রূপার বাবা ও চকবাজার অগ্নি-ট্র্যাজেডি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোকাম্মেল হোসেন | 2023-08-26 17:15:58

ভোরবেলা রাস্তায় কোনো যানজট নেই। যানজট না থাকলে ঢাকা শহরে চলাফেরায় খুব আরাম। আরাম পাচ্ছি, হঠাৎ একটা জটলা চোখে পড়ল। রিকশা থামিয়ে ওদিক থেকে আসা একজন পথচারীর কাছে জানতে চাইলাম-

: কী হইছে ভাই! জটলা কেন?

: কুত্তার বাচ্চা।

লোকটার মুখের ভাষা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তথ্য প্রদানে বাঙালির অসহযোগিতার বদনাম আছে। কোনো  কোনো ক্ষেত্রে গালিগালাজের নজিরও রয়েছে। আমি এমন কোনো তথ্য জানতে চাইনি; যার জন্য এমন জঘন্য একটা গালি শুনতে হবে। লোকটার নাক বরাবর নিশানা ঠিক করে ডানহাত মুষ্টিবদ্ধ করতেই সে বলে উঠল-

: খন্দকের মধ্যে একটা কুত্তার বাচ্চা পইড়া গেছে। মানুষ গোল হইয়া তামশা দেখতেছে।

মানুষের মুখের কথা কখনো কখনো মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। আর একটু হলেই কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতো,  ভেবে জিহ্বায় কামড় দিলাম। যাক! শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি এজন্য আল্লাহপাকের দরবারে লাখো শুকরিয়া।

জটলার কাছাকাছি পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে পড়লাম। দেখলাম, ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ চলছে। নিচে স্যুয়ারেজ লাইন বসানোর জন্য জায়গায় জায়গায় যেসব গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে, তার একটার মধ্যে কুকুরছানাটা পড়ে গিয়ে কেঁউ কেঁউ আওয়াজ করছে। একজন লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে কুকুরছানাটাকে উপরে তোলার চেষ্টা করছিলো। উদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে দু’একজন তাকে মূল্যবান বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছে। গর্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো কুকুরছানা নয়; গর্তে পড়ে আছে প্রিয় বাংলাদেশ। কিছু মানুষ লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দেশটাকে উপরে তোলার চেষ্টা করছে, কিছু মানুষ নানারকম পরামর্শ দিচ্ছে; কিছু মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে রঙ্গ দেখছে!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াতেই রাস্তার পাশে একটা বিলবোর্ড নজরে এলো। বিলবোর্ডে একজন ভিআইপির ছবি। ছবিতে ভিআইপি মহোদয় ডানহাতের বুড়া আঙুল থুঁতনির নিচে রেখে মিটিমিটি হাসছেন। ছবির পাশে তার দ্বারা সম্পাদিত উন্নয়নের ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে। ভিআইপি মহোদয়ের ডানহাতের তিন আঙুলে পাথর বসানো তিনটি আংটি শোভা পাচ্ছে। আঙুলের চাপে তার থুতনিতে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। কয়েক বছর আগে নগরবাসীর কাছে ভোট ভিক্ষা করার সময় তার শরীর এতটা মোটাতাজা ছিল না। মাত্র কয়েকবছর দায়িত্ব পালন করে তিনি থুতনিতেই যদি আধাকেজি চর্বি জমিয়ে ফেলেন, তাহলে তার সারা শরীরে কতটুকু চর্বি জমেছে, তা বের করার উদ্যোগ নিয়েও রণেভঙ্গ দিলাম। খামাখা সময় নষ্ট। 

গর্ত দেখতে দেখতে সাবধানে পা ফেলছি; হঠাৎ সামান্য দূরে দ্রুতগতির একটা সিএনজি অটোরিকশা পাক খেতে খেতে উল্টে গেলো। দৌড়ে সেটার কাছে গেলাম। আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন ছুটে এলো। সবাই মিলে গাড়িটাকে টেনে উঠানো হলো। ভেতর থেকে রক্তাক্ত চেহারা নিয়ে চালক বের হলেও পেছনের যাত্রীর কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। চালককে বললাম:

: আপনের যাত্রী মনে হয় জ্ঞান হারাইয়া ফেলছে, কী করবেন?

চালক কোনো কথা না বলে বামহাতের তালু দিয়ে নাকের রক্ত মুছতে লাগল। পুনরায় তার উদ্দেশে বললাম:

: আপনের নিজেরও তো চিকিৎসা দরকার। দুইজন একসঙ্গে হাসপাতালে চইলা যান।

ড্রাইভার জোরে দম ছেড়ে বলল:

: ওনারে হাসপাতালেই লইয়া যাইতেছিলাম। আগুনে পোড়া মানুষ; হাসপাতালে নেওয়ার আগেই যদি মইরা যায়, এই টেনশনে খুবই জোরে চালাইতেছিলাম। সামনে যে স্পিডব্রেকার আছে, খেয়াল করি নাই।

আগুনের কথা শুনে সকচিত হলাম। বিষয়-বৃত্তান্ত জানতে চাইলে চালক অবাক হয়ে সবার উদ্দেশে বলল:

: আগুনের ব্যাপারে আপনেরা কেউ কিছু জানেন না?

উপস্থিত লোকজনের মধ্য থেকে আমি না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়তেই চালক বলল:

: কী কন এইসব! গতরাইতের ঘটনা, আগুনে চকবাজার পুইড়া শেষ। 

: পুরান ঢাকার চকবাজার?

:হ। শুনলাম, কেমিক্যালের গোডাউনে নাকি আগুন ছড়াইয়া পড়ছিলো। অনেক মানুষ পুইড়া মরছে। আমি খুব ভোরে কমলাপুর রেলইস্টিশন থেইকা একটা ট্রিপ লইয়া ওইদিকে গেছিলাম। রাস্তায় কয়েকজন আমার প্যাসেঞ্জাররে নামাইয়া দিয়া বলল:

: তুমি আগে মরণাপন্ন এই মানুষটারে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাইয়া দেও।

: ওনার সঙ্গে কেউ আসে নাই?

: না। ওনারে গাড়িতে তুইলা দিয়া উদ্ধারকারীরা অন্যদিকে ছুইটা গেছে... 

চকবাজার অগ্নিকাণ্ড নিমতলী ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২০ জনেরও বেশি নারী-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছিল। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা বলে কলরব হয়েছিল বেশ কিছুদিন। কলরব শুনে মনে হয়েছিল, অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী কারণগুলো সমূলে উৎপাটিত হবে। কিন্তু প্রায় সাড়ে আট বছরেও যে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, চকবাজারের আগুন কি সেই বার্তাই দিল?

গোয়েন্দা তথ্যমতে, ২০১০ সালে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের সময় পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৯৯৪টি কেমিক্যাল গোডাউন ছিল, যার মধ্যে অনুমোদনপ্রাপ্ত গোডাউনের সংখ্যা মাত্র ১২৭। বাকি সবগুলোই অবৈধ। এই ক’বছরে এ সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যালের অবৈধ ব্যবসা ও লাইসেন্স প্রদান বন্ধসহ গোডাউন অপসারণ ইত্যাদি বিষয়ে ১৯ দফা সুপারিশ পেশ করেছিল গোয়েন্দা বিভাগ। দুঃখ কোথায় রাখি; সেসব সুপারিশের একটাও বাস্তবায়িত হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের অনেকে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হচ্ছে না; উপরন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও তাদের সমীহ করে চলে। কেবলমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যদি সাতখুন মাফ হয়ে যায়, তাহলে সবকিছু ‘হালাল’ করতে সবার উচিত রাজনীতি-চর্চায় মশগুল হওয়া; উদয়াস্ত পরিশ্রম ও ধকল সইবার প্রয়োজন কী?

সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। সিএনজি অটোরিকশার চালক হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না। বারকয়েক তাড়া দেয়া পর সে অসহায় ভঙ্গিতে বলল: 

: ভাইজান, আমার টাইম শেষ। টাইমমতো গাড়ি জমা না দিলে মহাজন খুব ঝামেলা করে। 

 লোকটাকে স্বার্থপর বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। শেষবারের মতো তার উদ্দেশে বললাম:

: এতটুকু যখন করছেন; তখন উনারে একটু হাসপাতালে পৌঁছাইয়া দেন। কোনো সমস্যা নাই, আপনের সঙ্গে আমিও যাব।

: ভাই; আমারে মাফ কইরা দেন।

পাশ দিয়ে একটা ভ্যান যাচ্ছিল। সেটাকে দাঁড় করালাম। আগুনে পোড়া ভদ্রলোককে ধরাধরি করে ভ্যানের উপর শুইয়ে দিয়ে ভ্যানচালককে বললাম:

: ঢাকা মেডিকেলে চলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পার হচ্ছি, ভদ্রলোকের পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা-পরিচয় কিছুই জানি না। মোবাইল ফোন এক্ষেত্রে যোগসূত্র হতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ জানতে চাইলো:

: রূপার আব্বু, তুমি কোথায়?

বোঝা গেল, রূপা নামে ভদ্রলোকের একটা মেয়ে আছে। যিনি ফোন করেছেন, তিনি কি রূপার মা? ফোনে স্বামীর খোঁজখবর নিচ্ছেন? কী উত্তর দেবো, বুঝতে পারছি না। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভদ্রমহিলার উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এলো:

: কী হইল! কথা বলতেছো না কেন? তুমি এখন কোথায়?

দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। ঠিক করলাম, আগে হাসপাতালে যাই; তারপর ওখান থেকে ভদ্রমহিলার নম্বরে কলব্যাক করে সবকিছু জানালেই হবে। এর আগ পর্যন্ত শুধু ‘হা-হু’ করে যেতে হবে। আস্তে করে বললাম:

: রাস্তায়।

: এখনও রাস্তায়! দোকানে পৌঁছাইতে আর কতক্ষণ লাগবে?

ভদ্রলোক তাহলে দোকানে যাচ্ছিলেন? নিজের দোকান, নাকি অন্য কারো দোকানে চাকরি করেন? আগের মতোই আস্তে করে বললাম:

: এই তো...

ভদ্রমহিলা এবার জানতে চাইলেন:

: এই সপ্তাহে কি তুমি বাড়িতে আসবা?

ভদ্রলোকের জ্ঞানহীন নিথর শরীরের ওপর চোখ রাখলাম। ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নার ঢেউ সামলে নিয়ে কোনোমতে উচ্চারণ করলাম:

: সঠিক বলতে পারতেছি না।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর চিকিৎসক এগিয়ে এলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন:

: পেশেন্ট আপনার কী হন?

: কেন!

: প্লিজ! আপনি মন শক্ত করুন।

: কিন্তু কেন!

: আই অ্যাম স্যরি টু ছে, হি অলরেডি এক্সপায়ার্ড; এখানে আনার অনেক আগেই ওনার মৃত্যু হয়েছে।

হাসপাতালে কেউ মারা গেলে নানা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার থাকে। ডাক্তার-নার্সরা সেসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এলোমেলো পা ফেলে বাইরে চলে এলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আমি যার মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে রইলাম, তার জন্য এদেশে নিশ্চয়ই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হবে না। জাতিও তার কথা মনে রাখবে না। অথচ এটাও পরিষ্কার একটা হত্যাকাণ্ড; কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত খুন। পকেট থেকে ভদ্রলোকের মোবাইল ফোন বের করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপতে লাগল। স্ত্রীর কাছে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সংবাদগুলোর একটি। আমাকে এখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম এ সংবাদটিই পরিবেশন করতে হবে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠতেই শহীদ মিনারের সিঁড়ির ওপর বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ আগের সেই নম্বরে কলব্যাক করতেই ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো:

: হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আপনি কে বলছেন?

: আমি তোমার এক আংকেল। তুমি কি রূপা?

: জি।

: রূপা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

: ক্লাস থ্রি।

: তোমার আম্মু কোথায়?

: আম্মু আচার রোদে দিতে উঠানে গেছে। আপনি আমাকে বলুন।

ছোট্ট মেয়েটিকে তার বাবার মৃত্যুসংবাদ দেয়া কি ঠিক হবে! কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, চারপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে রূপা ক্রমাগত ‘হ্যালো-হ্যালো’ বলছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও আমি কোনো কথা বলতে পারছি না...

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর