এই শীত মৌসুমে হঠাৎ দেখা যায় - চা বাগানের কোনো কোনো অংশে ডালপালা নেই! এ দৃশ্য দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যান- এ আবার কী! চা বাগানের সবুজপাতারা তবে গেলো কই?
সবুজ পাতারা উধাও হয়ে ধারণ করেছে পত্রহীন ধূষর রঙ। এ রঙের ব্যাপ্তি দিগন্ত বিস্তৃত। একেকটি চা গাছে এখন শুধুমাত্র কয়েকটি সবুজ-পাতাহীন ডাল। ওভাবেই ওরা টিলাময় প্রতিটি প্রসারিত অঞ্চলজুড়ে আছে।
চা গাছের সুস্থতার জন্য সেই সবুজকে কেটে ফেলা হয়েছে। তবে এই কর্তন গাছের ক্ষতি করার জন্য নয়। বরং পুরোপুরি উপকার করার জন্য। এভাবে কেটে ফেলার এই পদ্ধতিকে ‘প্রুনিং’ বা ‘কলম করা’ বলে।
এটি বাৎসরিক চা বাগানের প্রুনিং কার্যক্রম। প্রুনিঙের পর চা গাছগুলো বৃষ্টির জন্য অপেক্ষামুখর। প্রাকৃতিক বৃষ্টির পরশ পেলেই কুঁড়ি ছাড়তে শুরু করবে প্রুনিংকৃত অংশ থেকে। চা গাছের ফলন ব্যবস্থাপনার নির্দিষ্ট মাপঝোক মেনে চলে প্রতিটি চা বাগানে এই প্রুনিং কার্যক্রম।
বাংলাদেশীয় চা সংসদ (বিসিএস) সিলেট ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র টি-প্লান্টার জিএম শিবলি বলেন, এখন চা বাগানগুলোতে উইন্টার ক্লিনিং (শীতকালীন পরিচর্যা) চলছে। এটাকে চা গাছের শীতকালীন সেবাশুশ্রুষাও বলা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, বৃষ্টি হলেই ওই প্রুনিং করা ডালগুলোতে কুঁড়ি ছাড়বে। তবে এর জন্য প্রাকৃতিক তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে হবে। তা না হলে কুঁড়ি ছাড়তে দেরি হবে। এখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস যাচ্ছে। আশা করা যায়, কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের তাপমাত্রা ৩০/৩৫ ডিগ্রিতে পৌঁছবে এবং বৃষ্টির পরশ পেয়ে কুঁড়িরা বের হবে।
চা বাগান সম্পর্কে জিএম শিবলি বলেন, শীতকালীন পরিচর্যার পাশাপাশি চলছে ইউডিং অর্থাৎ খুরপি বা মাটি নিড়ানো। এরপর মার্চিং অর্থাৎ মাটি আচ্ছাদন করা। যেন চা বাগানের গুড়ির পানি বাষ্প হয়ে চলে না যায়। মাটির গাছের গোড়াকে সবুজ পাতা বা কচুরিপানা দিয়ে আচ্ছাদন করা বা ঢেকে রাখা।
এরপর রয়েছে আগুন থেকে চা বাগানগুলোকে দূরে রাখার জন্য চা বাগানে ২৪ ফুট চওড়া করে এটা ফায়ার লাইন কাটা হয়। ধরুন, চা বাগানে আশপাশে একটা জঙ্গল আছে। ওই জঙ্গলটাকে চা গাছগুলো থেকে ২৪ ফুট দূরে রাখতে হবে। এটাকে বলে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইন কাটা। তারপর পরের কাজ হলো ক্লোন নার্সারির ব্যাগে মাটি ভরাট করা। সব শেষের কাজটি চা বাগানে শিশু চারাগুলোতে ইরিগেশন (সেচ) দেয়া বলে জানান তিনি।
চা গাছের কলমপদ্ধতি সম্পর্কে এই জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক বলেন, মনে রাখবেন, প্রুনিং (কলম) আবার চা বাগানের সব সেকসনে (সুনির্দিষ্ট এলাকা) হয় না। প্রুনিঙের চার রকমের পদ্ধতি আছে। যেগুলো যথাক্রমে: ১) লাইট প্রুনিং (এলপি) বা ‘হালকা কলম’। মাটি থেকে চা গাছগুলোকে ২৬ ইঞ্চি উচ্চতার মধ্যে কাটতে হবে। ২) এলপির পর ডিএসকে অর্থাৎ ‘গভীর ছাটাই’ এলপি দাগ থেকে ৪ ইঞ্চি উপরে কাটতে হয়। এছাড়াও রয়েছে ৩) মিডিয়াম স্কিপ (এমএসকে) অর্থাৎ ‘মধ্যম ছাটাই’ এবং ৪) লাইট স্কিপ (এলএসকে) বা ‘হালকা ছাটাই’।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট উচ্চতায় চা গাছের পাতা ও ডাল ছাটাই করাকে প্রুনিং বলে। চা চাষে প্রুনিং একটি অন্যতম প্রধান কৃষিতাত্ত্বিক কার্যক্রম। কারণ, এটি চায়ের মান ও ফলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। চা গাছকে দীর্ঘদিন সজীব, সতেজ এবং লাভজনকভাবে উৎপাদনক্ষম রাখতে এই প্রুনিং এর ভূমিকা অপরিসীম।
প্রুনিং চা গাছের সুস্বাস্থ্যের জন্য করা হয়। এটার অনেক পজেটিভ দিক আছে। আমাদের প্লাকিং (পাতা চয়ন) এর সুবিধার জন্য এটিকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় রাখতে হয়। প্রুনিঙের পদ্ধতিকে আমরা ‘ফোর ইয়ার সার্কেল’ বলি। চার বছর মেয়াদে বিভিন্ন উচ্চতায় একেক সেকশনের চা গাছগুলোকে একক সীমারেখায় কাটা হয়। এর কাটা অংশগুলো মাটিতে পড়ে মাটির ফার্টিলিটি (উর্বরতা) বাড়ায় বলে জানান বিটিআরআই পরিচালক।