখলে?

কিন্তু সবই শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে গেল। অথচ ওই ৩০ হাজার কোটি রুপির অর্থায়নে ভারতে কত কিছুই না করা যেত। কত প্রাণকে অক্সিজেন দেওয়া যেত, কত মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে মরণ রোগ থেকে বাঁচানো যেত। হাসপাতালে বেড বাড়ানো যেত, নতুন নতুন হাসপাতাল গড়া যেত, গবেষণায় ব্যয় করা যেত, ওষুধ, প্রতিষেধকের জন্য চাতকের মত ভিন দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউও কত মানুষ কাজ হারিয়ে বাসার অন্ধকার কোণে হারিয়ে গিয়েছেন। তাও তো তাদের জানা ছিল। এত সব জেনেও তবু বাংলা দখলে মোদির মরিয়া চেষ্টার খুব কি দরকার ছিল?

দেশ শাসন ভুলে পশ্চিমবঙ্গে এত জনসভা, এত রোড শো, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। অপরদিকে বাংলায় একের পর এক চার্টার্ড বিমানকে জায়গা দিতে একসময় হিমশিম খেতে হয়েছে কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। সবমিলিয়ে প্রায় দু’শো বিমান ও হেলিকপ্টারকে কাজে লাগানো হয়েছে। যা আগে কখনও বাংলার ভোট ঘিরে এত সংখ্যক চাটার্ড প্লেন, প্রাইভেট জেটের ভিড়ে দেখা যায়নি। যেমন এর আগে দেখা যায়নি শুধু ভোটের জন্য আন্তর্জাতিক মানের মিডিয়া সেন্টার গড়া। শহরের একাধিক পাঁচতারা হোটেলে সম্মেলন, সেমিনার। ছোটবড় সব নেতাদের জন্যও শহরের বুকে যেখানে সেখানে তৈরী হওয়া হেলিপ্যাড, রোড শো, নেতা কিনতে খরচ দেদার রুপি উড়েছে।

শহর ও শহরতলির বিমানবন্দর লাগোয়া সব পাঁচতারা, তিনতারা হোটেল মাসের পর মাস বুক ছিলো নেতাদের জন্যে। এর ওপর তাদের স্বাগত জানাতে বস্তা বস্তা ফুল, আধুনিকমানের মঞ্চ, দামি ছাউনি, সভা পিছু কয়েকশো মাইক সবমিলিয়ে ছিল এলাহি কাণ্ড। এর পরও বাংলা আর মোদির দখলে এলো না। এই লজ্জাজনক পরিণাম নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। নিঃসন্দেহে বলা যায় মোদিকে একটা বড় শিক্ষা দিয়েছে বাংলা।

রাজ্যে ২৯৪টি আসনের মধ্যে প্রায় দেড়শো বিতর্কিত প্রার্থীকে টিকিট দেওয়া নিয়েও দলে অসন্তোষ শুরু হয়েছিল। চরম দ্বন্দ্ব লেগেছিল নব্য বিজেপি এবং পুরাতন বিজেপির মধ্যে। বাংলায় শক্তপোক্ত সংগঠন তৈরি না করে শুধু সকাল-সন্ধ্যা জিতে যাওয়ার মিথ্যে অভিনয়, রাজ্যটা যে ত্রিপুরা নয় তা তারা ভুলেই গিয়েছিল। পশ্চিমবাংলার আবেগ, সম্মান আঁচই করতে পারেনি হিন্দি বলয়ের বিজেপি। সেই সঙ্গে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বাসযোগ্য মুখ বা ভাবী মুখ্যমন্ত্রী মুখ। শোনা যায়, এই বিপর্যয়ের আগাম আঁচ তারা নাকি পেয়েছিল। ভোটের ফল বেরোনোর আগেই নাকি সতর্ক করেছিল সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স । হলও তাই।

ফলে ভোট কেন্দ্রে নেমেছিল তৃণমূলের সমর্থনে ঢল। ঢেলে ভোট দিয়েছেন বাংলার নারী শক্তিরাও। দ্বিতীয়ত, হিন্দিবলয়ের রাজ্যগুলোর মত বাংলায় মেরুকরণের তাস খেলতে গিয়ে জব্দ হয়েছে বিজেপি। মুসলিম ভোট একজোট হয়ে তৃণমূলের বাক্সেই পড়েছে। এমন-কী হিন্দু ভোটের মেরুকরণে করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মুসলিম-হিন্দু দু’তরফেই বাংলা থেকে প্রত্যাখাত করেছে নরেন্দ্র মোদিকে। এমনকী প্রগতিশীল সমাজ, বামপন্থীদের বড় অঙ্কের ভোটও বিজেপিকে ঠেকাতে মমতার নেতৃত্বেই আস্থা রেখেছেন।

ফলে এখনও সতর্ক না হলে আগামীতে দলটার আরও দুঃখ আছে বলে আন্দাজ করা যায়।

কারণ, গত নভেম্বর থেকে এখনও দিল্লির চারদিক ঘিরে হিন্দিবলয়ের চাষিরা কৃষক বিলের প্রতিবাদে বসে আছেন। তার উপর করোনায় অক্সিজেনের অভাবে স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদ। পশ্চিমবাংলার সাথে কেরালা এবং তামিলনাড়ুতেও হারতে হয়েছে। কয়েকদিন আগে উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েতও (গ্রাম্য ভোট) হাতছাড়া হয়েছে, রাজস্থানের স্থানীয় নির্বাচনেও ভরাডুবি, রাজ্যে রাজ্যে বাড়ছে অসন্তোষ। সবই কিন্তু একটু একটু করে ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধেই যাচ্ছে।

এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদাহরণ করে আগামীদিনের জন্য ভারতের সবস্তরের বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলো ফেল সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেছে। বিরোধীরা আবার একবার একত্রিত হলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাবর্তনও যথেষ্ট কষ্টকল্পিত হতে পারে। সেইদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক জয় দিয়েই মোদি যুগের শেষের শুরু বলা যেতেই পারে। এখন শুধু মমতাকে অনুসরণ করে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বিরোধী শক্তির সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার পালা। এবং সেই পথ দেখাতে পারে বাঙালির পশ্চিমবাংলা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর