সোনালী দিনের স্বপ্ন ও আগামীর বাংলাদেশ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) | 2023-09-01 08:41:30

বাংলাদেশের সোনালী দিনের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। পাকিস্তানের শাসন- শোষণ-নির্যাতন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ সংগ্রাম আমরা করেছি তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে অসংখ্য সোনালী দিনের স্মৃতিচিহ্ন। সে সব স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে প্রোথিত হয়ে আছে বাঙালি জাতির স্বপ্ন ও প্রত্যাশার খতিয়ান। কেন এত সংগ্রাম, যুদ্ধ এবং রক্তক্ষরণ তার পূর্ণাঙ্গ কাহিনী জানলেই আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না।

জাতিগতভাবে রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পিছু টানবে এবং অগ্রযাত্রার পথকে অবরুদ্ধ করবে। রাজপথে রক্ত ঢেলে, জীবন দিয়ে নিজের ভাষাকে রক্ষা করার ইতিহাস শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের আছে। একবার ভেবে দেখুন এটা আমাদের জন্য কতবড় অহংকার ও গৌরবের বিষয়।

কথায় আছে ঐতিহ্যের মৃত্যু নেই। জাতি, রাষ্ট্র ও মানবতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের চেতনা আসতে পারে কেবল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সূত্র ধরে। রেনেঁসা পরবর্তী ইউরোপে সবচাইতে খ্যাতিমান সেনাপতি সম্রাট নেপোলিয়ান জীবনের শেষ প্রান্তে নির্জন সেন্ট হেলেনা দ্বীপের বন্দীখানায় বসে উপলব্ধি করেছিলেন, বিশ্বে শক্তির উৎস মাত্র দুটি-তলোয়ার ও চেতনা এবং শেষ বিচারে তলোয়ার সব সময়ই চেতনার কাছে পরাজিত হয়েছে এবং হবে। চেতনার শক্তি হচ্ছে ফিনিক্স পাখির মতো অবিনশ্বর।

আমাদের ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমাদের ত্যাগের কথা এবং তার গুরুত্ব আজ বিশ্ব সম্পদায়ের কাছে স্বীকৃত। বাংলা ভাষা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির ভাষা। আমাদের এই ভাষার মাধ্যমেই আমরা সম্প্রীতির শিক্ষা পাই এবং আমাদের হৃদয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে। সুতরাং ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা শুধু ভাষাকে রক্ষা করেছি তাই নয়, আমাদের মানস জগতে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চেতনার জন্ম হয়েছে। সেই পথ ধরেই স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক আদর্শ হিসেবে বঙ্গবন্ধু সন্নিবেশিত করলেন ধর্মনিরপেক্ষতা। তাতে স্পষ্ট হয় বাংলাদেশ হবে সকল ধর্মের মানুষের দেশ। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তির ধর্ম পরিচয় কখনো মুখ্য হয়ে দেখা দেবে না।

বিপরীতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য, যা ছিল একেবারেই অবাস্তব। সেই অবাস্তবকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করার কারণেই সাতচল্লিশের পাকিস্তান মাত্র ২৪ বছরের মাথায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। একবার ভেবে দেখুন ধর্মের নামে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের জন্ম হলো। অথচ সেই পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞ চালালো।এটি নজিরবিহীন। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা ছিল সমগ্র পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী এবং তাদের পাঞ্জাবি ভাষা দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। অথচ পাঞ্জাবীরা নিজেদের ভাষাকে কোরবানী দিয়ে পাকিস্তানের কিছু সংখ্যক মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নিল শুধুমাত্র বাংলা যাতে রাষ্ট্র ভাষা হতে না পারে তার জন্য। যাত্রার শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে হিংসার জন্ম দিল তার আগুনেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেল।প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার পথ ধরে বাঙালি জাতির সোনালী দিনের যাত্রা শুরু।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালিদের মনে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়ে যায় আর নতুন প্রত্যাশার লক্ষ্য অর্জনে শুরু হয় অবিরাম সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের এক পর্যায়ে গত শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগে বাঙালির র্পূব আকাশে উদিত হয় নতুন সূর্য। সেই সূর্যের প্রতিক শেখ মুজিবুর রহমান (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) কর্তৃক প্রণীত ছয় দফা হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ছয় দফার আবেদন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, বন্দর, হাট-বাজার, গ্রামে-গঞ্জে তিনি হাজির হন। তাতে দুটি কাজ হয়। প্রথমত, ছয় দফার আবেদন ও আকর্ষণে বাংলার জনগণের মনে বায়ান্নর শক্তি আবার জাগ্রত হয়, যেটি মাঝখানে কয়েক বছর সামরিক শাসনের দ্বারা দাবিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান। দ্বিতীয় কাজটি হয় শেখ মুজিবের নাম বাংলার প্রতিটি ঘরে এবং মানুষের হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে যায়। আইয়ুব খান ছয় দফার তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন বলেই হুমকি দেন, ছয় দফার জবাব তিনি অস্ত্রের মাধ্যমেই দেবেন। ইয়াহিয়া খানও বুঝেছিলেন। তাই তিনি সত্তরের নির্বাচনের প্র্রাক্কালে এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) জারি করেন তুরুপের তাস নিজের হাতে রাখার জন্য। কিন্তু ততদিনে বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা বুঝে গেছেন।

সে কারণেই আমরা দেখতে পাই পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারিতে রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) ময়দানে সকল সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আজ হতে ছয় দফা বাংলার জনগণের সম্পত্তি, এর সঙ্গে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে বাংলার মাটিতে তার কবর রচিত হবে, এমনকি আমি করলে আমারও।

ষাটের দশকের মধ্যভাগে প্রণয়নের পর থেকে ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই বাঙালি জাতির ইতিহাসে একের পর এক সোনালী অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে থাকে। আইয়ুব খান তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত বাংলার মানুষের গর্জন শুনে আইয়ুব খান পিছু হটতে বাধ্য হন। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, শেখ মুজিবের নি:শর্ত মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ, সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, একাত্তরের মার্চে অসামান্য অসহযোগ আন্দেলন, ৭ মার্চের বিশ্বখ্যাত ভাষণ এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সোনালী ইতিহাসের একটি পর্বের সমাপ্তি ঘটে।

তারপর একাত্তরের ৯ মাস। তার উপাখ্যান একটি-দুটি অধ্যায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সে এক সোনালী দিনের কথায় ভর্তি পরিপূর্ণ ইতিহাস। সোনালী বর্ণে ভরপুর সেই ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে বাঙালি জাতির প্রতিটি স্বপ্ন ও প্রত্যাশার কথা। তারমধ্যে সবচাইতে বড় স্বপ্নের প্রাপ্তি ঘটে স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। বাকি স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা পুরণের যাত্রাও শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ঘটনার মধ্য দিয় সবকিছু থমকে যায়। তারপর দুই সামরিক শাসক পরপর এক নাগাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে যা করেছেন সেটিকে এক কথায় বলা যায় তারা বাঙালি জাতির সোনালী দিনের সব স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে কবরস্ত করেছেন।

অনেক উত্থান-পতন, চড়াই- উৎরাই এং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মাথায় ২০১৮ সালে বিশাল জনম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগ এবং চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। সদ্য সমাপ্ত এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটির প্রেক্ষাপট যেমন ছিল তার দিকে তাকালেই আমাদের সোনালী দিনের স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একটা চিত্র পাওয়া যাবে। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় মূলত দুটি পক্ষের মধ্যে। প্রথম পক্ষে ছিল আমাদের সোনালী দিনের স্বপ্ন ধারণকারী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পক্ষ গত দুই মেয়াদ টানা দশ বছর এবং এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল।

গত দশ বছরে এই পক্ষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনেতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নসহ সার্বিকভাবে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রাষ্টকে শক্তিশালীকরণে অসামান্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। প্রথম পক্ষের বিপরীতে ছিল মূলত বিএনপি এবং স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতসহ অন্যান্য দল। এই পক্ষ হচ্ছে তারাই যারা বাঙালি জাতির সোনালী দিনের স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নপ্রসূত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ১৯৭৫ সালের পর কবরস্ত করেছে। এই পক্ষ ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ এই দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। এ পক্ষের মূল নেতা বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকে জেলে আছেন।ভারপ্রাপ্ত নেতা তারেক রহমান দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং ফেরারি আসামি হিসেবে বিদেশে পলাতক- বিশ্বের কোথাও তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।

অর্থাৎ গত এক বছর ধরে নেতৃত্বের মহা সংকটে বিএনপি। গত দুই মেয়াদে যখন তারা ক্ষমতায় ছিল তখন কোনো সেক্টরে তারা উল্লেখ করার মতো অথবা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। নির্বাচনী প্রচারের সময়ও এটা লক্ষ করা গেছ। বিএনপি প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত অভিযোগ নিয়ে মানুষের কাছে গেছে, নিজেদের সাফল্যের কথা একটিও বলতে পারেনি।

নিজেদের সাফল্য গাঁথা জনগণের কাছে তুলে ধরা আর সেটির বদলে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বদনাম করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সুতরাং নির্বাচনের ফল যা হবার তা-ই হয়েছে। বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সোনালী দিনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ধারনকারী দল আওয়ামী লীগ। বিগত দশ বছরে অর্থনেতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও সোনালী দিনের যে স্বপ্ন তার পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূর। নতুন সরকার গঠন এবং তাদের প্রাথমিক পদক্ষেপের মধ্যে চমক আছে। তবে, ১৬ কোটি মানুষের মুখে এখন একটিই কথা--দুর্নীতির শেকড় উপড়ে সেটিকে দৃশমান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারলে বাংলার মানুষ বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে আমাদের সোনালী দিনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়নি।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.): কলামিস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর