ভালোবাসার মিনার...

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-26 02:06:17

অজপাড়া গাঁতে আছি। এই গাঁও গেরাম আমার চেনা। ষড়ঋতুতে এখানে যে বায়ু বয়, তা ঢাকাতেও আমাকে যেন স্পর্শ করে যায়। এখানকার কৈশোরের কলতানে সুরের মূর্ছনায় থাকি নগরে বসেও। বিরতি দীর্ঘ হলেও আমরা পরস্পরের অপেক্ষায় থাকি। বয়স বাড়ে ওদের, আমি বাড়তে চাই না। নতুনের সঙ্গে যোগ দেই। এবার পুরনোর সঙ্গে নতুন কতো জন যে যোগ দিলো।

ফেরার দিন বায়না ওদের- শহীদ মিনারে ফুল দিতে হবে ওদের সাথে। যেতে হবে ওদের স্কুলে। ওদের বলি, চলো আমরাই বানাই শহীদ মিনার। বাড়ির উঠোনেই। এক কথায় রাজি ওরা। ভাবনায় পড়ে গেল, কী দিয়ে তৈরি হবে মিনার? কেউ বললো ইটে। ব্যস ইট আনতে ছুটলো সকলে। কিন্তু ইটের গাঁথুনি কয়েক ঘণ্টায় টেকসই করে দাঁড় করানো যাবে না। এখানে তো কোনো স্থপতি আর মিস্ত্রি হাত লাগাবেন না।

ওরা ওদের মতো করে তৈরি করে নেবে। তাই মত পাল্টে সিদ্ধান্ত হলো মিনার তৈরি হবে বাঁশ দিয়ে। ব্যস কোন বাড়িতে বাঁশ আছে, নিয়ে আসার জন্য ছুটল। আনা হলো রঙিন কাগজ। মিনার সাজাতে হবে। ছোটদের দল আঁকতে বসে গেল। কেউ ফুল, কেউ বর্ণমালা। লাল সূর্যও আঁকা হলো। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আনা হলো ফুল। কেউ কেউ পাঠ্য বই নিয়ে এলো। মিনারে পাদদেশে রাখবে বলে। গানের রেওয়াজও শুরু। সব ওরাই করছে। আর আমার চোখ দিয়ে ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা। গরবে বুক টইটম্বুর।

ওরা শহীদ দিবসকে ভোলেনি। ওরা ওদের মায়ের ভাষাকে ভোলেনি। নিজের সামর্থ্য দিয়ে বাংলাকেই ভালোবাসছে। বর্ণমালার ষোলআনা মালিকানা ওদের।

মায়ের উচ্চারণ, বর্ণমালাতে ওরা এখনো বুঁদ হয়ে আছে কেন? আমাদের ছেলে মেয়েরা তো বাংলা ছেড়ে পালাচ্ছে। ওদের রুচিতে ধরে না। আমরাই ওদের রুচি বদলে দিয়েছি। বাংলায় ভরসা করলে অভিবাসী হওয়া কপালে জুটবে না। চাকরি জোটানো, সমাজে চলা মুশকিল হবে। সন্তান বাংলা পাঠ না করলে সমাজে আমাদের আভিজাত্য বাড়ে। বাংলার সঙ্গে আরবিটা রেখে দিয়েছি। কারণ ধর্মটাও আমাদের লাগে। ধর্ম ওদেরও লাগে।

আমরা যেমন ইংরেজিটাকে রেখেছি ইহকালের গর্বে। তেমনি ওরা আরবি রেখেছে পরকালে আভিজাত্যের স্বপ্নে আর ইহকালের রুটি রুজির জন্য। আমাদের দুই পক্ষের তফাৎ হলো কথা বলা এবং দৈনন্দিনতায় ওরা বাংলা ছাড়েনি। আমরা ছেড়েছি । আমাদের যাদের সচ্ছলতা আছে তারা ইংরেজির কাছে আশ্রয় নিয়েছি। রাজধানীর মতো গ্রামেও কদর বাড়ছে ইংরেজি স্কুলের। যাদের সমর্থ নেই, তারাই পড়ে আছে বাংলা মাধ্যমে।

ঐ গ্রামে শহীদ মিনার গড়তে পাশে পেলাম ওদেরই। বাঁশের তৈরি শহীদ মিনার কতদিন টেকসই হবে জানি না। কিন্তু এই শিশু-কিশোরদের মনে নিজের তৈরি যে মিনার গড়ে উঠলো, তা গুঁড়িয়ে দেবে কোনও অশুভের এমন শক্তি নেই।

তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর