করণ জোহরের ‘মাই নেম ইজ খান’ (২০১০) ছবির কথা ধরা যাক।
প্রধান চরিত্র রিজওয়ান খাঁন (শাহরুখ খান) অটিজমে ভোগে।
আলজিভ দিয়ে নিজের নামের শেষ অংশ ‘খাঁন’ উচ্চারণ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাকে।
উর্দুতে ‘খাঁন’-এর ‘খ’ আর ‘খোঁয়াব’-এর ‘খ’ শুনতে একই লাগে। দুটোই কণ্ঠনালী থেকে উচ্চারণ করতে হয়। তবে ‘খ’ অক্ষরের কিছু শব্দ থেকে এই ধ্বনি আলাদা। যেমন ‘খেল’ (খেলা)।
হিন্দি গানে ও সাহিত্যে উর্দু ধ্বনির ব্যবহার কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের প্রখ্যাত কবি গুলজার।
তিনি উল্লেখ করেন,
ভুল উচ্চারণের কারণে উর্দু ধ্বনিতে ‘দাওয়াখাঁনা’ (ফার্মেসি) শব্দ হয়ে যায় ‘দাওয়া খানা’। এর অর্থ কিছুটা আলাদা, অর্থাৎ ওষুধ খাওয়া।
বোঝা যাচ্ছে, উচ্চারণের দিক থেকে উর্দু ও হিন্দির মধ্যে অনেক পার্থক্য।
কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর উর্দু উচ্চারণের নিয়ম অনুযায়ী ‘খ’ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন।
‘মুঘল-এ-আজম’ (১৯৬০) ছবির ‘খুঁদা নিগেহবান হো তুমহারা’ গানটি শুনলেই তা বোঝা যায়।
যদিও তার মাতৃভাষা মারাঠি।
উচ্চারণের প্রভাব
লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে লেখা একটি গ্রন্থে ভারতীয় কথাশিল্পী নাসরীন মুন্নি কবিরের বর্ণনা থেকে উর্দু উচ্চারণের তাৎপর্য বোঝা যায়।
মারাঠি ভাষাভাষির মানুষ লতা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে উর্দু শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না। এসব শব্দ কতটা জটিল তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই উর্দু শেখার মনস্থির করেন।
লতা স্মৃতিচারণ করে জানান, ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ ছবির ‘আয়েগা আনে ওয়ালা’ গানের রেকর্ডিং শেষ করার পরের ঘটনা। তখন তার প্রশংসা করেন অভিনেত্রী নার্গিসের মা কণ্ঠশিল্পী জাদ্দানবাই। তার মন্তব্য ছিল, উর্দু শব্দ ‘বেগায়ের’ (বাংলা অর্থ ব্যতিত) যথাযথভাবে উচ্চারণ করতে পেরেছেন লতা।
লতার বোন ভারতের আরেক বিখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলে মনোমুগ্ধকর গায়কীতে কয়েক প্রজন্মকে মোহাবিষ্ট করেছেন। হিন্দি গানে ও সুরে উর্দু ধ্বনি উপেক্ষিত থাকায় হতাশা ঝরলো তার কণ্ঠে।
আশা ভোঁসলে বলেন,
‘এখনকার শিল্পীরা হিন্দি জানে না। একইভাবে তাদের উর্দু জ্ঞানের অভাবও উদ্বেগজনক। এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো।’
পুরনো দিনে শুধু গায়ক-গায়িকারাই উর্দু দীক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন তা নয়, সংগীত পরিচালকরাও এদিক দিয়ে সচেতন ছিলেন। তারা সব গানেই মান ধরে রাখার ব্যাপারে কোনও আপস করতেন না।
লতার ৭০তম জন্মদিনে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে সুরস্রষ্টা নওশাদ বলেছিলেন,
‘মেহবুব সাহেব (প্রযোজক মেহবুব খান) আমাকে আগেভাগে জানিয়েছেন, লতা মঙ্গেশকর মারাঠি মেয়ে। তার উচ্চারণ সঠিক হয় না। অথচ তাকে দিয়ে গজল গাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তিনি ঠিকই যথাযথ উচ্চারণে গাইতে পেরেছেন।’
বাঙালি সংগীতশিল্পী মান্না দে শুরুর দিকে উচ্চারণগত সমস্যায় পড়তেন। কারণ উর্দু ধ্বনির কোনও অস্তিত্ব নেই বাংলায়। উচ্চারণ কেনো গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ে তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন সংগীত পরিচালক সি. রামচন্দ্র। তার সুরে কোনও শব্দই ভুল উচ্চারণে গাওয়া যেতো না।
পরিবর্তনের সূত্রপাত
ষাটের দশক থেকে শুরু করে ২০১০ সাল ও পরবর্তী সময়ে বলিউডের গানে ভাষাগত পরিবর্তন বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে। এগুলোতে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে হিন্দি গানের উচ্চারণ থেকে উর্দু ধ্বনি ‘খঁ’, ‘ঘঁ’ ও ‘কঁ’ উহ্য হয়ে গেছে।
ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস জয়ী গানগুলো নিয়ে একটি সংকলন করলেই বোঝা যাবে। সেই ‘ইয়াহুদি’ (১৯৫৮) থেকে ২০১৪ সালের ‘তালাশ: দ্য অ্যানসার লাইস উইদিন’ পর্যন্ত ২২৬টি গান পাওয়া যাবে। ভিন্ন ভাষাভাষির ৪৪ জন কণ্ঠশিল্পী এগুলো গেয়েছেন।
আশির দশকের শেষ অবধি পর্যন্ত উর্দু ফোনেটিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিল্পীরা গাইতে পেরেছেন। হিন্দি ভাষায় কিংবা লোকজ চরিত্রের জন্য লেখা হলেই কেবল এর ব্যত্যয় ঘটতো।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,
‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১) ছবিতে গ্রামের অশিক্ষিত চরিত্র গঙ্গার জন্য মোহাম্মদ রফি গেয়েছিলেন, ‘ন্যায় লাড় জায়হে তো মানবান মান কাসাক হোইবে কারি’। এই গানে ‘রোজগার’ (কাজ) ও ‘গজল’ শব্দের উচ্চারণে উর্দু ধ্বনি রাখা হয়নি।
হতাশার কথা হলো, নব্বই দশকের পর থেকে বলিউডে যেসব গান হয়েছে, সেগুলোতে পুরনো দিনের মতো একই মানের উচ্চারণ পাওয়া যায়নি।
গায়িকারা হিন্দি ফোনেটিক নিয়মেই মূলত গান করেন এখন। শ্রেয়া ঘোষাল যেমন ২০১২ সালে ‘বরফি’তে উর্দু শব্দ ‘শাখেঁ’ (শাখা) ও ‘খঁরচা’ (ব্যয়) গেয়েছেন ‘শাখে’ ও ‘খরচা’।
একইভাবে শঙ্কর মহাদেবার সঙ্গে শ্রেয়া ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবির ‘নূর-এ-খুঁদা’ ও এই গানে ‘খোঁয়াবো’ (স্বপ্ন) শব্দটি হিন্দি ফোনেটিক নিয়মেই উচ্চারণ করেছেন।
আরেকটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,
‘আন্দাজ’ ছবিতে কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া ‘কিসি সে তুম পেয়ার কারো’। এতে উর্দু ধ্বনি ‘কঁ’ ও ‘খঁ’র পরিবর্তে তারা উচ্চারণ করেছেন ‘ক’ ও ‘খ’। যেমন ‘ইকরার’, ‘খুশি’, ‘আশিকো’।
নব্বই দশকে উর্দু ধ্বনির উহ্য হয়ে যাওয়ার রীতি শুরু হয়। তখন চাঙ্গা হয়ে ওঠে হিন্দুত্ব রাজনীতি। একইসঙ্গে ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো পরিণত হতে থাকে ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানে।
সাধারণভাবে এই উধাও হওয়াটা ভারতে উর্দু ভাষাকে প্রত্যাখ্যানের প্রতিফলনও হতে পারে।
প্রবীণ লেখক, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও সংগীত পরিচালকদের দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ার কারণেও উর্দুর দৈন্যদশা তৈরির আরেকটি কারণ। তারা বেড়ে উঠেছিলেন উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতিতে।
কিন্তু ভারতে এখন নতুন প্রজন্ম পড়াশোনা করে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায়। উর্দু ভাষায় আগ্রহ জন্মানোর মতো তাদের জন্য তেমন কিছুই নেই।
এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী একাধিক কারণ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে সন্দেহ নেই, বলিউড অভিধানের বাগ্বৈশিষ্ট্যের অন্তঃসার হলো উর্দু। কিন্তু ধীরে ধীরে তা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।