ভোট বন্ধ, নেতারা নেই করোনায় বিপন্ন মানুষের পাশে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-30 16:26:13

করোনাভাইরাস আক্রমণ না করলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হতো না, যথারীতি অনুষ্ঠিত হতো পূর্বনির্ধারিত ২৯ মার্চেই। এরই মধ্যে ফলাফল পেয়ে বিজয়ীদের উল্লাস ও আনন্দ মিছিল শুরু হতো। পরাজিতদের আহাজারি ও ক্ষোভও শোনা যেতো নিশ্চয়। হয়ত কিছু হাঙ্গামা ও পাল্টাপাল্টি মারপিটও চলতো, যেমনটি ভোট শেষ হওয়ার পর সচরাচর হয়ে থাকে।

মোদ্দা কথায়, নির্বাচনের আগে যেমন, শেষেও বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীরা মাঠে থাকতেন। নিজ নিজ তৎপরতা ও প্রতিক্রিয়া জানাতে জনসংযোগ করতেন। ভোটারদের কৃতজ্ঞতা হয়তো জানাতেন। মোটের উপর তারা সরব ও সক্রিয় হয়েই ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতেন।

কিন্তু ভোট বন্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি ভোজবাজির মতো বদলে গেলো। ওয়ার্ডগুলোর শতাধিক প্রার্থী কর্পূরের মতো উবে গেলেন। তাদের সাঙ্গপাঙ্গ, সহযোগী নেতা, কর্মীদের বিরাট লটবহর নিমেষেই হাওয়া। করোনায় বিপন্ন মানুষের পাশে কেউ নেই। এটাই রূঢ় বাস্তবতা।

বিশেষত ভোটের বাজারে বস্তি ও নিম্ন আয়ের মানুষের জনবসতিতে যে চা-নাস্তা চলতো, সেটাও আর নেই। ভোট নেই তো খরচও নেই, এমনই বেনিয়া মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। অথচ করোনাভাইরাসের সঙ্গরোধের পরিস্থিতিতে খেটে খাওয়া এইসব মানুষের জন্যই সাহায্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

করোনার কারণে নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় এই সত্যটি প্রমাণ হলো যে, রাজনীতি বা নির্বাচন জনকল্যাণ বা জনমুখী চরিত্রে নেই। তা হয়ে গেছে 'বিনিয়োগ', লাভ বা স্বার্থ থাকলেই নেতৃবৃন্দ সে বিনিয়োগটি করবেন। এর সঙ্গে মানবসেবা, জনসেবার সম্পর্ক নেই! আছে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি।

অথচ নির্বাচন চলাকালে কত মধুর বচন, আশ্বাস, প্রেম, ভালোবাসার কথা প্রার্থীদের মুখ থেকে বের হচ্ছিল। স্ব স্ব প্রার্থীর পক্ষে নেতাকর্মীদের প্রীতিপ্রদ কথার ফুলঝুরিতে ভোটারদের ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রার্থী জনকল্যাণ আর মানবসেবার বিভিন্ন প্রকার প্রস্তাব ও উন্নয়নের ওয়াদা করছেন। জ্বালাময়ী মিছিল করছেন। আবেগপ্রবণ বক্তৃতা করছেন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে খরচাপাতিও করেছেন দেদার। চা, নাস্তা, হাতখরচের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ সাহায্য করছেন এবং নির্বাচনে জিতলে আরো সাহায্য করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। তখন ভোটের দরকার ছিল তাই টাকাও ঢেলেছেন তারা।

কিন্তু ২১শে মার্চ নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণার পর থেকে একটি-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া মাঠে-ময়দানে পাওয়া যাচ্ছে না বিশেষ কাউকেই। একই সঙ্গে তাদের মিছিল, মিটিং বন্ধ। এমনকি, নির্বাচন স্থগিতের সঙ্গে সঙ্গেই চা, নাস্তা, খাতির যত্ন এবং জনকল্যাণ ও মানবসেবায় দান-অনুদানের বিষয়েও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সোজা কথায়, ভোট বন্ধ, নেতারা নেই করোনায় বিপন্ন মানুষের পাশে! আবেগ, প্রেম, মায়াকান্না, আশ্বাস নেই। প্রকৃত সাহায্যের তো প্রশ্নই ওঠে না। যদিও এই বিপদে গরিব মানুষ ও সাধারণ ভোটারদের জন্য মানবিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।

এটা ঠিক যে, করোনাভাইরাসের আগ্রাসী থাবা থেকে বাঁচতে সবাইকে সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গরোধ ও ঘরবন্দী থাকতে বলা হয়েছে। নেতা, কর্মী, প্রার্থী, রাজনীতিবিদগণও এই বিধিবিধানের আওতাভুক্ত। তাদেরও প্রাণের ভয় আছে এবং প্রাণ বাঁচানোর পূর্ণ অধিকার তাদের রয়েছে। কেউ তাদেরকে প্রাণ বাঁচানোর পূর্ণ অধিকারকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে প্ররোচিত করছেনা। জানের বিপদ নিয়ে জনগণ ও সমাজের জন্য কাজ করতেও বলছে না।

যদিও ইতিহাস বলে যে জনগণ ও সমাজের স্বার্থে রাজনীতিবিদ, নেতা, কর্মীরা সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। জেল-জুলুম খেটেছেন। অর্থ-বিত্তের বিরাট অংশ মানুষের জন্য ব্যয় করেছেন। প্রয়োজনে জীবন বিপন্ন করেছেন।

এতোটুকু না করেও তো বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নেতারা কাজ করতে পারেন। নিরাপদে থেকেও তা পারেন। সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক দিতে পারেন। খাদ্যের সংস্থান করতে পারেন। গরিবের মধ্যে আর্থিক সাহায্য দিতে পারেন।

এজন্য নেতাদের করোনাভাইরাসের মুখোমুখি হতে বা নিজের নিরাপত্তা হারাতে হবে না। তবু তাদের অধিকাংশই জন ও সমাজকল্যাণে তৎপর হননি। মানুষের ঘোরতর বিপদের দুঃসময়ে সটকে গেছেন।

মানুষের সুসময়ে যারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এসেছিলেন এবং দুঃসময়ে গা ঢাকা দিয়ে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে সরে গেছেন, তারা তাদের রাজনৈতিক অভিভাবক ও প্রভুদের বিপদের সময় কতটুকু কাজে লাগবেন? তাদের চরিত্রের এই পলায়নি মনোভাব ও স্বার্থবাদীতা কেবল জনগণকেই নয়, তাদের সংশ্লিষ্টদেরও মনে রাখা দরকার। কারণ, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। আর একবার পলায়নকারী যে প্রয়োজনের সময় আবার পালিয়ে যাবে না, কে তার গ্যারান্টি দেবে!

 

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪ কম, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর