দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি। প্রাকৃতিক এ জিনিসটি উঠে আসে যে নারীদের হাত স্পর্শ করে- সেই নারীরাই আজ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। নারী চা শ্রমিকদের আবাসন সংকট, উপযুক্ত চিকিৎসা, কর্মক্ষেত্রে সুযোগসুবিধার অভাব, সঠিক মজুরি প্রদান প্রভৃতি সমস্যাগুলো দূর হয়নি আজও। অভাব-অনটন আর দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে আজ চলতে হয় চা বাগানের প্রায় প্রতিটি নারী শ্রমিকদের।
সকালটা ফুটে উঠতেই কাজের তাগিদ পড়ে যায় এ সকল চায়ের নারীদের। প্রথমে সংসারের টুকিটাকি কাজ। তারপর পাতা উত্তোলনের কাজে চলে যাওয়া। ঘরের নানা কাজগুলো সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে হয় তাদের।
‘কেমন আছেন?’ -নারী চা শ্রমিকদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট চা বাগানে গিয়ে কথা হলো পূর্ণিমা বাকতি, সন্ধ্যা ভূমিজ, শিলা গোয়ালা, অলকা বাকতি, শোভা নায়েক প্রমুখের সাথে।
পূর্ণিমা বাকতি ও সন্ধ্যা ভূমিজ বলেন, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমরা পাতা তোলার কাজ করি। সিজনে সকাল ৭টা দিকে যেতে হয়। আমরা দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা করে পাই। যে মজুরি পাই তাতে আমাদের চলে না বাবু। বর্তমান বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে কুলাতে পারি না।
অলকা বাকতি এবং শোভা নায়েক বলেন, উৎসব ছুটির সময় কাজ করতে আমাদের দৈনিক মজুরি দ্বিগুণ দেয়ার কথা থাকলেও তাও দেয়া হয় না বলে জানান তারা। ঠিকা দফা এবং স্থায়ী দফার শ্রমিকদের মজুরি এক হওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়না।
বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য এবং চা শ্রমিক সন্ধ্যা ভূমিজ বলেন, এখন আমাদের বড় সমস্যা হলো কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাঁধার মুখে পড়তে হয়। একেকটি সেকশনে (পৃথক পৃথক আবাদ) বৃষ্টির সময় ছাউনি থাকে না। ফলে বৃষ্টি গায়ে মেখেই কাজ করার ফলে আমাদের ঠান্ডাজনিত রোগ হয়।
বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি জগৎবন্ধু বলেন, বর্তমানে নারী চা শ্রমিকরা নির্ধারিত ২৪ কেজি করে চা পাতা উত্তোলনে ১২০টাকা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন। প্রতি কেজির মূল্য পড়ে ৫ টাকা। এখন কোনো শ্রমিক যদি নির্ধারিত ২৪ কেজি চা পাতা তোলার পর বাড়তি আরো ১০ কেজি পাতা তুলেন তাহলে তাদের মজুরি ১২০টাকার সাথে বাড়তি ১০ কেজির সাথে সাড়ে ৪ টাকা করে কেজি প্রতি মূল্য যোগ করে মজুরি দেয়া হয়।
কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের চুক্তি মোতাবেক একজন নারী চা শ্রমিক যদি দৈনিক ২৪ কেজির বেশি পাতা তুলেন তাহলে বাড়তি চা পাতা উত্তোলনের জন্য পূর্বের নির্ধারিত মজুরির দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রায় ১০ টাকা করে কেজি প্রতি দেয়া কথা থাকলেও দেয়া হয় কেজি প্রতি সাড়ে ৪টাকা করে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরি বলেন, ‘নারীদের আমাদের স্পেশাল যে বিষয়টি রয়েছে সেটি হলো, আমরা চা বাগানের নম্বরগুলোতে নারী চা শ্রমিকদের জন্য শৌচাগার এবং প্রক্ষালন কক্ষ নেই। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মারাত্মক অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেবার জন্য বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা জোর দাবি জানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নারী চা শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের জন্য আমরা প্রতিটি বাগানে ‘মহিলা টিলা ক্লার্ক’ এবং ‘মহিলা সর্দার’ নিয়োগের আবেদন জানিয়েছি। কিছু বাগানে অবশ্য মহিলা সর্দার রয়েছে। কিন্তু মহিলা টিলা ক্লার্ক কোনো বাগানেই এখন পর্যন্ত নেই।’
বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) এর তথ্য মতে, ব্রিটিশ আমলে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে চা চাষের শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। বর্তমানে দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এসব বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার। আর অনিবন্ধিত শ্রমিক আরও প্রায় ২৫ হাজার কাজ করেন। এর মধ্যে নারী চা শ্রমিক রয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ ভাগের উপরে।