‘এত অসৎ জাতি নিয়ে বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়’

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-30 10:51:20

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল-আলম হানিফ। সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলেন। নিজেও সব সময় ফিটফাট থাকেন। গত প্রায় এক দশক ধরে গণমাধ্যমে তার বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির আয়োজনে ‘নারীর অগ্রযাত্রায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ: শেখ হাসিনার অবদান’ শীর্ষক এক সেমিনারে মাহবুবুল-আলম হানিফ বলেছেন, ‘আজ আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের মধ্যে নীতি, নৈতিকতা ও সততার সংকট। এত অসৎ জাতি নিয়ে বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়।’

হানিফ আরও বলেন, ‘আজ দেখুন নৈতিকতা কোন পর্যায়ে চলে গেছে। বালিশ কিনতেও দুর্নীতির কথা আসে। অবাক হতে হয় যখন দেখি একটি, সরকারি দফতরের ক্রয় নিয়ে দুর্নীতির কথা আসে। ইলেকট্রনিক্স জিনিস যার দাম ৭০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, তা উত্তোলনের জন্য খরচ দুই হাজার! কোন পর্যায়ে গেলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে।….’

‘প্রতিটি সেক্টরে আজ মানুষের যে অসততা দেখি, অনৈতিকতা দেখি, এরকম অসততা নিয়ে একটা দেশ খুব বেশি দূর এগোতে পারে না,’ যোগ করেন হানিফ।

তিনি বলেন, ‘দেখেন, আজ দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ। এই অসুস্থ মানুষের মধ্যে শতকরা ২৭ ভাগ কিডনি রোগী। বাকি ২৫ ভাগ মানুষ ক্যান্সারের রোগী। এর একটাই কারণ হচ্ছে আমাদের নীতিহীন, অসততা, অনৈতিকতা। আমরা খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছি। মাছে ফরমালিন দিচ্ছি। এসব করে একে অপরকে ঠকাচ্ছি।’

মাহবুবুল-আলম হানিফ যে কথাগুলো বলেছেন, তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথাগুলো নিরেট সত্যও বটে। আমরা জাতীয়ভাবেই বর্তমানে নীতি-নৈতিকতার ভয়ানক সঙ্কটে রয়েছি। বেশিরভাগ মানুষ চরম অসততাকেই জীবনের অলঙ্কার মনে করছেন। সারাক্ষণ কে কাকে ঠকাতে পারে সেই আয়োজন দেখি। খাদ্যে ভেজাল সত্যিই আমাদের জাতীয় জীবনে এক ভয়াবহ দুর্যাগ হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো জাতি আমাদের মতো খাদ্যে ভেজাল মেশায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর, ক্ষতিকর বিষাক্ত সব রাসায়নিক দ্রব্য খাদ্যসামগ্রীতে মেশানো হয়। এসব ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদানে ভরা খাবার খেয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজছে। নানা রোগ-ব্যাধি-জরা নিয়ে এক রুগ্ন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত রোজার মাসে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও দোকানদারকে মাঝে মধ্যে কিছু জেল-জরিমানা করছেন বটে; কিন্তু তাতে ভেজাল ও ক্ষতিকর বস্তু মেশানোর প্রবণতা দূর হচ্ছে না। আর এক মাসের এই পোশাকি আয়োজনে ভালো কিছু আশা করাও কঠিন। আসলে জনসচেতনতা এবং ব্যাপক, ধারাবাহিক ও কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া এই ব্যাধি দূর করা যাবে বলে মনে হয় না।

আর যেখানে লাভের আশা ষোলআনা, যে কোনো মূল্যে টাকা কামানোটাই জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কে আর সততার চর্চা করবে? শাক-সবজি-ফল, মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি যেহেতু দ্রুত পচনশীল, কাজেই এগুলোতে জনস্বাস্থ্যের পক্ষে যতই ক্ষতিকর হোক, রাসায়নিক মেশাতে হবে। যেন সহজে না পচে। যেন পোকা না ধরে। এসব খাদ্যে নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। কোনো কোনো জিনিসে রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে পোকা এবং পচন থেকে মুক্ত রাখার জন্য। কখনও রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে দ্রুত পাকার জন্য। কখনও রং সুন্দর ও মিষ্টি স্বাদ আনার জন্য। এসব খেয়ে মানুষ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু লাভের নেশায় এক শ্রেণীর উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী ঠিকই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়েই চলেছেন।

ব্যবসায় অসততা কোথায় নেই? আমদানিকারকরা নানা কারসাজি করে সরকারের কাছে সুযোগসুবিধা বাগিয়ে নিয়ে আমদানি মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে জিনিস বিক্রি করেন। আড়তদাররা নিজেদের সুবিধামতো জিনিসপত্র মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়ান। তারপর গুদামজাত পণ্য বেশি দামে বিক্রি করে বাড়তি লাভ পকেটে পোরেন। খুচরা দোকানদাররাও যতটা সম্ভব দাম বাড়িয়ে, ওজনে ঠকিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের চেষ্টা করেন।

শুধু ব্যবসা, ব্যবসায়ী কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই কি দুর্নীতি আক্রান্ত? দুর্নীতি কোথায় নেই? ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের কথাই চিন্তা করুন। যার অন্যায়ের প্রতিকার করার কথা, যে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন অপরাধ দমন ও অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার জন্য, সেই পুলিশ-ওসি-এসপির ভূমিকা আমরা কী দেখলাম? ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন নিজেই রাফির বক্তব্যের একটি ভিডিও ধারণ এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার মতো গর্হিত অপরাধ করেছেন। আইনের পোশাকধারী ব্যক্তি নিজেই যখন আইন লঙ্ঘন করেন, অপরাধীদের পক্ষ নেন, তখন মানুষ কার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে? ভরসাই বা করবে কাকে? মাহবুবুল-আলম হানিফ ঠিকই বলেছেন, ‘এত অসৎ জাতি নিয়ে বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়।’

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর