রেল দুর্ঘটনা: করণীয় কী?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-31 12:58:22

কসবার কাছে মন্দবাগ এলাকায় সম্প্রতি তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন নামক রেলগাড়ির মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষে ষোলজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আরো শতাধিক যাত্রী মারাত্মক আহত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। সংবাদে এই প্রথম জানা গেছে চালক নাকি সিগন্যাল অমান্য করে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি উদয়নের উপর সজোরে চালিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে দিয়েছেন। কিছুদিন যাবত প্লেন দুর্ঘটনা ও সিডিউল বিপর্যয় এবং বাসে চলাচলের রাস্তায় ভয়াবহ যানজট লেগে যাওয়ায় মানুষ অপেক্ষাকৃত সস্তা ও নিরাপদ মনে করে রেলপথকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি বেশ ঘন ঘন রেল দুর্ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ফলে মানুষ বেশ বিচলিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

দূরপাল্লার যাত্রায় এবার তাহলে উপায় ও করণীয় কী? বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার অবকাশও নেই।

কারণ, দেশে অনেক মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেসব মেগা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত সবাই। রেল উপেক্ষিত সেসব অর্থকরী বৃহৎ প্রকল্পের ভিড়ে। পুরনো রেললাইনের উপর নতুন কয়েকটি বগি কিনে রেলের চাকচিক্য বাড়ানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় বড়ই অপ্রতুল। ঢাকা সিলেট রুটে এখনও লক্কর-ঝক্কর মার্কা পুরনো বগিই ভরসা। কিছুদিন আগে শ্রীমঙ্গলের কাছে রেল ব্রিজ ভেঙে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

রেলপথ যে কোনো দেশে চলাচলের জনপ্রিয় উপায়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিবছর সামান্য ঘষামাজা ছাড়া রেলের ব্যাপক উন্নয়ন বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। এছাড়া দুর্নীতি ও অবহেলা যেন রেলের নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়েছিল। কালো বিড়াল ইস্যু, কন্টেইনারের মালামাল চুরি, বিনা টিকিটে ভ্রমণের প্রবণতা এখন কিছুটা কমে গেলেও অদক্ষ ও অপ্রতুল জনবল রেলের যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে আজও বড় অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

দক্ষ চালকের অভাবে একেকজন চালককে অনেক বেশি লোড নিয়ে রাত-দিন এক নাগাড়ে দায়িত্ব পালন করতে হয় বলে জানা গেছে। অনেক চালকের পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়ার ফুরসৎ নেই বলে জানা গেছে। সেটাও দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী।

সৌভাগ্যবান একজন বেঁচে যাওয়া যাত্রীর মুখে শোনা গেছে- ঘুমের মাঝে বিশাল এক শব্দ শুনে ও ধাক্কা খেয়ে ট্রেনটি যখন একলাফে দশহাতের সমান উঁচুতে উঠে গিয়েছিল তিনি ভেবেছিলেন কেউ বোমা মেরেছে। ছাদের সাথে ধাক্কা খেয়ে তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। তার পাশেই একটি তিন-চার বছরের মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করেছে সাহায্যকারীরা। উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধার করতে এসেছেন এটা বোঝার পর তিনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। এখন তিনি হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। তার মতো শত যাত্রীর করুণ অবস্থা এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতলে।

আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে এখনও গরিব যাত্রীরাই বেশি বেশি রেলপথে ভ্রমণ করে থাকেন। বিশেষ করে ভাড়া সস্তা হওয়ায় মেইল ট্রেনুগলো তাদের ভরসা। কিন্তু আন্তঃনগর ট্রেনের কিছুটা উন্নতি হলেও মেইল ট্রেনগুলো অবস্থা পূর্বের মতোই রয়ে গেছে। সেগুলোর সব পুরনো বগি বাতিল করে নতুন বগি সংযোজন করা দরকার। এছাড়া নিরাপদ ও নিরাপত্তা দুটো বিষয়কে মাথায় রেখে রেলের উন্নয়ন করা দরকার। তা হলো- রেলের সকল যাত্রীদের জন্য অচিরেই স্বাস্থ্যঝুঁকি বিমা ও ভ্রমণ বিমা চালু করা উচিত। এতে যাত্রীদের নিরাপত্তাবোধ বেড়ে গেলে যাত্রীসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাবে ও রেলের আয় বাড়বে।

রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থাকে অটোমেশন করতে হবে। বিশেষত জিআইএস-এর মাধ্যমে ট্রেন থামিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি আছে এমন ইঞ্জিন কিনতে হবে। বিদেশের মতো ড্রাইভার অসুস্থ হলে, দুর্ঘটনায় পতিত হলে অথবা ঘুমিয়ে গেলেও যাতে দূর-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ট্রেনটি থামিয়ে দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এছাড়া ক্রমান্বয়ে দেশের সব রেললাইনে আসা যাওয়ার পৃথক তথা ডাবল রেললাইন বসানোর ব্যবস্থা করা উচিত। রেলের ক্রসিং কমে গেলে যাত্রীদের সময় যেমন বাঁচবে তেমনি দুটো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমে যাবে।

রেল একটি যান্ত্রিক সেবামূলক কাজের ক্ষেত্র। এখানে ভারী যন্ত্রের ওপর জীবনের নিত্য চলাচল ঘটে। এখানে কাজে একটু অবহেলা করা মানে অনেক জীবন নিয়ে ছিনিমনি খেলার নামান্তর। তাই এই সেক্টরে কম মেধাবী ও অদক্ষ জনবল নিয়োগের কোনো ফুরসৎ নেই। রেল বিভাগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধমে নিয়োগ বন্ধ করলে দক্ষ ও মেধাবীরা এখানে চাকরির সুযোগ পেলে এর সেবার মান বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যথার্থ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুধুমাত্র কোর্স ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবীদের জটিল যান্ত্রিক সতর্কতামূলক কাজগুলোতে রেখে বাকিদের সরকারের কম সতর্কতামূলক অন্যান্য সেক্টরে বদলি করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এভাবে রেলের সেবার মান বাড়িয়ে এর সুনাম বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে।

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর