বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতিশাস্ত্র ও সামাজিক বিজ্ঞানের কিংবদন্তী শিক্ষক ও কল্যাণবাদী অর্থনীতিবিদদের পথিকৃত অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমানের জীবনাবসানের ঘটনায়, যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন মাত্রই দিনকয়েক আগে। আমরা যারা অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অর্থনীতি ও সামাজিক ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করি, তাদের কাছে অর্থনীতিবিদদের অবদান-কর্ম নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম হয় অর্থনীতি শাস্ত্রে দর্শনের দারিদ্র্যের কারণে। তবে অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমানের এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ তিনি অর্থনীতি শাস্ত্রকে অর্থ নয়, নীতির আলোকে দেখতেন। আত্মপ্রচার ও স্বার্থ সিদ্ধির পরিম-লে বিচরণ করেও নীতিনৈতিকতাপূর্ণ মহিমা দিয়ে তিনি নিজের মতো পথ তৈরি করে নিয়ে অবিরত সামনে এগিয়ে গেছেন এবং সেই পথে নিজের চিন্তা, চেতনা ও কর্মকে ছড়িয়ে দিয়ে আলাদা এক জগৎ তৈরি নিয়েছেন। এই জগতে কে এলো-কে এলো না-কে চলে গেল, সেসব নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের কারণে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ক্রুদ্ধ হলো কি না, কিংবা কারও স্বার্থে আঘাত লাগল কি না; তা নিয়েও তাঁর কোনো বিকার ছিল না।
যখনই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সমাজ-দর্শনের মৌলিক চিন্তায় ছেদ পড়তে দেখেছেন, ছেদ পড়ার লক্ষণ দেখেছেন; তখনই তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, শুধরে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এবং কিছুতেই কিছু না হলে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে দূরে সরে গেছেন আর নির্ভৃতে জগতে ফিরে রবীন্দ্রনাথের গানের কলিতে গেয়ে উঠেছেন, “তেমনি করে আপন হাতে ছুঁলে আমার বেদনাতে, নূতন সৃষ্টি জাগল বুঝি জীবন-’পরে।” তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা, তাঁকে বুঝতে পারা, তাঁকে নিয়ে চর্চা করা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান শাস্ত্র এবং সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রের চিন্তা-চেতনার বিকাশের জন্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে অল্পকথায় মোঃ আনিসুর রহমানের মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব, গুরুত্ব ও জীবনকর্ম তুলে ধরা অসম্ভব। শিক্ষাগুরু হিসেবে ছিলেন পুরোপুরি প্রথার বাইরে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হওয়ার জন্য অনুরোধ-উপরোধ, আহ্বান-চাপ-তাপ তিনি অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মক্ষেত্র ও দর্শন পুরোপুরি অনুপোযুক্ত, শিক্ষকরা সবাই চলে গেলে ছাত্রদের পড়াবে কে?
শ্রেণিকক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম ও ব্যতিক্রমী এই শিক্ষক সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে তাঁর অধ্যাপনাকালীন ছাত্র অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ লিখেছেন, “অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমানকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পাই। প্রথম দিনের ক্লাসে তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের কোনো টেক্সট বই নেই। তোমরা মাইক্রো ইকোনমিক্স শিখবে কৃষকদের কাছ থেকে।’ আর যদি টেক্সট বইয়ের দরকার হয়, এই বলে আমাদের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন এবং ইটওয়েলের লেখা একটি বইয়ের নাম জানিয়ে দেন... স্যার একদিন বলেন, ‘ধরা যাক, একটা লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সাঁতার জানেন না। তাকে উদ্ধার করতে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে। তারপর তার চুলের মুঠি ধরে তাকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ঠেলে তাকে তীরে তুললে। লোকটা বেঁচে গেল। এটাকে কি উন্নয়ন বলা যাবে? এক অর্থে উন্নয়ন, কারণ তিনি মারা যাননি। কিন্তু ওই লোকটাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, আপনি কি এভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন? তিনি হয়তো বলবেন, ঠিক এভাবে নয়। অন্য একটা পথও তো ছিল। এটাকে এভাবে বলতে পারি, ধরা যাক, তুমি উদ্ধারের জন্য তার কাছে সাঁতরে গেলে। তাকে বললে, আমার এই হাতটা ধরেন এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে তীরে চলেন। আমরা একসঙ্গে যাব। এটাই কিন্তু বেশি গ্রহণযোগ্য।”
এই কথার মাধ্যমে বাংলাদেশের ৫৩ বছরের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দৈন্যের অলঙ্ঘনীয় পূর্বাভাস অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান যে ৫০ বছর আগেই দিয়েছিলেন, তা নিশ্চয়ই এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত হবে। এ কারণেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, অর্থনীতি শাস্ত্রের একাডেমিক অঙ্গনে কাজ করা থামিয়ে না দিলে তাঁর অনেক আগেই অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান নোবেল পুরস্কার পেতেন। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মানবিকতা, সহমর্মিতা আর মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করতে চাওয়ার ভাবনা এবং সবসময় কল্যাণবাদী অর্থনীতির চিন্তার বহিঃপ্রকাশ তিনি শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে প্রথম পরিকল্পনা কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল ও সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ সর্বত্র বয়ে বেরিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসন প্রশ্নে তিনি প্রচলিত-মূলধারার অর্থনীতিবিদ ও সমাজচিন্তকের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্নমতের ছিলেন।
‘অপহৃত বাংলাদেশ’ গ্রন্থে তিনি বলেন, “আমাদের জনগণের সৃষ্টিশীল সত্তাকে অস্বীকার করে, এ সত্তাকে আত্মচরিতার্থের জন্য মুক্তি না দিয়ে, অসাধ্য সাধন করতে আহ্বান না করে আমরা তাদের দারিদ্র্যকেই তাদের প্রধান পরিচয় ও জাতীয় সমস্যা বলে চিহ্নিত করে এই দারিদ্র্য বিমোচনের আশ্বাস দিয়ে দিয়ে তাদের অপমানিত করছি। এই অপমান যে নিজেদেরই করছি তাও আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ মানুষের পরিচয়কে খাটো করলে মানুষকুলের সদস্য হিসেবে নিজেরাও খাটো হয়ে যাই।”
তাঁর দার্শনিক এই যুক্তিতে বাংলাদেশের কল্যাণবাদী উন্নয়নের আদি-অন্ত-ভূত-ভবিষ্যৎ ভাবনার অনেক উপাদানই রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত উন্নয়ন ভাবনায় মানুষের যেহেতু কোনোভাবেই মুক্তি মিলছে না, মানুষ যেহেতু ক্রমশই ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং কোনোভাবেই সমর্থ হচ্ছে না; সেহেতু আনিসুর রহমানের মতো মূলধারার বাইরে গিয়ে অর্থনীতি চিন্তার চর্চা করে তা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কাজে লাগানোর চেষ্টা করা বাংলাদেশের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান কেমন ব্যক্তিত্ব-আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার অধিকারী ছিলেন, তার নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘পথে যা পেয়েছি’ গ্রন্থে, “আমেরিকায় উইলিয়ামস কলেজে শিক্ষকতায় থাকাকালেই আমাকে না জিজ্ঞেস করেই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নিয়োগ করা হয়। দেশে ফিরে জানতে পারি বাহাত্তরের ১৮ই জানুয়ারি এই মর্মে সরকারের গেজেট নোটিফিকেশনও হয়ে গিয়েছে এবং সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়াতেও এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ্দের নিয়ে এই পরিকল্পনা কমিশনের অনেক আশা। আমি তবু ঢাকায় ফিরে সোজা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে রিপোর্ট করি এবং ক্লাস নিতে শুরু করি। আমরা যে তেমন কিছু করতে পারব না, রাজনীতিবিদরাই আসল ক্ষমতা ব্যবহার করবেন এবং তাদের ইচ্ছেমতোই দেশ পরিচালনা করবেন, এ সম্বন্ধে আমরা তো দিল্লীতেই আলোচনা করেছিলাম ও একমত হয়েছিলাম। ... চুপ্ করে বিশ^বিদ্যালয়ে, যেন আত্মগোপন করে, কাটাতে থাকলাম। প্রথমে ফোন করলেন পরিকল্পনা কমিশনের “মেম্বার ওয়ান”। “কী আনিস তুমি জয়েন করছো না? তোমাকে ভীষণ দরকার, অনেক কাজ!”। আমি বল্লাম, আমার সঙ্গে তো দিল্লীতেই কথা হয়েছিল আমরা জয়েন করব না। আপনারা জয়েন করে ভুল করেছেন। আমি করতে চাই না। ... তখন স্বয়ং ডেপুটি চেয়ারম্যান ফোন করলেন। তাঁকেও একই কথা বললাম। তিনি বল্লেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু আমি বেয়াদবের মতোই বললাম, “দেখা করতে হয় আপনি আসুন।” ... “মেম্বার ওয়ান” আবার আমাকে ফোন করেন এবং বলেন ডেপুটি চেয়ারম্যান কী করে আমার কাছে আসবেন। আমি বলি যে আমি তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি না তিনিই আমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন, কাজেই তাঁরই আমার কাছে আসা উচিত এবং আমি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদমর্যাদা কারো চাইতে কম নয় বলেই মনে করি। ... ফেব্রুয়ারীর ৪-তারিখে ডেপুটি চেয়ারম্যান, মেম্বার ওয়ান এবং “মেম্বার টু” তিনজনই উপাচার্জ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের অফিসে আসেন ...।” অনুরোধ-চাপাচাপিতে নিতান্ত বাধ্য হয়ে নানা শর্ত দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে তিনি যোগ দিলেও ছয় মাস পরই সবার আগে পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আপন ভুবনে ফিরে যান নিজের মতো করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসে।
বাংলাদেশের সত্যিকার বিনির্মাণে তাঁর যে দর্শন তা আগেও অপরিহার্য ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তিনি তাঁর দর্শন দিয়ে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের উন্নয়নের এক সংবিধান রচনা করে গেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘অপহৃত বাংলাদেশ’-এ বলেন, “উন্নয়নের অর্থ মানুষের সৃষ্টিশক্তির মুক্তি এবং এই মুক্তির পরিকল্পনাই হলো উন্নয়ন পরিকল্পনা। কতগুলো রেলওয়ে ওয়াগন আমদানি করতে হবে, কত মাইল রাস্তা তৈরি করতে হবে এবং কতখানি জমি দেশি ধানের চাষ থেকে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষে আনতে হবে, এগুলো সব উন্নয়ন অ্যাকাউন্টিংয়ের কাজ, যে কাজ দক্ষ অ্যাকাউন্ট্্যান্টরা করবেন। পরিকল্পনাবিদের কাজ মানুষের আত্মা যে দরজায় আঘাত করছে, তা কী করে খোলা যায় তার পরিকল্পনা করা। গ্রামে যেতে হবে নিজেদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে এবং সত্যিকার উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য যে পরিসংখ্যান প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে-মানুষের এবং তার মন ও মানসের পরিসংখ্যান। আট থেকে দশজনের গ্রুপে ভাগ হয়ে যান, র্যানডমভাবে তিনটি গ্রাম বেছে নিন এবং প্রতিটি গ্রামে এক মাস করে থাকুন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মেঝেতে একটি মাদুর পেতে নিন, মশা সহ্য করতে না পারলে একটি মশার কয়েল রাখুন-এর বেশি নয়। গ্রামে গ্রামবাসীদের মতো থাকুন, তাঁদের সঙ্গে দিনে কয়েক ঘণ্টা করে মাঠে কাজ করুন, কাজ করতে করতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন, অন্য সময় কথা বলুন তাঁদের একেক জনের সঙ্গে এবং তাঁদের একেকটি গ্রুপের সঙ্গে। সন্ধ্যার পর যতক্ষণ সম্ভব বাইরে থাকুন। রাত্রি যখন গভীর হতে থাকবে, তখন দিনের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গ্রামের সামাজিক মানস আপনার কাছে প্রতিভাত হতে থাকবে। তখন, কেবল তখনই, বাংলার চাষির সম্ভাবনা আপনার কাছে ধরা পড়বে। এভাবে তিনটি গ্রামে থাকুন এবং আর একটি মাস একটি শিল্পাঞ্চলে থাকুন, শ্রমিকদের সঙ্গে। এই শ্রমিকেরাই-কোনো ফ্যাক্টরি বা মেশিন নয়-আরও যথাযথভাবে বলতে হলে এই শ্রমিকদের মন ও মানসই আমাদের শিল্পের ইতিহাস সৃষ্টি করবে। এই মন ও মানসকে, এর ভেতরে যে শক্তি আর কল্পনা লুকানো আছে, তাকে স্টাডি করুন-সে যখন সকালে ফ্যাক্টরিতে যায়, তখন তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এবং তার অপ্রস্তুত কথাবার্তা শুনতে শুনতে, ফ্যাক্টরিতে সে যখন কাজ করে তখন তার কাজে একটি হাত এগিয়ে দিয়ে আবার তার কথা শুনতে শুনতে এবং তারা ইতিহাস সৃষ্টি করতে কোথায় বাধা পাচ্ছে তার খোঁজ করুন। চার মাস পর ফিরে এসে খসড়া পরিকল্পনাটি আর একবার দেখুন। আপনারা তখন এটিকে বদলাতে চাইবেন, আর যতখানি বদলাতে চাইবেন, তা আপনাদের আজকের অক্ষমতার পরিমাপ দেবে।”
৯২ বছর বয়সে মহান এই ব্যক্তিত্ব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতিবিদদের জন্য তাঁর মতো একজন অভিভাবকের শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। ১৯৯৩-৯৫ সময়কালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে তিনি উদীয়মান অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নীতিনৈতিকতা বোধ জাগরণ ও দার্শনিক চিন্তার বিচ্ছুরণ ঘটানোর প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রয়াস কতটা স্বার্থক হয়েছে, সে নিয়ে প্রশ্ন করা বা পরিমাপ করা অবান্তর-অমূলক। কারণ, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দর্শনের দারিদ্র্য এখন আরও জেঁকে বসেছে। সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে কে কোথায় জড়িত হয়ে পড়ছে, কোন প্রতিষ্ঠানে কী উপায়ে চেয়ারে বসে পড়ছে; সেসব চিন্তা করা এখন অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
মোঃ আনিসুর রহমান শুধু শিক্ষক, অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন না, ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে রেনেসাঁ বয়ে আনার স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক। তিনি ছয়দফা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, পাকিস্তানি শাসকদের এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রতি সীমাহীন বৈষম্য ও শোষণের মুখোশ উম্মোচনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম, জনল্যাণ ভাবনা, সমাজচিন্তা আর স্নেহময় স্মৃতি ও গণমানুষের প্রতি গভীর মমতা বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদসহ সব মানুষের কাছে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে অমর হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শাস্ত্র ও সামাজিক বিজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ প্রয়াত অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহমান-এর প্রয়াণ বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়