করোনার ধাক্কায় বিশ্বে আসতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা

, অর্থনীতি

ড. মো. কামাল উদ্দিন, অতিথি লেখক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 22:23:23

করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব  ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে কেমন প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে চলছে মতামত ও অনুমান। গুরুত্ব পাচ্ছে করোনার কারণে রাজনৈতিকভাবে পৃথিবীর পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনীতির পালাবদলের প্রসঙ্গও।

এক সময় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নির্ধারকের উপর নির্ভরশীল ছিল। ক্ষমতা দখল করার মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিকে দখল করা হতো। কিন্তু বর্তমান দুনিয়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক নির্ধারকের উপর বা রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল নয় । অর্থনৈতিক ক্ষমতা একটি বড় নির্ধারক। 

একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে  নিয়ন্ত্রণ করতে হলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার  নিয়ন্ত্রণ যার বা যাদের হাতে থাকে, তারাই হয় বিশ্বের হর্তাকর্তা। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সাজানোর জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার তাত্ত্বিকগণ যে ধরনের প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, সে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করেন।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিকে এমন ভাবে দেখা হতো যে সম্পদ কখনো তৈরি করা যায় না, সম্পদ দখলে নিতে হয় । সম্পদ দখলে নেয়ার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিশ্বের ছোট ছোট ও দুর্বল দেশগুলোকে বছরের-পর-বছর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কলোনি করে রাখতে।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে দেয় এবং নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধারণার জন্ম লাভ করে।  উদ্যোক্তা তৈরি, নতুন বিনিয়োগ, বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, মুক্তবাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও মুক্ত বাণিজ্যের ফলে পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অনেক শক্তিশালী করে তুলেছে।

এখন প্রশ্ন জেগেছে করোনাভাইরাসের ফলে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কতটুকুই কার্যকর থাকবে এবং করোনাভাইরাসের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কী পরিমাণ প্রভাব ফেলতে পারে?

করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর চাপ তো হবেই,  কিন্তু সুনিশ্চিত করে বলা যায় না যে, তা কী পরিমাণ হবে। তা নির্ভর করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কত দীর্ঘস্থায়ী হবে তার ওপর। তবে এটি সুনিশ্চিত করে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা গভীর ও দীর্ঘতর হতে পারে।

আমরা যদি বর্তমান পরিস্থিতির তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো যে, বিশ্ব বাণিজ্য এখন প্রায়-নেই বললেই চলে। করোনাভাইরাসের মহামারি এবং এর সাথে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা নিশ্চিত ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ মন্দা আরো বেশি স্থায়ী হতে পারে। বেশি পরিমাণ শাস্তিদায়ক হতে পারে। এ মহামারী একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তীব্রতর। তাই বিভিন্ন দেশের সরকার নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও ভয় ভোক্তা, উদ্যোক্তা, শ্রমিক প্রত্যেকের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে বিচ্ব অর্থব্যবস্থাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির বর্তমান রূপ জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা থেকে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে গেছে, যা মানুষের মিথস্ক্রিয়ায় বিপদজনক থেকে বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারবে না। আশঙ্কা করা যায় যে, ব্যবসা  আগে যে ধরনের স্বাভাবিক ছিল তা ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে।  কারণ ভাইরাস-পরবর্তী সময়ে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে ব্যাপক কর্ম-জনশক্তির মধ্যে ভিড়, মল, রেস্তোরাঁ, লোকসমাগম যেখানে বেশি, সেখানে কাজ করাকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ভীতিকর হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখে দেখা যাচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিকভাবে বিশ্ববাণিজ্যের উপর চরম আঘাত নেমে এসেছে। বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ প্রায়-বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।  ফলে পৃথিবীর প্রত্যেকটি অঞ্চলের একটি অর্থনৈতিক ব্যথা শুরু হয়েছে। সকলের দুশ্চিন্তা এটাই যে, এই অর্থনৈতিক ব্যথা কতটুকু গভীর হবে এবং  কীভাবে এ থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। কিন্তু এ সংকট ও ক্ষত থেকে পুনরুদ্ধার পেতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোকেও চরমভাবে হিমশিম খেতে হতে পারে। কোন দেশকে তারা ঋণ দিবে, সাহায্য-সহযোগিতা করবে, তা নিয়েও গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। কারণ, তাদের ঋণও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। যেমনভাবে অতীতে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় তাদের ঋণ ঝুঁকিতে পড়েছিল, যা পরবর্তীতে আইএমএফ উদ্ধার প্যাকেজের মাধ্যমে মোকাবেলা করে।

করোনার জন্য আন্তর্জাতিক শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগকারীরাও মারাত্মক চাপের মধ্যে পড়েছে এবং শেয়ারবাজারে লাল বাতি জ্বলার অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এই সুযোগে, অভিযোগ আছে যে, শেয়ার মার্কেটের একটি বড় অংশ চীন কিনে নিচ্ছে। হারবার্ট অর্থনীতিবীদ Kenneth S. Rogoff-এর দৃষ্টিতে 'যদি করোনাভাইরাস দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই এর ফলে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে, তা হবে অতীতের সমস্ত সংকটের থেকে ভয়াবহ এবং এটি সমস্ত আর্থিক সংকটের জননী হয়ে উঠবে।'

ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে, যার ভয়াবহতা হবে অতীতের চেয়ে তীব্র। এ দেশগুলো বাজেটের একটি বড় অংশ নির্ভর করে বৈদেশিক সহযোগিতা ও বৈদেশিক ঋণের উপর। করোনা-পরবর্তী সময়ে এমন এক ধরনের স্থবির ও বিশ্বাসহীনতার অর্থনীতিক সম্পর্ক তৈরি  হতে পারে, যাতে নিজের চিন্তার বাইরে এসে কেউ কাউকে সহযোগিতা করার মানসিকতা দেখানোর মতো সাহস করবেনা। তখন ঋণগ্রহণ প্রতিযোগিতা তৈরি হবে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের চাহিদ পূরণ করতে হিমশিম খাবে।

একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত বেকারত্ব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  শিল্প দুর্বল অবস্থায় পতিত হতে পারে, বিনিয়োগ ও ব্যবসার নতুনত্বের ধারণা হ্রাসের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে যাবে বাধ্য হয়েই।

তবে, বিশ্বে যদি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে যায় বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, যেভাবে চীন ইতোমধ্যে করেছে, তাতেও আগামী কয়েক বছর করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে বছরের পর বছর  ধরে। এতে চাপ পড়বে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর, যা শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চাপে পড়বে।

এ চাপ শুধু সুনির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠীর  উপর পড়বে না, পৃথিবীর প্রতিটি বাসিন্দা এর ফলে সমস্যায় পড়তে পারে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ  অন্যান্য উন্নত দেশগুলো এর ধাক্কা কতটুকু সামলাতে পারে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। পৃথিবীর সকল দেশেই যখন অর্থনৈতিক সমস্যায় পতিত হবে  চীন এককভাবে কীভাবে তাদের অর্থনীতি পরিচালিত করবে, সেটি নির্ভর  করছে তাদের  আচরণ ও দক্ষতার উপর। যখন চীনে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়, তখন চীন অর্থনীতির জন্য এটিকে বড় হুমকি হিসেবে দেখে ঐ সময়েই। এতে জেনারেল মোটর, আপেলের মত বড় কোম্পানিগুলো মারাত্মক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে চাইনিজ ব্যবহারকারীর ক্ষেত্র।

এটা অনুমান করা যাচ্ছে যে, করোনা-পরবর্তী উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ এবং আমেরিকার  অর্থনীতিতে মারাত্মক ধাক্কা লাগবে। আইএমএফ ইতোমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছে যে, করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। বেকারত্ব বাড়বে চরম মাত্রায় এবং অনেকে না খেয়ে মরার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও আইএমএফ স্বীকার করেছে। আইএমএফ'র ধারণা, ১৯৩০ সালের পরে করোনা-পরবর্তীতে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে চরম মাত্রায় পৌঁছবে।

করোনার কারণে ইতোমধ্যে আমেরিকাতে এক কোটি আটষট্টি লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছে। কর্ম হারানোর আশঙ্কা রয়েছে আরো অনেকের। তবে করোনা সংকট কেটে গেলে মার্কিন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোন ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহের সহযোগিতার ফলে তাদের অর্থনৈতিক ঝুঁকি হয়তো কিছুটা কমে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর গার্মেন্টস শিল্পের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে যা দেশীয় অর্থনীতিকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলবে। কারণ, ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা ও শিল্পের মালিকদের কী পরিমাণ ঋণ দিতে পারবে ও সরকারিভাবে কি পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনা দিতে পারবে, তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

অনেকেই আবার করোনাভাইরাসের ফলে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে তা একটি সাময়িক সংকট হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা মনে করেন, করোনাভাইরাসের ফলে সামান্য অর্থনৈতিক বিরতি তৈরি হবে এবং যখন প্রাদুর্ভাবে থেমে যাবে অর্থনৈতিক যন্ত্রটি  তখন আবার থাকবে এবং কিছুদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে এটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করবে একটি কার্যকর উদ্ধার প্যাকেজ উপর। কিভাবে এই সংকট থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করা যায় সেই জন্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনগুলো ব্যাংক, উদ্যোক্তা এবং দেশগুলোর কী পরিমাণ উদ্ধার প্যাকেজের নিশ্চয়তা রয়েছে তার উপর।

অনেকে আবার এ সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি খরচ, নাগরিকের সুযোগ সুবিধা অর্থাৎ ব্যয় সংকোচ নীতি গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই ব্যয় সংকোচ নীতি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তাও একটি ভাবনার বিষয়। তবে এটি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় করোনাভাইরাস উৎপাদকদের মানসিকতা নষ্ট করবে, মানুষের কর্মদক্ষতা হারাবে, হতাশা তৈরি হবে। আর সে হতাশা কেটে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর এর সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লাগবে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির উপর।

লেখক: ড. মো. কামাল উদ্দিন, প্রফেসর সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর